কুড়িগ্রামে চরাঞ্চলের ২৯২ জন গৃহহীন পেয়েছে সরকারি ঘর

আমাদের প্রতিদিন
2024-04-23 15:32:10

আল্লাহ্ হামারগুলার দিকে মুখ চায়া দেখছে- খাই না খাই এ্যালা শান্তিতে ঘুমাই

আহসান হাবীব নীলু, কুড়িগ্রাম:

‘ভাঙগা চুড়া ঘরের মধ্যে আছলং। একনাঝড়ি(বৃষ্টিতে) আসলেকাপড় চোপড় সব ভিজি যায়। খুব কষ্ট করি এবার শীতও পার করলোং। সেখের বেটি প্রধানমন্ত্রী হাসিনার জন্য বিনা পয়সায় সরকারি ঘর পাইছি। এ্যালা আর কষ্ট নাই থাকার। আল্লাহ্ হামারগুলার দিকে মুখ চায়া দেখছে। খাই না খাই শান্তিতে ঘুমাই।’চিলমারীর  শাখাহাতি চরের বাসিন্দা লতিফা বেগম আশ্রয়ন-০২ প্রকল্পের আওতায় চর ডিজাইন ঘর পেয়ে এসব অনুভোতির কথা জানান। বর্ননা করেন আগের নানা কষ্টের কথা। অবর্ণনীয় দু:খ কষ্টের কথা গুলো শুনলে অজান্তেই চোখ ভিজে যায়। দেশ যখন উন্নয়নের মহা সড়কে তখন প্রত্যন্ত চরাঞ্চলের মনুষগুলো সকল আধুনিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত।

কুড়িগ্রামের নদ-নদীময় চরের নদী ভাঙ্গনের স্বীকার গৃহহীন মানুষের জন্য মুজিব বর্ষে বাস্তবায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন করেছেন আশ্রয়ন-০২ প্রকল্পের আওতায় চর ডিজাইন ঘর। ফলে জেলার চরাঞ্চলের নদী ভাঙ্গনে নি:স্ব গৃহহীন ২৯২ পরিবার নতুন ঘর পেয়ে আনন্দে আত্নহারা। স্থানান্তরিত করা যায় এমন ডিজাইনের ঘর পেয়ে খুশি চরাঞ্চলবাসী।

সরেজমিন ঘুরে জানাযায় মানুষের নানা সুখ দুঃখের গল্প। কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী উপজেলার সদর ইউনিয়নের শাখাহাতি চরে দু:স্থ প্রতিবন্ধী লতিফা বেগম। দরিদ্র বোনের সংসারে বসবাস তার। দরিদ্র পরিবারে থাকার জায়গার সংকটের কারণে শীত-বর্ষা হাজারো কষ্ট করে দিন কেটেছে লতিফার। খাবারের কষ্টের পাশাপাশি থাকার সংকটও ছিল তার।

এমন করুণ চিত্র একই এলাকার বিধবা মরিয়ম বেওয়া(৫০)।স্বামী মারা গেছে প্রায় দশ বছর আগে আর গত বছর ছেলে মারা যায় অসুস্থতার কারণে। এরমধ্যে গতবছর আগুন লেগে বসত বাড়ি পোড়া যায়। কিছুই রক্ষা করতে পারেনি। ফলে খোলা আকাশের নিচে দিন-রাত কেটেছে মরিয়ম বেওয়ার। ঝড় বৃষ্টিতে মানুষের বাড়িতেই আশ্রয় জুটলেও নিজের থাকার স্থায়ী কোন বন্দোবস্ত ছিল না। প্রতিবেশি বিধবা বিজলী বেওয়া(৪৫) অবস্থা একই। আগুনে পুড়ে ঘরবাড়ি হারিয়ে খেয়ে না খেয়ে বৃদ্ধ মা এবং একমাত্র সন্তানকে নিয়ে কষ্টে দিন কেটেছে। স্বামী মারা যাবার প্রায় ১৭বছর হয়ে গেলে। সেই থেকে জীবন যুদ্ধে কাটছে দিন বিজলী বেওয়ার। ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলের লতিফা,মরিয়ম বেওয়া,বিজলী বেওয়ার মতো শতশত ভূমিহীন কিংবা দরিদ্র শতশত পরিবার সরকারের চর ডিজাইন ঘর পেয়ে এখন দিন কাটছে নিশ্চিতে।

মরিয়ম বেওয়া বলেন,স্বামী-সন্তান হারিয়ে দিশেহারা হয়ে দিন কেটেছে। এরমধ্যে আগুনে পুড়ে একমাত্র থাকার ঘরটি শেষ হয়ে যায়। ঝড়-বৃষ্টি আর শীতের মধ্যে মানুষের বাড়িতে আশ্রিত হয়ে থাকতে হয়েছে। সরকারের এই ঘর পেয়ে এলা খাই না খাই অনন্ত রাতে নিশ্চিত ঘুমাতে পারছি।

