কুড়িগ্রামে ক্রমেই বাড়ছে বয়স্ক শ্রমিকের সংখ্যা

আমাদের প্রতিদিন
2024-04-18 06:01:37

আহসান হাবীব নীলু,কুড়িগ্রামঃ

নদী ভাঙ্গন,পারিবারিক সম্পর্ক ছিন্ন,বাল্যবিয়ের পর বিবাহ বিচ্ছেদ এবং দারিদ্রতার কারণে কুড়িগ্রাম জেলায় বেড়েছে বয়স্ক শ্রমিকের সংখ্যা। ফলে তারা খাদ্য নিরাপত্তা এবং আবাসন সংকটে পরেছে। সরকার-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে এসব মানুষের অন্ন,বস্ত্র, চিকিৎসা এবং বাসস্থানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এখনই বিশেষ উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানান কুড়িগ্রাম প্রবীণ হিতৈষী সংঘের সভাপতি এ কে এম সামিউল হক নান্টু। তিনি বলেন, দেশের সিনিয়র সিটিজেনটের সকল দায়দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে।

জীবনের শেষ শায়ান্নে যেখানে বিশ্রাম নেবার কথা সেখানে পরিবারের অবজ্ঞা এবং সরকারের সুবিধা না পেয়ে জীবন যুদ্ধে নামতে বাধ্য হচ্ছেন জেলার শতশত বয়স্ক মানুষ। বয়সের দিকে নজর না দিয়ে শুধু জীবিকার তাগিদে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। শ্রম অনুযায়ী মজুরির বৈষম্যের স্বীকার নিত্য দিনের সঙ্গি বয়স্ক শ্রমিকের।দারিদ্রতার কষাঘাত আর বাজারের উর্দ্ধমুখির কারণে মজুরির টাকা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন দারিদ্রতার শীর্ষে থাকা এই অঞ্চলের মানুষের। বয়সের ভারে নুহ্য হয়ে পড়লেও সংসারে বোঝা না  হতে অনেকেই কাজ করছেন। এছাড়াও জেলার বাল্যবিয়ে পরবর্তি কালে বিবাহ বিচ্ছেদের কারণে মেয়েসহ তার সন্তান নিয়ে পরিবারের মাঝে ফিরে আসায় চাপ বাড়ছে পিতা-মাতার উপর। ফলে পেট বাঁচাতে বৃদ্ধ বয়সেও কাজে যাচ্ছেন। পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেশী হওয়ায়কর্তার উপর চাপ বেড়েছে।

জেলার উলিপুর উপজেলার পান্ডুল ইউনিয়নের তনুরাম গ্রামের শারিরিকভাবে পঙ্গু ৭৫বয়সী বৃদ্ধ অটোচালক খোকা মিয়া। উপজেলার মিনা বাজারে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছেন। প্রায় ১২০বছরের বৃদ্ধ মা ফুলজন বেওয়াসহ স্ত্রী,এক মেয়ে ও নাতীসহ তার সংসার। পরিবারের সদস্যদের ভরণ পোষণ যোগাড় করতে তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অটোরিক্সা চালান। পা চালিত রিক্সা দিয়ে এই পেশায় পদ চারণ ১৯৭৫সালে। যান্ত্রিক যুগে প্রেিযাগিতায় টিকে থাকতেপ্রায় ৩বছর আগে ঋণ করে একটি অটোরিক্সা কিনেন। এই ব্যাটারি চালিত রিক্সা দিয়ে দিনে ৫/৭শ টাকা আয় করে তা দিয়ে চলে বৃদ্ধ খোকা মিয়ার সংসার। কয়েক বছর আগে এক দূর্ঘটনায় বাম পায়ে আঘাত পেয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করলেও জীবন সংগ্রামে বেচে থাকার তাগিদে প্রতি মূহুর্তে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।

