চাচার হোটেলে খেলে মিলে উপহার দুর্বলদের খেতে মানা

খবর বিজ্ঞপ্তির:
ছোট টিনশেডের ঘরে ভর্তি মানুষ। অনেকে ব্যস্ত খাবারে। কেউবা বসার জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। একেকজনের সামনে বাটি ভর্তি ভাত-ডাল আর সঙ্গে ৩ পিস গরুর মাংস, অর্ধেক ডিম, সবজি, মাছ, শুঁটকি, বাদাম ও আলুভর্তা, শাক ভাজা ও সালাদসহ অনেক কিছু! আর এই সব খাবার মিলছে মাত্র ১৮০ টাকায়। আরও হোটেলে রয়েছে পেটচুক্তিতে বিজয়ী ভোজনপ্রিয় মানুষের জন্য অন্যরকম উপহার।
বলছি রংপুরের পীরগাছা উপজেলার চৌধুরাণীর বকসীর দিঘি বাজারে রাস্তার ধারে গড়ে ওঠা ‘চাচার হোটেল’এর কথা। একসময় পথের ধারে পরাটা বিক্রি করতেন বর্তমানের চাচার হোটেলের মালিক মকবুল হোসেন। কম টাকায় পেট চুক্তিতে খাবার মেলায় অল্প সময়ে ‘চাচার হোটেল’ নামে পরিচিতি পায় মকবুলের খাবারের দোকান।
খাবারে ভিন্নতা আনতে তিনি ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের খাবার তৈরি করতে শুরু করেন। শুরু থেকেই হোটেলটিতে পেটচুক্তি হিসেবে খাবারের ব্যবস্থা ছিল। মকবুল হোসেনের হোটেলে এখন পাওয়া যায় ১০ রকমের ভর্তা, গরুর মাংস, হাসের মাংস, মুগ ডালসহ চিকন চালের ভাত। ৫০ টাকায় শুরু করে এখন ১৮০ টাকায় পেটচুক্তি খাবার মকবুল হোসেনকে এনে দিয়েছে ব্যাপক পরিচিতি। আজ বুধবার(১১নভেম্বর) দুপুরে সরেজমিনে‘চাচার হোটেল’গিয়ে ভোজনপ্রিয় মানুষের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে। মকবুল মিয়ার চাচার হোটেলের বিশেষ আকর্ষণ হলো- ৩ বাটি ভাত যদি কেউ ১০ রকমের ভর্তা, গরুর মাংস, হাসের মাংস, মুগ ডালসহ আরও তরকারী দিয়ে খেতে পারে। তার জন্য খাওয়া শেষে দেওয়া হবে এক গ্লাস দুধ, গ্লাস দই, কোমলপানীয়। আবার সাথে রয়েছে ৮৫০ টাকা মূল্যের প্যান্টেরপিচ, যাতায়াতের ভাড়া এবং নাশতা বাবদ ১০০ টাকা বকশিশ।
হোটেলের সামনেই বড় ব্যানারে লেখা রয়েছে উপহারের কথা তার সাথে বিশেষভাবে বলা আছে, “দয়া করে দুর্বল লোক খেতে আসিবেন না”। যা নজর কাড়ছে মানুষের। স্থানীয় ছাড়াও দুর-দুরান্ত থেকে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ নিতে আসছেন ভোজনপ্রিয়রা। তাদের কেউ দিতেছেন উপহারও। কথা হয় কুড়িগ্রাম থেকে আসা রাজুর সাথে তিনি বলেন, আমরা পাঁচজন খেতে এসেছি চাচার হোটেলে। ফেসবুকে ভিডিও দেখার পর আজকে এসে সরাসরি খাবারের স্বাদ নিলাম। এখানকার ১০ প্রকারের ভর্তা, গরুর মাংস ভালো লেগেছে। আর তিন বাটি ভাত খাওয়া সত্যি কষ্টকর। এটা আমরা কেউ পারিনি। খাবারের মান, দাম এবং পরিবেশ ভালো লেগেছে।
খাবারের অপেক্ষায় টেবিলে বসে থাকা রাজশাহীর বাসিন্দা মুক্তাদির রহমানসহ তার সঙ্গে আরও কয়েকজন এসেছেন। কথা হয় তার সাথেও। তিনি বলেন, এখানে উপহারের জন্য আসেনি বরং খাওয়াটাই আমাদের উদ্দেশ্য। আর এক বাটিতে যে পরিমাণ ভাত রয়েছে, সহজেই কেউ তিন বাটি ভাত খেতে পারবে বলে মনে হয় না। তবে হোটেলর পরিবেশ এবং খাবারের দাম সন্তোষজনক। এ হোটেলে নিয়মিত খেতে আসেন পীরগাছা বাজার এলাকার মোজাহারুল ইসলাম। সঙ্গে তিনি তার নিকটজনদেরও নিয়ে আসেন। খাবার টেবিলে বসে মুখরোচক ভর্তা আর গরুর মাংসের সাথে ভাত খেতে খেতে আজকালের খবরকে বলেন, চাচার হোটেলের খাবারের খুব স্বাদ। মানটাও ভালো। আমি তো আসি, সঙ্গে আজ আমাদের চাচাসহ আরও কয়েকজনকে নিয়ে এসেছি। পেটচুক্তি খাবার সাবাড় করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। এজন্য উপহারের লোভ নয় বরং ভালো খাবারের লোভেই এখানে আসা হয়।