বিজলী বেওয়া বলেন,চরের মধ্যে থাকা-খাওয়ার কষ্ট শুধু চরের মানুষই বোঝে। মা আর সন্তান নিয়ে কি যে দুর্ভোগ কেটেছে তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। বিনামূল্যে ঘর পেয়ে এখন সন্তানের পড়ালেখার সমস্যা নেই। বৃদ্ধ মাকে নিয়ে রাতে ঘুমাতেও সমস্যা নেই।

স্থানীয় বাসিন্দা মকবুল হোসেন বলেন মেঝে পাকা সম্বলিত চৌয়ারি টিনশেড ঘরটি ভবিষ্যতে নদী ভাঙ্গনের মুখে পড়লে নাট-বল্টু খুলে অনায়সে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া যাবে। চরাঞ্চল উপযোগি এই ঘর গুলো এই অঞ্চলের জন্য বেশ উপকারি।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানাযায়,"মুজিববর্ষে বাংলাদেশের এক জন মানুষও গৃহহীন থাকবে না"প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণায় দেশের বৃহৎ চরাঞ্চল যুক্ত জেলা কুড়িগ্রাম ছিল উপেক্ষিত। চরের বালুময় জমিতে সেমি পাকা ঘর নির্মাণ প্রায় অসম্ভব। ফলে বৃহৎ চরাঞ্চলের গৃহহীনদের আবাসন নিশ্চিত করতে চর ডিজাইনের প্রাথমিক ধারণার প্রস্তাব উত্থাপন করেচিলমারী উপজেলা প্রশাসন। কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক টাস্কফোর্স থেকে প্রাথমিক ডিজাইন প্রস্তুত করে এলজিইডির কেন্দ্রীয় ডিজাইন ইউনিট থেকে এর চূড়ান্ত ডিজাইন প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নেয়া হয়।

জেলার ১৬টি নদ-নদীতে প্রায় সাড়ে ৫শতাধিক চরাঞ্চলে ৭/৮লাখ মানুষের বসবাস। চর ডিজাইন বাস্তবায়নের কারণে নদী ভাঙ্গন আর আগুনে পুড়ে নি:স্ব হওয়া পরিবারের গৃহ নিশ্চিত করছে স্থানীয় প্রশাসন। প্রায় দু লাখ ৩৩হাজার টাকা বরাদ্দকৃত দৈর্ঘ্য-সাড়ে ১০ফিট এবং প্রস্থ-১৯ফিট ৬ইঞ্চি আয়তনের চর ডিজাইনের ঘরে রয়েছে ২১টি আরসিসি প্রিক্যাস্ট পিলার। মেঝে পাকাসহ টিনের শেড ও ব্যাড়া এবং টিনের সিলিং যুক্ত এই ঘরে রয়েছে দু’টি শয়ন কক্ষ,রান্না ঘর,ল্যাট্রিন, ৪টি জানালা ও একটি বারান্দা। ঘর গুলো পিলারের সাথে নাট বল্টু দিয়ে সংযুক্তটিন,পিলার,ইটগুলো সহজেই আলাদা ভাবে খুলে ফেলা যায়। ফলে নদী ভাঙ্গনের মুখে পড়লে খুব সহজেই অন্যত্র স্থানান্তর ও পুন: স্থাপন করতে পারবে সুবিধাভোগীগণ।

গতবছরের ৫ ফেব্রুয়ারি  প্রধানমন্ত্রী আশ্রয়ন-০২ প্রকল্পের আওতায় এই চরাঞ্চলের ডিজাইনের নকশা ও বাজেট অনুমোদন করেন এবং ওই বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রকল্প কার্যালয় থেকে চরাঞ্চলের গৃহ “ক” তালিকাভুক্ত পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়।

প্রথম ধাপে কুড়িগ্রাম,রংপুর,গাইবান্ধা জেলার ১৪টি উপজেলায় মোট এক হাজার ৪২টি পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়। এরমধ্যে কুড়িগ্রামের জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে ৭টি উপজেলা যথা কুড়িগ্রাম সদরে-২০টি, নাগেশ্বরীতে-২০টি,রাজারহাটে-৪৭টি,উলিপুরে-১১০টি,চিলমারীতে-১৫০টি,চররাজিবপুরে-৩০টি এবং রৌমারী উপজেলায়-১৫টি চর ডিজাইনের ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়।

চিলমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহাবুবুর রহমান বলেন,সরকারের ভিশন বাস্তবায়নের জন্য চরাঞ্চলবাসী এই সুবিধার আওতায় আনতে চর ডিজাইন প্রাথমিক উদ্যোগ নেয়া হয়। পরবির্ততে জেলা প্রশাসক প্রাথমিক অনুমোদনের পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই চর ডিজাইন প্রকল্পটি অনুমোদন দেন। এতে করে সমতল জনপদের পাশাপাশি চরের গৃহহীন পরিবারের বাসস্থান শতভাগ নিশ্চিত হচ্ছে।