শিশু ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে দুইজনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। শিশু হত্যা-নির্যাতন বন্ধে এই রায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আমরা আশা করছি। এখনো আরও আইনি ধাপ বাকি আছে। সব ধাপ পার করে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্টরা আন্তরিক প্রয়াস চালাবেন-এমনটিই প্রত্যাশিত।
গতকাল মঙ্গলবার ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক জয়শ্রী সমদ্দার আসামিদের উপস্থিতিতে এ রায় ঘোষণা করেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন-গোলাম মোস্তফা ও আজিজুল বাওয়ানী। মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেন আদালত। জরিমানার টাকা সমহারে দুই পরিবার পাবে। রায় ঘোষণার আগে আসামিদের কারাগার থেকে আদালতে হাজির করানো হয়। রায় ঘোষণার পর তাদেরকে আবার কারাগারে পাঠানো হয়।
মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি দুপুরে ভিকটিম নুসরাত জাহান এবং ফারিয়া আক্তারকে রুমে ডেকে নেন আসামিরা। এরপর তারা রুমের দরজা বন্ধ করে মোবাইলের মাধ্যমে সাউন্ডবক্সে গান ছেড়ে তাদের ধর্ষণ করেন। ধর্ষণ শেষে আসামি আজিজুল নুসরাত জাহানকে গামছা দিয়ে শ্বাসরোধ করে এবং আসামি গোলাম মোস্তফা ফারিয়াকে গলা টিপে হত্যা করেন।
এ ঘটনায় ডেমরা থানায় নুসরাত জাহানের বাবা পলাশ হাওলাদার বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। ২০১৯ সালের ২২ জানুয়ারি ডেমরা থানার উপ-পরিদর্শক শাহ আলম দুই আসামির বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন। একই বছর ২৩ মার্চ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন।
বিগত দু’দশকে শিশু সুরক্ষায় বাংলাদেশে আইনী কাঠামো শক্তিশালী হয়েছে; নেয়া হয়েছে সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ। কিন্তু সামগ্রিক বিবেচনায় ও পরিস্থিতি বিশ্লেষণে স্পষ্টত শিশুর প্রতি সহিংসতার দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। বরং ভয়াবহতা ও নৃশংসতা বেড়েছে। শিশু নির্যাতনের ক্ষেত্রে দ্রæত বিচারের সাম্প্রতিক দৃষ্টান্তের পরও দেখা যাচ্ছে নির্যাতন চলছেই। বিশেষ করে পৈশাচিক কায়দায় নির্যাতন করে হত্যার ঘটনা সমাজকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে শিশুরা অবলীলায় হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে। এই নৃশংসতার অবসান হওয়া প্রয়োজন। এ জন্য নতুন করে ভাবতে হবে কেন এক শ্রেণির মানুষ এতোটা বিকারগ্রস্ত হয়ে শিশুহত্যায় মেতে উঠলো।
গত বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এই ছয় মাসে বাংলাদেশে ৩৯৯ জন শিশু ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছে বলে জানিয়েছে বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের সংবাদ বিশ্লেষণ করে ফাউন্ডেশনের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ধর্ষণের পর একজন ছেলে শিশুসহ মোট ১৬ জন শিশু মারা গেছে। অন্তত ৪৯টি শিশু (৪৭ জন মেয়েশিশু ও ২ জন ছেলেশিশু) যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে।
সভ্য সমাজে শিশুর প্রতি মানবিক আচরণ করা হয় হত্যা, খুন অপহরণ, ধর্ষণ তো দূরের কথা। এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রেও শিশুহত্যা নিষেধ। কিন্তু আমাদের সমাজে কেন এসব ঘটছে সেটি গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। শিশুরা নিরীহ ও দুর্বল। এ জন্য সহজেই তারা টার্গেটে পরিণত হয়। এছাড়া শিশুরা নির্যাতনের শিকার হলেও নানা পারিপার্শ্বিক কারণে তারা বিচার চাইতে পারে না। শিশু নির্যাতন বন্ধ না হওয়ার এটিও বড় কারণ। যে হারে শিশুহত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ চলছে সেটা যে কোনো সুস্থ সমাজের জন্য অশনি সংকেত। একটি সভ্য সমাজ এভাবে চলতে পারে না। শিশুরাই আগামী। তাদের পরিচর্যা করে সুষ্ঠুভাবে গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির উন্মেষ ঘটাতে হবে। পাশাপাশি অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, যে সমাজে শিশুরা নিরাপদ নয় সে সমাজ কখনো সভ্য সমাজ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না।