সাঁতাও:তিস্তা পাড়ের কড়চা

আমাদের প্রতিদিন
2024-04-18 12:06:34

বিনোদন প্রতিবেদক:

এক অর্থে বাংলাদেশের গল্প মূলত নদীর গল্পই; জীবন্ত, প্রাণবন্ত, প্রবাহমান। কিন্তু, নানা কারণে নদী আর স্বাভাবিক গতিশীল নেই, বাঁধ দিয়ে নদীকে মেরে ফেলা হয়েছে, হচ্ছে প্রতিনিয়ত। যেমন তিস্তা, প্রমত্তা তিস্তা অন্তত বাংলাদেশ অংশে এখন এক প্রকার মৃত নদীই। ৪১৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের তিস্তা নদীর বাংলাদেশের অংশ ১২১ কিলোমিটার, যদিও তিস্তার অববাহিকার বাসিন্দাদের ৭০ শতাংশের বেশির বাস বাংলাদেশ অংশে। তিস্তার ভারত অংশে বিদ্যমান এবং নির্মাণাধীন বাঁধের সংখ্যা ২০ টি। এই বাঁধ সমূহের ফলে তিস্তার স্বাভাবিক প্রবাহ মৃতপ্রায়; একদা জীবনদায়ী তিস্তা এখন ভাটির বাংলাদেশকে দু’ধারী তলোয়ারের মতই কাটে- শুষ্ক ও সেঁচের মৌসুমে খরায় এবং বর্ষায় অতিবন্যায়।  তিস্তার জলের অন্যায্য বণ্টনের শিকার এমন এক হতভাগ্য জনপদের গল্প আমাদের বলেন খন্দকার সুমন তার সাঁতাও চলচ্চিত্রে।

সাঁতাও পরিচালকের প্রথম চলচ্চিত্র, কিন্তু নির্মাণ পরিণত এবং তাতে পরিমিতির ছাপ স্পষ্ট। তিস্তার অববাহিকায় বাস করা এক কৃষিজীবী পরিবার, ফজলু ও পুতুল দম্পতির গল্প বলে সাঁতাও। গল্পের শুরুতে আনন্দমুখর এক জনপদের ছবি আঁকেন পরিচালক ভরা নদীতে নৌকাবাইচ প্রতিযোগীতার মাধ্যমে যেখানে পাঁচ গ্রামের মানুষ একত্র হয়। ক্রমে নদী শুকোতে থাকে, সমান্তরালে দুর্দশাও বাড়তে থাকে। সদ্য বিবাহিত ফজলু তার সমস্ত সঞ্চয় দিয়ে একটি গাভি কেনে। গাভি এবং ফজলুর স্ত্রী পুতুল প্রায় একসাথেই পোয়াতি হয়। বিয়ানোরকালে বাচ্চা লালু বেঁচে গেলেও মৃত্যু হয় গাভির। অন্যদিকে প্রসবকালীন জটিলতায় পুতুলের বাচ্চা মারা যায়। নিঃসন্তান পুতুল আর মাতৃহীন লালুর মাঝে অদ্ভুদ মায়াময় মা-সন্তান সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

পর্যায়ক্রমে খরা, বন্যায় ফসল নষ্ট হওয়া, পুতুলের চিকিৎসার জন্য এনজিও থেকে লোন নিতে বাধ্য হওয়া, এবং লোন পরিশোধে ব্যর্থ হলে পুতুলের সন্তানসম লালুকে বিক্রি করা আবার লালুকে ফিরে পেতে একমাত্র ‘ভূমি’মহাজনের কাছে বন্ধক রাখতে বাধ্য হয় ফজলু। যার কারণে কৃষক ফজলুর ঢাকায় এসে রিকশা চালনা  পেশা বেছে  নেয়া ছাড়া উপায় থাকে না। যদিও বন্ধকী ভূমি ছাড়িয়ে কোন একদিন আবারো সোনাশস্য ফলানোর স্বপ্ন লালন করে ফজলু। এই ধরণের গল্প বয়ান অনেক ক্ষেত্রেই ক্লিশে, মেলোড্রামাটিক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আনন্দের বিষয় হল সাঁতাও-এর ক্ষেত্রে পরিচালক এইসব ফাঁদ এড়াতে পেরেছেন প্রশংসনীয় পরিমিতিবোধে।

