অবৈধ দখলদারে হাতে বিলিন হওয়া অফিসের হাটের ঐতিহ্যবাহি ইতিহাস

আমাদের প্রতিদিন
2024-07-23 05:23:48

স্বাধীন পলাশবাড়ীর বয়স ১০২ বছর

পলাশবাড়ী (গাইবান্ধা) প্রতিনিধি :

গাইবান্ধা জেলার  পলাশবাড়ীর অফিসের হাট নিয়ে ইতিহাস ও ঐতিহ্যর স্বর্ণলিপি ১০২ বছর পূর্বে ১৯২১ সালের ২০ আগষ্ট সেই ঐতিহাসিক দিনটি প্রতি বছরই আমাদের জীবনে ঘুরে ফিরে আসে। কিন্তু দুঃখের বিষয় জাতীয়ভাবে না হলেও স্থানীয় প্রেক্ষাপটে এই ঐতিহাসিক দিনটির গুরুত্ব আমাদের ক'জনের মনকেই বা জাগ্রত করতে পারে। তৎকালিন বৃটিশ শাসন আমলে পাক-ভারত উপ-মহাদেশ যখন বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছিল, ঠিক তখনই পলাশবাড়ী'র সর্বস্তরের জনতা'র উদ্যোগে তৎকালিন ১৯২১ খ্রীঃ বৃটিশ শাসিত ভারতবর্ষে তীব্র আন্দোলনের এক পর্যায়ে পলাশবাড়ীকে 'স্বাধীন পলাশবাড়ী' ঘোষণা করা হয়েছিল। ১৯২১ সালের এই দিনে নিখিল ভারতবর্ষে যখন বৃটিশ শোষক জমিদার শোষক, অত্যাচার, নিপীড়ানের বাঁধা ভেঙ্গে মুক্তির দৃঢ় প্রত্যয়ে পলাশবাড়ী বাসী তথা গোটা জাতি অগ্নি প্রজ্বলিত হয়ে সংগ্রাম ও আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ ভাবে ঝাপিয়ে পড়েছিল, ঠিক তখনই আন্দোলনরত পলাশবাড়ী'র দুঃসাহসিক সৈনিকরা পলাশবাড়ী'কে স্বাধীন হিসেবে ঘোষণা দেয় এবং সকল অপতৎপরতা প্রতিরোধের উদাত্ত্ব আহব্বান জানান। আন্দোলন মুখী তৎকালীন স্বাধীনকামী সর্বস্তরের জনতা সাঁওতাল ও সামাজিক সংস্কৃতিক সহ বিভিন্ন সংগঠন সমূহের এই ঘোষণা বৃটিশ শাসকরা যাতে নস্যাৎ করতে না পারে তৎজন্যে সর্বস্তরের জনতা আরো সংঘবদ্ধ হতে থাকেন। এভাবেই পলাশবাড়ীতে "স্বাধীন সরকার" প্রতিষ্ঠিত হয়।

