সরিষা ফুলে ফুলে মৌমাছির গুঞ্জন

আমাদের প্রতিদিন
2024-03-28 08:31:04

দিনাজপুর প্রতিনিধি:

এই কুয়াশা ভরা শীতে নানা ধরনের ফুল ও ফলের দেখা মেলে। এ সময়ে মাঠে মাঠে শোভা ছড়ায় সরিষা ফুল। এখন দিনাজপুরসহ উত্তরাঞ্চলে সরিষার ক্ষেতজুড়ে হলুদের সমারোহ। এ ফুলের নান্দনিক সৌন্দর্য শোভা বাড়িয়েছে প্রকৃতিতে। আর মাঠের পর মাঠ সরিষার ফুলের রাজ্যে মৌমাছির গুঞ্জনে ভরে আছে। ফুলে ফুলে মৌ মৌ গন্ধ। আর এই গন্ধে মৌমাছিরা এক ফুল থেকে অন্য ফুল ঘুরে বেরিয়ে সংগ্রহ করছে মধু। সুস্বাদু, মিষ্টি ও লোভনীয় এ মধু মৌমাছির মাধ্যমে আহরণ করছেন মৌ-চাষিরা। সরিষার ফুল থেকে মৌমাছি মধু আহরণের ফলে সরিষার ফুলে ফুলে যেভাবে পরাগায়ন হয়, তাতে শতকরা ২০-৩০ ভাগ বেশি ফলন হয় বলে কৃষি বিভাগ জানায়।

মধু সংগ্রহ করে লাভবান হচ্ছেন মৌ-চাষিরা, অন্যদিকে মৌমাছির মাধ্যমে ফুলে ফুলে পরাগায়ন ঘটায় সরিষার বাম্পার ফলনের আশা করছেন কৃষক। তাই সরিষা ক্ষেতে কৃষক ও মৌ-চাষি উভয়ই লাভবান হচ্ছেন। অপরদিকে মধু উৎপাদন বাড়ার পাশাপাশি বেকারত্ব দূর হচ্ছে। মৌমাছি সরিষা থেকে মধু সংগ্রহ শেষ হলে আবার লিচু থেকে মধু সংগ্রহ করবে মৌ-খামারিরা।

সরিষা, কালোজিরা, লিচু, ধনিয়া, খেসারি, মিষ্টি কুমড়া থেকে নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত টানা মধু উৎপাদন মৌসুম শুরু হয়েছে। সরিষার মধু যেমন খাটি, তেমনি সুস্বাদু। মানের দিক থেকেও উন্নত হওয়ায় চাহিদাও বেশি। মধু উচ্চমাত্রার প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিক হওয়ায় ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির কাছেও। চলতি সরিষা চাষ মৌসুমে দিনাজপুর জেলায় কমপক্ষে ১০ মেট্রিক টন মধু সংগ্রহ হবে, যার বাজার মূল্য ৩০-৫০ লাখ টাকা।

দিনাজপুরে ভোজ্যতেলের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের পরামর্শে কৃষকরা তাদের ধানের জমির ফসল কাটা-মাড়াই করে বারি উদ্ভাবিত বারি-১৮ জাতসহ বারি-১৪, বারি-১৭, বারি-৯ ও বিএডিসি-১ জাতের সরিষা বীজ মাঠে বুনেছেন। ধান বা অন্য ফসলের তুলনায় লাভজনক হওয়ায় কৃষকরা দিন দিন সরিষা চাষে ঝুঁকছেন।

খানসামার আলোকঝারী ইউপির কৃষক ওসমান আলী জানান, প্রতিবিঘা জমিতে সরিষা চাষে খরচ হয় সর্বোচ্চ ৪-৫ হাজার টাকা। প্রতি মণ সরিষা বিক্রি করা যায় ৩-৪ হাজার টাকা করে। প্রতি বিঘাতে ৭-৮ মণ সরিষা উৎপাদন হলে বিঘা প্রতি ১০-১২ হাজার টাকা লাভ করা যায়। এছাড়া সরিষা চাষে তেমন সেচের প্রয়োজন হয় না। মাত্র দুই মাস সময়ে সরিষা চাষ করা যায়। আশা করা যায় এবারও বাম্পার ফলন হবে।

এদিকে, বেকারত্ব দূর করতে মৌ-খামার স্থাপনে তরুণদের উৎসাহিত করতে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দিয়েছে একটি যুব সংগঠনের সফল উদ্যোক্তা ও স্বাবলম্বী খামারি মোসাদ্দেক হোসেন। মাস্টার্স পাশ করে চাকরির পেছনে না ছুটে মৌ-খামার গড়ে মধু উৎপাদনে ব্যাপক সফলতা অর্জন করে ‘আলোর পথে জাগো যুব’ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সভাপতি মোসাদ্দেক হোসেন। চলতি সরিষা চাষের মৌসুমে ১৫০ মৌবাক্স নিয়ে ২ টন মধু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন তিনি। তিনি জেলার বাইরেও মধু সংগ্রহ শেষে দিনাজপুরের হিলির মঙ্গলা এলাকায় সরিষা ক্ষেতে বাক্স বসিয়েছেন।

উত্তরবঙ্গ মৌ-চাষি সমিতির সদস্য মোসাদ্দেক হোসেন আরও জানান, কাঠের বাক্সে তিন ধরনের মৌমাছি থাকে মৌচাকে। রানী, পুরুষ আর শ্রমিক মাছি। কাঠের বাক্সে ৮ থেকে ১০টি মৌচাক থাকে। প্রতি চাকে রানীর সংখ্যা একটি। প্রতি সপ্তাহে বাক্স থেকে মধু আহরণ করা যায়। মৌসুমে একটি বাক্সসহ বিভিন্ন খরচ হয় মোট ৩ হাজার টাকা। এরপরেও কেউ আন্তরিকতা, ধৈর্য্য নিয়ে পুঁজি বিনিয়োগ করলে লাভ হবেই।

তিনি আরও জানান, ফুলের মধ্যে এক প্রকার মিষ্টি তরল পদার্থ থাকে, যার নাম নেক্টার। মৌমাছিরা ফুল থেকে এ নেক্টার প্রথমে নিজেরা পান করে এবং তাদের দেহের মধু থলিতে করে বাক্সের মৌচাকে নিয়ে যায়। মৌচাকে আনার পর ফুলের নেক্টারে যে চিনি বা শর্করা থাকে তা বিক্রিয়া শুরু করে। ফলে এর ভেতর যে পানি থাকে তা বাষ্প হয়ে উড়ে যায়। আর তখনই মধুতে পরিণত হয়। মধুতে রয়েছে সেলুলোজ, ডেক্সট্রোজ, মন্টোজ, এনজাইম, ভিটামিন ও নানা খনিজ পদার্থ। যে কারণেই মৌচাকের মধু অনেকদিন পর্যন্ত ভালো থাকে।