গল্পে কিছু জরুরি বিষয়ে আলোকপাত করেছেন পরিচালক, যেমন পানি বন্টন। তিস্তার কথা তো আগেই উল্লেখ করেছি, কিন্তু সেচের পানির বন্টন (এবং সম্পদের বন্টনও) মূলত ক্ষমতার দ্বারা নির্ধারিত। ধনী কৃষক কিংবা মহাজন দরিদ্র ক্ষমতাহীন কৃষককে বঞ্চিত করে, যেমন ক্ষমতাশালী দেশ করে ক্ষমতাহীন দেশকে। অথবা রানা প্লাজার মত ঘটনা যেখানে গ্রাম থেকে কাজের সন্ধানে মেট্রোপলিটনে ছোটা মানুষগুলো অর্থগৃধ্নু পুঁজিশালীদের অনিশেষ লোভের শিকার হয়ে  কেমন সারি সারি কফিন ভর্তি লাশ হয়ে ফিরে আসে আপন বাসভূমে। এই বিষয়গুলো উচ্চকিত এবং উত্তেজিত না হয়ে শান্ত নির্লিপ্ত ঢংয়ে নির্মাতা তাঁর গল্পে সফলভাবে প্রবিষ্ট করাতে পেরেছেন।

গল্পের ন্যারেটিভেও খানিকটা এক্সপেরিমেন্টাল ছিলেন পরিচালক, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ডকুফিকশনের টেকনিক ব্যবহার করেছেন। অনেকগুলো এনভায়েরমেন্টাল শট, যতটা না গল্প ও চরিত্রের প্রয়োজনে তার চেয়ে বেশি সচেতন বক্তব্যের খাতিরেই ব্যবহৃত হয়েছে (তিস্তার ব্যারেজের এপার ওপার ড্রোন শট, ব্যারেজের গেট খুলে দেয়া, মাছধরা ইত্যাদি) এবং তা বেশ সুপ্রযুক্তই বলতে হবে। অবশ্য কিছু কিছু জায়গায় আরও খানিকটা পরিমিত এবং রেশনাল হওয়ার সুযোগ ছিল। যেমন কোরবানির ঈদে ঢাকার বাজারে বিক্রি হওয়া লালুকে খুঁজে ক্রেতার কাছ থেকে ফিরিয়ে আনার বিষয়গুলো আরও যৌক্তিকভাবে উপস্থাপন করা যেত। গানের ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরও পরিমিতি দেখানো যেত।

সাঁতাও-এ ক্যামেরা ব্যবহার পরিণত, প্রায়শ তা চরিত্রের ইমোশনকে অনুসরণ করেছে। সম্পাদনাও মোটের উপর মসৃণ। ফজলুল হক এবং আইনুন পুতুল প্রশংসনীয় অভিনয় করেছেন। চিত্রনাট্যে ভিজুয়ালি গল্প বলার চেষ্টা লক্ষ্যণীয়। সব মিলিয়ে সাঁতাও একটি পরিশ্রমী স্বার্থক নির্মাণ। খন্দকার সুমন গণ অর্থায়নে এই ছবিটি নির্মাণ করেছেন, ফলে তার দায়বদ্ধতার জায়গাও বেশি- এই ক্ষেত্রে উনি খুব ভালোভাবেই উৎরে গেছেন। বিগত বেশ কিছুদিন ধরে বাংলা চলচ্চিত্রে একটা নব জোয়ার লক্ষ্য করা যাচ্ছে- আমাদের নির্মাতাগণ বাংলাদেশের প্রাণ প্রকৃতির সাথে মানানসই স্বতন্ত্র ভাষার সন্ধান করছেন -সাঁতাও এই তালিকায় একটি  গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হয়ে থাকবে। চলচ্চিত্রটি দর্শকনন্দিত  হোক।