গাইবান্ধার ইতিহাস ও ঐতিহ্যগ্রন্থ এবং পলাশবাড়ী'র প্রবীনদের নিকট জানা যায়, তৎকালীন ১৯২০ সালে সমগ্র ভারতবর্ষে মহাত্মা গান্ধী'র নেতৃত্বে অহিংস, আন্দোলন হয়। ঐ সময়ে মাওঃ শওকত আলী ও মাওঃ মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে প্রতিহাসিক কোময়েও আন্দোলন। এই আন্দোলন অবিরাম চলার ধারাবাহিকতায় ১৬১১ স্ত্রীঃ অসহযোগ আন্দোলন পরিণত এবং পরবর্তীতে তা জাতীয় আন্দোলন রূপ নেয়। মৌলভী এ, কে, এম, খোদাবকস্ সরকার: মুন্সী আসের মামুদ সরকারের পুত্র খোদা বকস সরকার ১৯০৪ সালে পলাশবাড়ী থানার দুর্গাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১০ম শ্রেণীর ছাত্র থাকাবস্থায় খেলাফত আন্দোলনে যোগ দেন এবং ইংরেজী শিক্ষা বর্ষন করেন। পরে তিনি কংগ্রেসে যোগ দেন। সর্বভারতীয় আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে ভারতে স্বাধীনতা ঘোষণার তারিখ নির্ধারিত হয়েও মহাত্মাগান্ধী কর্তৃক স্থগিত ঘোষিত হওয়ার সংবাদ পলাশবাড়ীতে যথা সময়ে না পৌঁছার কারণে ১৯২০ সালের আগষ্ট মাসে কংগ্রেস ও খেলাফত আন্দোলনের পলাশবাড়ীর কর্মকর্তারা স্থানীয় নেতা ফজর উদ্দিন তালুকদারকে দিয়ে পলাশবাড়ীতে স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করিয়ে ছিলেন। ফলশ্রুতিতে এই এলাকা ১৩ দিন বৃটিশ আধিপত্য মুক্তছিল। এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন খোদা বকস সরকার। এই স্বাধীনতা ঘোষণা সমগ্র ভারতকে আলোড়িত করে। স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনের কারণে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য নেতাদের সাথে খোদা বকস্ সরকার সে সময় গ্রেফতার হয়ে তিন মাস কারাদন্ড ভোগ করেন। এরপর তিনি ইংরাজী ভাষা সম্পূর্ণরূপে বর্জন করেন। খোদা বকস্ সরকার মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।পলাশবাড়ী বাশকাটা, কাকুলি ও ছোট ভগবানপুর নামক এক বৃটিশরা তাে সময় নীলকুঠি স্থাপন এবং কৃষকদের নির্যাতনের মাধ্যমে বাধ্যতামুলক নীল চাষে বাধ্য করার কারণে পলাশবাড়ীতে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠে চলমান আন্দোলন যখন তীব্রতর হয়ে উঠে ঠিক সেই সময় ১৯২১ সালে ২০ আগস্ট  পলাশবাড়ীতে এক বিশাল জনসভা থেকে স্বাধীন পলাশবাড়ী" ঘোষণা দেওয়া হয়। রংপুর কারমাইকেল কলেজের তৎকালীন অধ্যাপক ও স্বাধীনতা সমায়ের দেওয়া হয় তা প্রয়াত হীরেন্দ্র নাথ মুখার্জি একই দিনে স্বাধীন পলাশবাড়ী" পতাকা উত্তোলন করেন পলাশবাড়ী'র অফিসের হাট নামক স্থানটিতে ।  এ জনসভা শেষে গঠিত সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মরহুম এম, কে বাহমদ্দিন "স্বাধীন পলাশবাড়ী ঘোষনা পত্র পাঠ করেন। সভায় সমবেত বিপুল সংখ্যাকসর্বস্তরের জনতা এবং তীর-ধনুক সজ্জিত হাজারো সাঁওতালের স্বাধীনতা ঘোষনার সমর্থনে গগন বিদারী শ্লোগানে পলাশবাড়ী'র আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে উঠে। ঘোষনার দিন থেকে পলাশবাড়ীতে বৃটিশ সরকারের অফিস- আদালত, ভোট ফাচারী বয়কোট করে এবং স্বাধীন পলাশবাড়ী" সংগ্রাম পরিষদের আওতায় জুরির মাধ্যমে মামলা-মোকদ্দমা নিষ্পত্তি, সালিশী আদালত গঠন সহ প্রশাসনিক কার্যক্রম এবং সকল প্রকার বিলেতি পণ্য বর্জন করা হয়েছিল। "স্বাধীন পলাশবাড়ী'র গঠিত স্বাধীন সরকার পরিচালনায় "বিপুল শান্তি বাহিনী" নামে একট এবং স্বেচ্ছাসেক বাহিনী নামে পৃথক দুটি বাহিনী গঠন করা হয়। যার সর্বাধিনায়ক ছিলেন মরহুম খান লোদী। স্বাধীন পলাশবাড়ী'র উত্তোলিত পতাকাটির ডানে মসজিদ, বামে মন্দির, উপরে অর্ধচন্দ এবং নীচে একটি প্রবাহমান নদী ও তার তীরবর্তী জমিতে অংকিত ছিল রোপনকৃত গজিয়ে উঠা কিছু ধানের চারা। এই ঐতিহাসিক পতাকাটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম উত্তোলন ফরেছিলেন, স্বাধীন পলাশবাড়ী'র আন্দোলন প্রস্তুতি কমিটি'র সংগ্রামী সভাপতি মরহুম ফজরউদ্দিন তালুকদার। আঞ্চলিক ভিত্তিতে স্বঘোষিত স্বাধীন পলাশবাড়ীতে বৃটিশের তৎকালীন প্রচলিত আইনের গণবিরোধী সকল ধারা- উপধারা বাতিল করে নিজেদের প্রণীত আইন- কানুন মোতাবেক বিচার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল।

