জান্নাতুন লাকী:
দেশের বাতাসে দূষণ প্রতিদিনই বাড়ছে। রাজধানী ঢাকা হয়ে দাড়িয়েছে বিশ্বের অন্যতম দূষিত বায়ুর শহর। এই দূষণ রোধের লক্ষ্যে প্রয়োজন সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ এবং সাধারণ নাগরিকদের সচেতনতা।
‘ঢাকা শহরে বায়ুদূষণ: জনস্বাস্থ্য পরিপ্রেক্ষিত’ শিরোনামে গত ৭ ডিসেম্বর ইকসা আয়োজিত এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় আলোচকেরা এসব কথা বলেন। সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে ইকসা (ইনোভেটিভ অ্যান্ড কোঅর্ডিনেটেড স্যোশাল ডেভেলপমেন্ট) নামের এই সংগঠনটি। এই আলোচনা সভাটি ছিল ‘ইকসা ডায়ালগ’ এর ৬ষ্ঠ পর্ব।
ইকসার স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান সাইফুর রহমানের সঞ্চালনায় আলোচনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ব্রাক জেমস পি গ্রান্ড স্কুল অব ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং সেন্টার ফর নন-কমিউনিকেবল ডিজিস এন্ড নিউট্রিশনের ডিরেক্টর মলয় কান্তি মৃধা, ন্যাশনাল ইনিস্টিটিউট অব কার্ডিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আশরাফুল আলম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. সাখাওয়াত হোসেন। আলোচনায় ঢাকা শহর দূষণের কারণ, জনস্বাস্থ্যের উপর এর প্রভাব এবং প্রতিকারের বিষয়গুলো প্রাধান্য পায়।
মো. সাখাওয়াত হোসেন এর মতে, ডিজেল ও সিএনজি চালিত যানবাহন বায়ু দূষণের একটি বড় কারণ । তিনি ঢাকার আশেপাশের ইটভাটা ও নির্মাণ কাজের মাত্রাতিরিক্ত ধূলাকেও দূষণের জন্য দায়ী করেন। এছাড়াও প্রতিবেশি দেশ ভারত ও নেপালে শীতকালে প্রচুর কৃষি বর্জ্য পোড়ানোর জন্য বায়ু দূষিত হয় যা বাতাসের মাধ্যমে আমাদের দেশ তথা ঢাকায় প্রবেশ করে। এটিকেও তিনি বায়ু দূষণের জন্য দায়ী করেন।
শীতে আবহাওয়া শুষ্ক থাকে। এ সময় সবগুলো ইটের ভাটা চালু থাকে। কিন্তুবায়ু দূষণ রোধে যে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা সেগুলো নেওয়া হয় না। এসময় বাতাসের গতি কম থাকে তাই শহরের বায়ু বাইরে বের হতে পারে না। ফলে ধুলাবালি ও ক্ষতিকর পদার্থ শহরের মধ্যেই থাকে। শীতের এই সময়ে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কাজ বেশি হয়। ফলে বায়ুর প্রভাব এর ওপর পড়ছে।
ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর তথ্য অনুযায়ী বায়ু দূষণের জন্য বাংলাদেশে গড়ে প্রায় ৭ বছর মানুষের আয়ু কমে যাচ্ছে। বায়ু দূষণের জন্য বিশেষ করে পিএম ২.৫ এর জন্য প্রতি বছর সারাবিশ্বে গড়ে ৭-৮ মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করছে। শুধু বাংলাদেশে এর পরিমাণ প্রায় পৌনে দুই লক্ষ। বায়ু দূষণের প্রতিকার হিসেবে দূষণের সাথে জড়িত প্রতিটা সেক্টর যথা যানবাহন, শিল্পকারখানা, নির্মানকাজ যথাযতভাবে মনিটরিং করা প্রয়োজন।
আমরা পানি ছাড়া একদিন/দুইদিন বাঁচতে পারবো কিন্তু বায়ু ছাড়া এক মুহূর্তও বাঁচা সম্ভব নয়। একজন মানুষ প্রতিদিন গড়ে ২০ কেজি বাতাস গ্রহণ করে। এই ২০ কেজি বাতাস গ্রহণের সময় দূষিত পদার্থ আমাদের শরীরের ভিতর প্রবেশ করছে এবং আমরা বিভিন্ন প্রকার রোগে আক্রান্ত হচ্ছি। যার ফলে অকাল মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কীভাবে ইনডোর এবং আউটডোরে বায়ু দূষিত হচ্ছে এবং তা জনস্বাস্থ্যে কীরুপ প্রভাব ফেলছে এবং দূষণ রোধে আমাদের করণীয়গুলো কী হতে পারে সে সম্পর্কে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো সামনে নিয়ে আসাই ছিল এ আলোচনার উদ্দেশ্য।