খোকা মিয়ার মতো একই অবস্থা জেলার সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের আরাজি পলাশবাড়ি গ্রামের আশি উর্ধ্ব দছিমুদ্দিনের।পাকিস্তান আমল থেকে প্রায় ৭০বছর ধরে তিনিও পা চালিত রিক্সা চালাচ্ছেন তিনি।যান্ত্রিক বাহনের যুগে এসেও অর্থভাবে এখনও পা চালিত রিক্সাই তার সম্বল। এই রিক্সা চালিয়ে স্বামী-স্ত্রীর পেট চলছে।এক ছেলে ও দু’ মেয়ের বিয়ে হবার পর থেকে আলাদা হয়ে গেছে। সন্তানরা নিজ নিজ সংসার নিয়ে ব্যস্ততায় বৃদ্ধ দম্পতির কেউ খোঁজ রাখে না। ফলে পা চালিত রিক্সা চালিয়ে দিনে একশ থেকে দেড়শ টাকা আয় হয়। তাই দিয়ে খেয়ে না খেয়ে দুই স্বামী-স্ত্রীর দিন কেটে যাচ্ছে। খোকা মিয়া আর দছিমুদ্দিনের মতো জেলার শতশত বয়স্ক শ্রমিকের জীবনের গল্প প্রায় একই। যে বয়সে বিশ্রাম আর নাতি-নাতনিদের নিয়ে হাসিখুশি দিন পার করার কথা সেখানে জীবিকার তাগিদে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে ব্যস্ত কাটছে তাদের দিন।

অটো চালক খোকা মিয়া বলেন,বয়স্ক ভাতা এবং অটো চালিয়ে যা আয় করি তা দিয়ে চলে সংসার। বৃদ্ধ দেখে আগের মতো আর যাত্রী আমার অটোতে ওঠেনা। এরপরও ৫/৭শ টাকা দিনে আয় হয় তা দিয়ে দিন চলে যায়। তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কুড়িগ্রাম-চিলমারীর মহাসড়কসহ জেলার বিভিন্ন প্রান্তে যাত্রী নিয়ে ছুটে চলেন।

রিক্সা চালক দছিমুদ্দিন বলেন,বাহে প্রায় ৬০/৭০বছর ধরে এই বাংলা রিক্সা চালাই। অটো রিক্সা হয়ে বুড়া মানুষের রিক্সায় আর কেউ চড়তে চায় না। আগে আয় ভালো থাকলেও এখন দিনে এক থেকে দেড়শ টাকা হয়। দুই বুড়া-বুড়ির সংসার চলে যায়। সন্তানরা বিয়া করি জুদা হয়া গেছে। হামাক আর দেখে না বলেও জানান তিনি।

কুড়িগ্রাম কলেজ মোড়ের শ্রমিক ইয়াসিন আলী(৫৫)বলেন,প্রায় ৩০বছর ধরে এই গাছ ফারানোর কাজ করছি। প্রতি মণ গাছ ফারলে পাই ২০টাকা করে। দিনে ২৫/৩০মণ গাছ ফারে বাজারের টাকা হয় না। বাজারে জিনিস পাতির দাম তাতে করেগোস্ত,মাছ চোখেও দেখি না মাসোতে।

উলিপুর উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের পাঁচপীর এলাকার বাসিন্দা সামছুর রহমান(৫২)বলেন,বাবা এই বয়সে বিশ্রাম নেবার কথা হামার জন্য স্বপ্নের মতো। বাতের ব্যথা,এ্যজমা নিয়ে ভ্যান চালাচ্ছি সংসারের ৪জনের পেট বাঁচাতে। একজনের আয়ে চলে মোর সংসার। একদিন বসে থাকলে সবাইকে উপোষ থাকতে হয়। মেম্বার-চেয়ারম্যানসরকারি কোন সহযোগিতা দেয় না।

একই এলাকার আবুল হোসেন বলেন,প্রায় ৬০বছর ধরে ভ্যান চালাচ্ছি। সন্তানরা বিয়ে করে তাদের সংসার নিয়ে আলাদা খায়। টাকার অভাবে বয়স্ক ভাতাও হয়নি। বাঁচার তাগিদে এখনও ভ্যান চালাতে হচ্ছে বিশ্রাম নেয়া বড়োলকি ছাড়া আর কিছু না হামার।