বর্তমানে পলাশবাড়ী উপজেলা সদর ইউনিয়নাধীন সদরের দক্ষিণ পার্শে বগুড়া রংপুর মহাসড়ক সংলগ্ন পূর্ব পার্শে হরিণমারী মৌজার দাগ নং ১৫, জমি ২৫ শতাংশ এবং জামালপুর মৌজার দাগ নং-১১০৩-১ একর ৩৯ শতাংশ মিলে ১ একর ৬৪ শতাংশ জমিতে স্থপিত অস্থায়ী সদর দফতর থেকে স্বাধীন পলাশবাড়ীর যাবতীয় প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হত। "স্বাধীন পলাশবাড়ী'র" আন্দোলনের খবর অবগত হয় সংযুক্ত বালার লাট স্যার হেনরী হুইলার চরম ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন এবং এর বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য নিদের্শ দেন। তৎকালীন রংপুর জেলার ম্যাজিষ্ট্রেট ছিলেন ডি.এম ফেজার এবং জেলা জজ ছিলেন মিঃ ম্যাডল্যান্ড। প্রশাসকদ্বয় স্বাধীন পলাশবাড়ী স্বাধীনতা ঘোষণাকারী বিপ্লবী নেতৃবৃন্দকে অবিলম্বে গ্রেফতারের নিদের্শ দেন গাইবান্ধা মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটকে। নিদের্শ প্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট ১৯২১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর গাইবান্ধা মহুকুমা পুলিশ ইন্সপেক্টরসহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেপালি পুলিশ নিয়ে পলাশবাড়ী ডাকবাংলোয় উপস্থিত হন। কিন্তু স্বাধীনতাকামী স্থানীয় সংগ্রামী জনতা ও তীর ধনুক সজ্জিত বাহিনীর কঠোর প্রতিরোধের মুখে তারা নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার না করেই অবশেষে স্ব-স্ব কর্মস্থলে ফিরে যেতে বাধ্য হন। পরে সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের উচ্চপদস্থ মিঃ গেরীর উপর এ কাজের দায়িত্ব পড়ে। মিঃ গেরীর নেতৃত্বে ভারী অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত অসংখ্য বৃটিশ, বেলুচি ও তথা সৈন্যসহ পলাশবাড়ী ডাকবাংলোয় আবারো অবস্থান নেন সম্রার্থী নেতৃবৃন্দকে গ্রেফপ্তারের জন্য। এ সময় পলাশবাড়ী খানার দারোগা ছিলেন মেহের বক্স মিয়া। দারোগা মেহের বক্সের সাথে সংগ্রামী নেতৃবৃন্দেও প্রথম সারির বেশ ক'জন নেতার সাথে ছিল সু-সম্পর্ক এবং গভীর বন্ধুত্ব।