অধ্যাপক মলয় কান্তি মৃধা বায়ু দূষণ রোধ করতে সবাইকে এক সাথে কাজ করা এবং ঘরের মধ্যে যে বায়ু দূষণ হচ্ছে সেগুলো রোধ করার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। তিনি ক্লিন ফুয়েল ব্যবহার, যানবাহনের আইনগুলো যথাযথ প্রয়োগ, ইটভাটা এবং শিল্প কারখানাগুলোকে শহরের বাইরে স্থাপনের মাধ্যমে বায়ু দূষণ রোধ করা যায় বলে উল্লেখ করেন। বায়ু দূষণের সোর্সসমূহ উল্লেখ করতে গিয়ে অন্যান্য কারণের সাথে তিনি রান্নার কাজে ব্যবহৃত জ্বালানী যেমন কাঠ, গোবরের ঘুটি, কাগজ প্রভৃতিকেও দায়ী করেন।
বাংলাদেশে রান্নার কাজে ৭৬ শতাংশ সলিড বায়োম্যাস ফুয়েল ব্যবহৃত হয়। বায়ু দূষণ রোধ করতে তা ৫০ শতাংশে নিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে রান্নার কাজে ক্লিন ফুয়েল তথা বিদ্যুৎ, এলপি গ্যাস ব্যবহার করতে হবে।
বায়ু আমাদের শ্বাস প্রশ্বাসের সাথে জড়িত। শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে দূষিত বায়ু আমাদের শরীরে প্রবেশ করে এবং দীর্ঘকালীন শ্বাস কষ্ট ও ফুসফুসের ক্যানসার হয়। এছাড়াও ডায়বেটিকস এর সাথেও বায়ু দূষণের সম্পৃক্ততা আছে। এমনকি কোভিড-১৯ এর সাথেও বায়ু দূষণের সম্পৃক্ততা আছে। যে সব অঞ্চলে বায়ু দূষণের মাত্রা বেশি সে সব অঞ্চলে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জটিলতাগুলো বেশি।
সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলসের বায়ু দূষণ সংক্রান্ত দু’টি ইন্ডিকেটর রয়েছে। একটি হলো বায়ু দূষণ সংক্রান্ত মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা এবং অন্যটি হলো শহরগুলোতে পিএম ২.৫ দিয়ে যে দূষণগুলো হচ্ছে তার মাত্রা কমিয়ে আনা।
পৃথিবীতে বায়ু দুষণের জন্য যত মানুষ মারা যায় তার প্রায় অর্ধেকের জন্য দায়ী হলো ঘরের ভেতরের বায়ু দূষণ। একজন মানুষ ৯০ শতাংশ সময় ইনডোর পরিবেশ তথা বাড়ি, অফিস, শপিংমল ইত্যাদি জায়গায় থাকে। বাকি ১০ শতাংশ সময় আউটডোর পরিবেশে থাকে। তাই আমাদেরকে আউটডোর বায়ু দূষণ রোধ করার সাথে ইনডোর বায়ু দূষণকেও সমানভাবে বিবেচনা করতে হবে।
ঘরের মধ্যে বায়ু দূষণ কমিয়ে আনতে আমাদের কয়েলের পরিবর্তে মশারী অথবা বিকল্প কিছু ভাবতে হবে, সলিড বায়োম্যাস ফুয়েল পরিহার করতে হবে। রান্নার সময় যতটা সম্ভব দরজা জানালা খোলা রাখতে হবে।
কার্ডিওলজিস্ট আশরাফুল আলম বাংলাদেশে আকস্মিক মৃত্যুর জন্য ধুমপান একটি বড় নিয়ামক বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বায়ু দূষণের জন্য হার্ট অ্যাটাক, ব্রেন স্ট্রোক, শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া, ক্রনিক অ্যাজমা, ব্রংক্রাইটিস হয়। ছোট বাচ্চারা যদি বায়ু দূষণের মধ্যে থাকে তাহলে তাদের ফুসফুসে সংক্রমণ হতে পারে এমনকি অ্যাজমাও হতে পারে।
আমরা যে কয়েল ব্যবহার করি তার ধোঁয়া, সিএফসি, অ্যারোসল আমাদের কার্ডিওভাসকুলার সিস্টেমের জন্য ক্ষতিকর। তাই আমরা যদি এই জিনিসগুলো এড়িয়ে চলতে পারি এবং সচেতন হই তাহলে আমরা কার্ডিওভাসকুলার হেল্থ সংক্রান্ত যে রোগগুলো আছে সেগুলো কমিয়ে আনতে পারবো।