গাইবান্ধার পলাশবাড়ী থেকে খেতে এসে হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন আতিকুর রহমান। তিনি যখন হোটেলের বাইরে অপেক্ষা করছিলেন তখন সাড়ে তিনটা পার। ভিতরে বসার টেবিল ফাঁকা ছিল না, থেমে ছিল না ঘড়ির কাটাও। প্রায় বিশ মিনিট অপেক্ষার পর খাবারের স্বাদ নেয়ার সুযোগ না পেয়ে ফেরার পথে কথা বলেন আজকালের খবরের সাথে। এরকম অনেকেই বিকেল চারটা পার হলে চাচার হোটেলে এসে আর খাবার টেবিলে বসতে পারেন না। কারণ বিকেল ৪টা ১০ মিনিটে বন্ধ হয় চাচার হোটেল ।
রংপুরের পীরগাছা উপজেলার কৈকুড়ী ইউনিয়নের রামচন্দ্রপাড়া গ্রামের মৃত হেলাল শেখের ছেলে মকবুল হোসেন। নিত্যপণ্যের দাম বাড়লেও খুব একটা বাড়েনি তাঁর খাবারের দাম। ৫০ টাকা থেকে শুরু করে প্রতিবছর ১০ টাকা করে বাড়িয়ে এখন ১৮০ টাকায় বাবার বিক্রি করছেন তিনি। নিয়ম করে সপ্তাহের ৫ দিন ভোররাত ৩টা ১০ মিনিটে দোকান খোলা হয়। বন্ধ হয় বিকেল ৪টা ১০ মিনিটে। শুক্র ও শনিবার বন্ধ থাকে।
২৬ বছর ধরে হোটেল ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া মকবুল হোসেন বলেন, হোটেল শুরুর দিকে তিনি রুটি বেচতেন। একটা রুটি খেলে দশ টাকা, দুইটা খেলেও একই টাকা। এমনি অর্ধেক খেলেও তিনি দশ টাকাই নিতেন। এভাবে বেচতে বেচতে এক কেজি করে চাল রান্না করে ১৫-২০ টাকার মধ্যে মানুষকে খাওয়াতেন। যখন বেচাবিক্রি বাড়তে থাকে, তখন তিনি ব্যবসার ধরন পাল্টে নেন। শুরু করেন ৫০ টাকায় পেটচুক্তি খাবার বিক্রি, যা বর্তমানে ১৮০ টাকা।
মকবুল হোসেন আরও বলেন, এখন পেটচুক্তি খাবার ১৮০ টাকা। এর কম খেলেও ওই ১৮০ টাকাই দিতে হবে। তবে চাচার হোটেলে দুর্বল লোকদের খাবার খেতে মানা। চুক্তিতে খাবার খেতে সময় পাবেন ১ ঘণ্টা দশ মিনিট। কেউ যদি এক ঘণ্টা ১০ মিনিটের মধ্যে তিন বাটি ভাত (দেড় কেজি চাল) খেতে পারে তার খাবারের বিল সম্পূর্ণ ফ্রি। সঙ্গে আকর্ষণীয় উপহার হিসেবে এক গ্লাস দুধ, এক গ্লাস দই, একটা কোমলপানীয় রয়েছে। এছাড়াও পেটচুক্তিতে জিততে পারা ভোজনপ্রিয় মানুষকে প্যান্টের পিচ কেনার জন্য ৮৫০ দেয়া হয়।
বিয়ের সময় শ্বশুড়বাড়িতে দেওয়া খাবারের চেয়েও উন্নত খাবার পরিবেশনের প্রতিশ্রুতিও রয়েছে। এর জন্য জনপ্রতি গুনতে হবে ৩৬০ টাকা, তবে শর্ত ২০ জনের কম হলে খেতে মানা। চাচার হোটেলে ময়মনসিংহ, বগুড়া, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাটসহ বিভিন্ন জেলার মানুষ এখানে খেতে আসেন- যোগ করেন মকবুল হোসেন।
পেটচুক্তি প্রসঙ্গে হোটেল কর্মচারী সাইফুল ইসলামের সাথে কথা হলে তিনি জানান, বর্তমানে ১৮০ টাকার প্যাকেজে এক বাটি ভাত, গরুর মাংস, আর্ধেক ডিম, ভাজ মাছ, বাদাম ভর্তা, শুটকি ভর্তা, আলু ভর্তা, ধনিয়াপাতা ভর্তা, কালোজিরা ভর্তা, তিলের ভর্তা, সবজি, বুটের ডাল, টটোটো সস এবং মুখরোচক আচার। খাবার সময় এক ঘণ্টা ১০ মিনিট। কেউ যদি এক বসাতেই তিন বাটি ভাত খেতে পারে তার জন্য অনেক কিছু উপহার রয়েছে।
ছোটবড় সবার কাছে চাচা হিসেবে পরিচিতি পাওয়া মকবুল হোসেন জানান, তাঁরা স্বামী-স্ত্রী মিলে হোটেলটি চালান। দিন দিন গ্রাহকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সাতজন কর্মচারীকে রাখা হয়েছে। প্রতিদিন ৫০-৬০ হাজার টাকার খাবার বিক্রি করেন মকবুল। প্রতিদিন কয়েক শ মানুষের রান্না হয় এই হোটেলে। এখানকার নিয়মিত গ্রাহক প্রায় ৫০ জন। অনেক যানবাহনের চালক ও শ্রমিক রাতে খাবার খান বলে রাত ৩টা ১০ মিনিটে হোটেল খোলা হয়।