আকস্মিকভাবে দারোগা মেহের বক্স একদিন নিরন্ত্রভাবে সংগ্রাম পরিষদের অফিসে পদার্পণ করেন এবং পরিষদ সভাপতির হাতে ৩৩ টি গ্রেফতারী পরোয়ানা তুলে দিয়ে স্বেচ্ছায় গ্রেফতার বরণের অনুরোধ জ্ঞাপন করেন। অনুরোধের ফলে ১৯২১ সালের ২০শে নভেম্বর বিপ্লবী নেতৃবৃন্দ স্বেছায় বরণ করেন। এ সময় থানার দু'শ গজ দূরত্বের মধ্যে ১৪৪ ধারা জারি বলবৎ করা হয়েছিল। এ গ্রেফতারের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পরলে আন্দোলন মুখর সর্বস্তরের জনতার মনে চাপা উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং আক্রোশে সমগ্র এলাকায় থমথম ভাব বিরাজ করতে থাকে। নেতৃবৃন্দের ভক্ত ও অনুসারীরাসহ সর্বস্তরের সচেতন জনতা এক পর্যায়ে বিক্ষোভ মিছিলের মাধ্যমে থানা আক্রমন করে পুলিশের কবজা হতে নেতাদের ছিনিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করে। কিন্তু নেতৃবৃন্দ উপস্থিত জনতা ও অনুসারীদের এ ধরণের পরিকল্পনা গ্রহণ না করার জন্য নির্দেশ দেন এবং সর্বভারতীয় খিলাফত আন্দোলনের নেতা মাওঃ মোহাম্মদ আলীর ডাকে মোয়াল্লাৎ ও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস নেতা মহাত্মা গান্ধীর নাগপুর গৃহীত অহিংস অসহযোগ নীতি অনুসরণের আহ্বান জানান। ঐ দিন ১২ জন নেতাতে গ্রেপ্তার পূর্বক গাইবান্ধা মহকুমা কারাগারে নেয়ার পথে হাজারো জনতা রাস্তার দু'ধারে দাঁড়িয়ে তাদের গভীর শ্রদ্ধা জানান। বিচারে তাদের আদালতে ছেড়ে দেয়ার শর্তে, ক্ষমা প্রার্থনার প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু বিপ্লবী নেতৃবৃন্দ সোচ্চার কন্ঠে ক্ষমা প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। পরে গ্রেফতারকৃত ১২ জন নেতাকে ৩ মাস কারাদন্ডের ন্যায় দেয়া হয়। ঐ সময় পলাশবাড়ী'র অফিস আদালত, কোর্ট-কাচারী ও সার্বিক শাসন ক্ষমতা প্রায় দেড়মাস স্থায়ীত্ব ছিল। ঐতিহাসিক "স্বাধীন পলাশবাড়ী'র "স্মৃতিকে চির জাগ্রত রাখতে স্থানীয় সচেতনবাসী উক্ত অফিসের স্থানটি'তে ১৯২২ সালে "অফিসের হাট" নামকরণ করে একটি হাট বসায়। সাপ্তাহিক সোমবার ও বৃহস্পতিবার করে অত্রলাকার বিভিন্ন পণ্যেও ক্রেতা-বিক্রেতা সমাগমে জমজমাটভাবে হাটটি যথাস্থানে বসতো। উপজেলা প্রশাসন মোটা অংকের রাজস্ব আয়ের বিপরীতে হাটটি ইজারা প্রদান করে আসছে। কিন্তু অফিসের হাট নামেই ইজারা প্রদান করা হলেও তা বিগত প্রায় ২০ বছর ধরে যথাস্থনে বসছে না। ফলে হাটটি দীর্ঘসময় পরিত্যাক্ত থাকার কারণে একদিকে যেমন পলাশবাড়ী'র প্রকৃত ইতিহাস জানা থেকে নব-প্রজন্মদের বঞ্চিত করা হচ্ছে, অপরদিকে প্রায় কোটি টাকা মূল্যেও সরকারিসম্পত্তি সময়ের ব্যবধানে কতিপয় স্বার্থান্বেষী অবৈধ দখলদার প্রতিযোগিতারমূলক গ্রাস করে চলছে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় এসব দেখার কেউ নেই। ঠিক যেন "সরকারের মাল দরিয়া মে ঢাল"।

উক্ত অফিসের হাটসহ আশপাশের খাস খতিয়ান ভুক্ত সকল দাগের জমি গুলো অবৈধ দখলদার মুক্ত করতে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ পূর্বক পূনরায় সঠিক সীমানা নির্ধারনের মাধ্যমে পলাশবাড়ী'র ইতিহাসে বহুল স্মৃতি বিজরিত ঐতিহাসিক "অফিসে হাটটি" পূর্বের ন্যায় যথাস্থানে নিয়মিতভাবে বসানোর জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের নিকট জোর দাবী জানিয়েছে স্থানীয় সচেতন মহল।