>> তৈরি হচ্ছে ভূমিহীনদের জন্য আরো নতুন করে ২১২টি গৃহ
প্রবীর কুমার কাঞ্চন, তারাগঞ্জ (রংপুর):
রঙিন টিনের নতুন ঘরের সামনে লাগানো হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা। চারা গুলো দিন দিন বেড়ে উঠছে। আর রঙিন টিনের বাড়ির সামনে ভূমিহীন সমস্ত বেওয়া নামের ৬৫ বছরের বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে আছে। দেখা গেল ওই বৃদ্ধার চোঁখ দিয়ে অঝোর ধারায় ঝড়ছে পানি। শাড়ির আঁচলে চোখ মুখে নিজেকে কিছুটা সামলিয়ে বললেন, ১৫ বছর আগোত স্বামী মরছে মোর। রাস্তার ধারোত পলিথিন দিয়া চালি তুৃলি আছনু। ইউএনও স্যার মোক রাস্তা থাকি তুলি আনি ঘরোত ঢুকিদেছে। মুই জমি আর নয়া ঘরের মালিক হইম বাবা ভাবোং নাই। সমস্ত বেওয়ার মতো ৬৫টি ভূমিহীন পরিবারের মাথাঁ গোজার ঠাঁই হয়েছে রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার সয়ার ইউনিয়নের কামারপাড়া গুচ্ছগ্রামে ৩০টি ও হাড়িয়ারকুঠি উজিয়াল গুচ্ছগ্রামে ৩৫টি অসহায় ভূমিহীন পরিবারের।
গত রবিবার দুপুরে সরেজমিনে কামারপাড়া গুচ্ছ গ্রামে গেলে সমস্ত বেওয়ার সাথে কথা হয়। ওই বৃদ্ধা জানান, তার স্বামীর বাড়ি উপজেলার সয়ার ইউনিয়নের মিস্ত্রিপাড়া গ্রামে। দিন মজুর স্বামী সিরাজুল ইসলাম ১৫ বছর আগে মারা যাওয়ার পর একমুঠো ভাতের জন্যে এলাকার এ বাড়ি ও বাড়ি সহ আশপাশের হাট বাজারে ভিক্ষা করতেন। কোন জমি না থাকায় মিস্ত্রি পাড়ার রাস্তার ধারে পলিথিনের ছাউনি দিয়ে থাকতেন। সামন্য বৃষ্টি হলে বেড়ার ফাঁক দিয়ে পানি ঢুকতো। ঘর বানানোর কোন সামর্থ্য ছিলো না তার।
রাস্তার ধারে বসবাসই যখন নিয়তি ভাবা শুরু করলেন তখন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আমিনুল ইসলাম ভূমি মন্ত্রনালয়ের গুচ্ছগ্রাম-২য় পর্যায় (সিভিআরপি) প্রকল্পের আওতায় সয়ারের কামার পাড়ায় নির্মাণ করা গুচ্ছগ্রামে তাকে একটি ঘর দেন। এখন সেই ঘরে থাকেন। তার মতো আরো ৩০টি পরিবারের ঠাঁই হয়েছে ওই গুচ্ছ গ্রামে। এ ছাড়া হাড়িয়ারকুঠি ইউনিয়নে ওই মন্ত্রণালয়ের অধীনে নির্মাণ করা হয়েছে উজিয়াল গুচ্ছগ্রাম। এটিতে আশ্রয় হয়েছে আরও ৩৫টি অসহায় ভূমিহীন পরিবারের।
গত সোমবার উজিয়াল গুচ্ছগ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গুচ্ছগ্রামটি যেন কোন এক নতুন শহর। সারি সারি রঙিন টিনের ঘর। প্রতিটি ঘরের পিছনে নির্মাণ করা হয়েছে শৌচাগার। সৌরবিদ্যুতের আলোর ঝলকানিও চোখে পড়ে। দেখে যেন মনে হয় পরিপাটি সাজানো ছবির মতো এক গুচ্ছগ্র্র্রাম। এসময় কথা হয় ফজিলা বেওয়া (৬৫) বছরের বৃদ্ধার সঙ্গে। তিনি জানান, তার স্বামী কপিল উদ্দিন ২০ বছর আগে মারা গেছে। তার ছেলে নেই। দুই মেয়ে থাকলেও নিজে ভাত পান না। অন্যের বাড়িতে কাজ করে অতি কষ্টে চলত তার জীবন। কোন জমি নেই। থাকতেন বড় মেয়ের বাড়িতে। ওই প্রকল্পে ঘর পাওয়ায় তিনি দারুন খুশি।
ফজিলা বেগম বলেন, এ্যালা নয়া ঘরোত মুই শান্তিতে ঘুমাইম। কখনো ভাবো নাই মুই এমতোন ঘর পাইম। শেখ সাবের বেটি হাসিনার আল্লাহ ভালো করুক। ডাক্তারপাড়া গ্রামের স্বামীহারা সফি খাতুনের (৫৫) চোখে মুখেও আনন্দের ঝিলিক। তিনিও ওই গুচ্ছগ্রামে নতুন ঘর পেয়েছেন। এক যুগ ধরে খড় ও পাটকাঠি দিয়ে তৈরী পুরোনো ভাঙ্গা ঘরে থাকতেন তিনি। তিনি বলেন, আগোত দ্যায়ার পানি আইলে মুই রাইতোত নিন পাইড়ার পাও নাই। ভাঙ্গা দিয়ে পানি ঢুকি গাও বিছনা ভিজি গেছলো। সারা রাইত চেতন আছুনু। এ্যালা দ্যায়ার পানি আইলেও মোর চিন্তা নাই। নয়া ঘরোত থাকোং। হাড়িয়ারকুঠি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হারুন-অর-রশিদ বাবুল বলেন, গুচ্ছগ্রাম দুটিতে আশ্রয় পাওয়া সবাই ভূমিহীন দিনমজুর , ভিক্ষুক। তাদের ঘর করার সামর্থ্য ছিলো না। ঘর পেয়ে দরিদ্র মানুষেরা খুব খুশি। এতে সরকার, ইউএনওর পাশাপাশি আমরাও প্রশংসিত হয়েছি।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবদুল মমিন বলেন, ২০১৯-২০২০ ইং অর্থবছরের ভ’মি মন্ত্রণালয়ের গুচ্ছগ্রাম দ্বিতীয় পর্যায় (সিভিআরপি) প্রকল্পের অধীনে দুটি গুচ্ছগ্রামে ৬৫টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। ঘরগুলোর সাথে বারান্দা, রান্নাঘর, নলকুপ ও শৌচাগার নির্মাণ করতে ব্যয় হয়েছে ৯৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা, ২২৫মেট্রিক টন চাল। গুচ্ছগ্রাম দুটিতে রয়েছে সৌরবিদ্যুতের সুবিধাও বিদ্যুৎ-সংযোগেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার আমিনুল ইসলাম বলেন, উপজেলার বৈধ্যনাথপুর একালাকায় আরো ২১২টি ঘর নির্মাণের কাজ চলছে।