একই ইউনিয়নের গোড়াই আনন্দ বাজারের বাসিন্দা সুবারু রবি দাসের স্ত্রী আমরতি বলেন,তিন মেয়ে আর এক ছেলে বিয়ে করে সংসার আলাদা করে নিছে। প্রায় ৭০বছর বয়স হইল মেম্বারের কাছত বয়স্ক ভাতার জন্য গেছি ৪/৫হাজার টাকা চাইছে। টাকা দিবার পাই না ভাতাও আর হয় না। এলা এই বাড়ি ওই বাড়ি কাজ করে কোন মতে দিন চলে।

কুড়িগ্রামের এনজিও সলিডারিটি’র নির্বাহী পরিচালক হারুন অর রশীদ লাল বলেন, জেলায় বয়স্ক শ্রমিকের জরিপ না থাকলেও এই সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামাজিক মূল্যবোধ ভেঙ্গে যাচ্ছে,পারিবারিক বিচ্ছিন্নতার কারণে পিতা মাতার দায়িত্ব না নেয়ার যে প্রবণতা বেড়েছে। বাল্যবিয়ের স্বীকার পরবর্তি বিবাহ বিচ্ছেদের কারণে মেয়েসহ তার সন্তানের দায়িত্ব ভার পড়ছে বৃদ্ধ পিতা-মাতার উপর। ফলে বয়সকালেও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে বের হতে হচ্ছে তাদের। বাংলাদেশে গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণে বয়স্ক মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। ফলে এই বয়স্ক মানুষদের খাদ্য, চিকিৎসাসহ অন্যান্য ব্যয়ভার বহন করতে সরকার,জাতিসংঘ এবং দাতা সংস্থার সমন্বয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করার উপর জোড় দেন।

এনজিও জীবীকার পরিচালক মানিক চৌধুরী বলেন, বয়স্কদের বে-সরকারি প্রতিষ্ঠান গুলোতেও দ্রæত ছাটাই করা হয়। ব্যক্তি পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানেও তাদের রাখা হয় না। ফলে বয়স্কদের কর্মসংস্থানের ক্ষেএ একেবারে ছোট। ফলে অর্থনৈতিক নিরাপত্তার অভাবে তারা ঝুকিপূর্ণ কাজে যেতে বাধ্য হচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী,২০১৬সালে ৭০ দশমিক ৮শতাংশ দরিদ্র মানুষের বসবাস নিয়ে র্শীষ স্থানে কুড়িগ্রাম। পাকিস্তান আমলে এই জেলায় ৯৮ ভাগ মানুষই ছিল গরিব। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত সীমান্তবর্তী এবং বৃহৎ নদ-নদী যুক্ত জেলা কুড়িগ্রাম। আয়তন প্রায় দু’হাজার ২৫৫ দশমিক ২৯ বর্গকিলোমিটার আর জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ২৪ লাখ। জেলার ৯ উপজেলার মধ্যে ৭ উপজেলার সঙ্গেই ভারতের তিন রাজ্যের সীমান্ত প্রায় ২৭৮ দশমিক ২৮ কিলোমিটার। এর মধ্যে নদী পথসহ সমতল ভূমিতে প্রায় ৫০কিলোমিটার সীমানা জুড়ে নেই কোন কাঁটাতারের বেড়া।জেলা সদরের সাথে ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা বিচ্ছিন্ন ৬টি ইউনিয়ন নিয়ে রৌমারী এবং ৩টি ইউনিয়ন নিয়ে চর রাজিবপুর উপজেলা গঠিত।

 বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, চর রাজিবপুরই দেশের সবচেয়ে দরিদ্র উপজেলা। এই উপজেলার প্রায় ৭৯ দশমিক ৮ ভাগ মানুষই হতদরিদ্র। আর জেলার সবচেয়ে কম দরিদ্র ফুলবাড়ি উপজেলায়ও ৬৯ভাগ মানুষ হতদরিদ্র জীবন-যাপন করে। জেলায় কোনো শিল্পকারখানা না থাকায়প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ কৃষিনির্ভরশীল।