বায়ু দূষণ রোধ করতে পরিবেশ সংক্রান্ত আইনগুলো যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে, যানবাহনে পরিবেশ বান্ধব জ্বালানী ব্যবহার করতে হবে, শহরের আশেপাশের ইট ভাটাগুলো বন্ধ করে দিতে হবে, সম্ভব হলে ঘরের ভিতর এয়ার পিউরিফায়ার ব্যবহার করতে হবে। সর্বোপরি আমাদের স্মার্ট শহর গঠন করতে হবে। উদাহরণ হিসেবে হংকংয়ে চলাচলের ক্ষেত্রে স্মার্ট অ্যাপের মাধ্যমে জানা যায় কোন রাস্তায় বেশি বায়ু দূষণ আর কোন রাস্তায় কম। অধিক দূষণের রাস্তায় গেলে স্বাস্থ্যের উপর কী ধরনের প্রভাব পরতে পারে তাও বলে দিবে স্মার্ট অ্যাপ। অ্যাপ বলে দেয় কোন জায়গাগুলো এড়িয়ে চলতে হবে। এখন সম্ভব না হলেও অদূর ভবিষ্যতে আমাদের ঢাকাও হয়ে উঠতে পারে স্মার্ট শহর। আমরাও ব্যবহার করতে পারি এধরনের স্মার্ট অ্যাপ।
বায়ু দূষণ আস্তে আস্তে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে। বায়ু দূষণ থেকে বাঁচতে হলে কোন কোন সোর্স থেকে বায়ু দুষণ হচ্ছে তা খুঁজে বের করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ হিসেবে বায়ু দূষণ থেকে বাঁচতে আমাদেরকে বাইরে বের হলে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। উদাহরণ হিসেবে ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়ার মতো দেশ গুলো বায়ু দূষণ থেকে বাঁচতে আগে থেকেই মাস্ক ব্যবহার করতো যা তাদেরকে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ কমাতে অনেকটা সাহায্য করেছে।
সবচেয়ে বড় বিষয় মানুষকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। মানুষ সাধারণত বিশ্বাসই করতে চায় না সারাবিশ্বে ৭-৮ মিলিয়ন মানুষ বায়ু দূষণের জন্য মারা যায়। মানুষকে এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে ভালোভাবে বোঝাতে হবে। এ ক্ষেত্রে মিডিয়া মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে।
এছাড়াও একজন স্বাস্থ্য কর্মীর কাছে কোন শ্বাস কষ্টের চিকিৎসার জন্য গেলে অন্যান্য নিয়ামকের সাথে বায়ু দূষণও যে একটা কারণ সেই পরামর্শ দিতে পারে। এই দূষণের ফলে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে সাধারণ জনগণ তথা ঢাকাবাসী।
কার্ডিওভাস্কুলার রিসার্চ জার্নালের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে সারাবিশ্বে যুদ্ধ এবং অন্যান্য কারণে যত মানুষ মারা যায় তার চেয়ে ১০ গুণ বেশি মানুষ মারা যায় বায়ু দূষণের কারণে। বাংলাদেশে যে পরিমাণ মানুষ প্রতিবছর মৃত্যুবরণ করেন তার এক চতুর্থাংশের মৃত্যুর জন্য দায়ী বায়ু দূষণ।
বায়ু দূষণ কমাতে হলে আমাদেরকে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে, পরিবেশ বিষয়ক আইনগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে, শহরের ভিতরে ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে তথা বিআরটিএ আইন যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে, গণমাধ্যমকে বায়ু দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় সাধারণ মানুষকে জানাতে হবে এবং সচেতন করে তুলতে হবে, একইসাথে পলিসি মেকারদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে। সর্বোপরি বায়ু দুষণ রোধ করতে এবং মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে রাষ্ট্রকেই গুরু দায়িত্ব পালন করতে হবে।
বায়ু দূষণ রোধ অসম্ভব কিছু নয়। পরিকল্পিত নগরায়ন ও সচেতনতা বৃদ্ধি পেলে সময়ের সাথে ঢাকা হয়ে উঠবে ক্লিন স্মার্ট নগরী। আধুনিক বিশ্বের স্রোতধারা আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাবে। প্রয়োজন শুধু সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও সমন্বিত কাজ।
শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
ডেপুটি ম্যানেজার, কনটেন্ট ডেভেলপমেন্ট টিম, ইকসা।