২১ বৈশাখ, ১৪৩১ - ০৪ মে, ২০২৪ - 04 May, 2024
amader protidin

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি ১১ বছরেও কান্না থামেনি রেবেকার, খোঁজ নেই শাবানার

আমাদের প্রতিদিন
1 week ago
33


ফুলবাড়ী (দিনাজপুর) প্রতিনিধি:

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল। অন্যান্য দিনের মতো এদিনের সকালে ঢাকার সাভারের বাসস্ট্যান্ড এলাকা ছিল কর্মচঞ্চল। হঠাৎ বিকট শব্দ, ধসে পড়ে ৯ তলাবিশিষ্ট ভবন ‘রানা প্লাজা’। ভবনটিতে ছিল পোশাক কারখানা, কয়েকটি দোকান ও একটি ব্যাংক। এদিন কাজে আসা ১১ শতাধিক পোশাকশ্রমিক ভবন ধসে প্রাণ হারান। আহত হন ২ হাজারের অধিক শ্রমিক। বেঁচে যাওয়া এসব শ্রমিকের অনেকে হয়েছেন পঙ্গু, কেউ শয্যাশায়ী হয়ে কষ্টে দিন পার করছেন। তাঁদের মধ্যে একজন দিনাজপুরের ফুলবাড়ীর রাবেয়া খাতুন দুই পা হারিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এখনো খেঁাজ মেলেনি একই উপজেলার গুলশানে জান্নাত শাবানার।

আজ ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ১১ বছর পূর্তি। দীর্ঘ এই শোক বয়ে বেড়ানো ৩৪ বছর বয়সী রেবেকা খাতুন কেমন আছেন? কান্নাজড়িত কণ্ঠে আমাদের প্রতিদিনকে রাবেয়া খাতুন বলেন, ‘দুই পা হারিয়ে কর্মহীন হয়ে সারা দিন বাড়িতে থাকতে হয়। স্বামী—সন্তানদের নিয়ে কোথাও যেতে পারি না। তাদের প্রয়োজনেও কাজে আসতে পারি না। একজন কর্মক্ষম মানুষ এভাবে চলতে পারে না। হয়তো কিছু টাকা পেয়েছি, কিন্তু কেউ কি আমার পা দুটো ফিরিয়ে দিতে পারবে? যা দিয়ে আমি আগের মতো কাজ করতে পারব, স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারব?’

রেবেকা খাতুন আলাদীপুর ইউনিয়নের বারাই চেয়ারম্যানপাড়া গ্রামের মোস্তাফিজার রহমানের স্ত্রী। দুর্ঘটনার বছরখানেক পর পঙ্গুত্ব জীবনে তাঁর কোলজুড়ে আসে প্রথম সন্তান ছিদরাতুন মুনতাহা। ১০ বছর বয়সী মুনতাহা স্থানীয় এক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছে। অপর সন্তান মাদানী আন নুরের বয়স চার বছর। সেদিন রানা প্লাজা ধসে মা চানবানু ও দাদি কোহিনুর বেওয়াকেও হারান তিনি। তাঁরা একই কারখানায় কাজ করতেন।

ভয়াবহ সেই দুর্ঘটনার বর্ণনা করেন রেবেকা খাতুন। দুর্ঘটনার এক দিন আগে, অর্থাৎ ২৩ এপ্রিল রানা প্লাজায় ফাটল দেখা দিলে বিকেল ৪টায় সবাইকে ছুটি দেয় কর্তৃপক্ষ। পরদিন সকাল ৮টায় বিল্ডিংয়ের ফাটলের কারণে কাজে যোগ দিতে চান না শ্রমিকেরা। বেতন—ভাতাসহ অতিরিক্ত কর্মঘণ্টার টাকা দেওয়া হবে না এবং চাকরিচ্যুতির হুমকি দিয়ে কর্তৃপক্ষ কাজ করায়। পরিশ্রমের টাকা আর চাকরি হারানোর ভয়ে অন্যান্য শ্রমিকের সঙ্গে তিনিও কাজে যোগ দেন।

রেবেকা খাতুন বলেন, ‘ঘটনার দিন সকাল ৯টায় মা চান বানু নাশতা খাওয়ার কথা বলেন। আমি খাইনি, কাজ শেষ করে খাব বলি। এরপর তিন দিন আর খাবার মুখে ওঠেনি। দুর্ঘটনায় অচেতন হয়ে তিন দিন আটকে ছিলাম ওই বিল্ডিংয়ের ধ্বংসস্তূপের নিচে। জ্ঞান ফিরলে দেখি চারদিকে অন্ধকার। বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করি। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছিল। নিরুপায় হয়ে গায়ের ঘাম শুষে নেওয়া এবং নিজের মূত্র পান করেছি। এরপর আর কিছুই বলতে পারি না। পরে নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করি। পরে জানাতে পারি আমার দুটি পা ঊরু পর্যন্ত কেটে ফেলা হয়েছে।’

‘এরই মধ্যে দুই পায়ে আটবার অপারেশন কারা হয়। দীর্ঘ এক বছর ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে কর্মহীন হয়ে গ্রামে নিজের বাড়িতে ফিরি। সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হলো, ওই দিন আমি আমার মা চান বানু ও দাদি কোহিনুর বেওয়াকে হারিয়েছি। অনেক খেঁাজাখুঁজি করেও তাঁদের খেঁাজ পাইনি।’ বলেন রেবেকা খাতুন।

আক্ষেপ করে রেবেকা খাতুন আরও বলেন, ‘একটা জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে আছি। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী দুই পা হারানোরা ব্যক্তিরা ক্ষতিপূরণ বাবদ ১৫ লাখ টাকা পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই সময় চিকিৎসাজনিত কারণে ক্ষতিপূরণের ৫ লাখ টাকা কম পেয়েছি। ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র পেয়েছি। সেই সঞ্চয়পত্রের লভ্যাংশ প্রতি মাসে ৯ হাজার ১০০ টাকা করে পাই। তা দিয়েই বর্তমানে কোনো রকমে কষ্টে চলে সংসার। অন্যের সাহায্য ছাড়া কিছু করতে পারি না। তাই আমার স্বামীও কাজে যেতে পারে না। আমার পাশেই থাকতে হয় তাকে।’ সেদিনের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন তিনি।

সেদিনের দুর্ঘটনায় নিখেঁাজ উপজেলার কাজীহাল ইউনয়নের ডাঙ্গা গ্রামের আতাউর রহমানের স্ত্রী গুলশানে জান্নাত শাবানা তখন তখন ২৭ বছরের তরুণী। রানা প্লাজার ষষ্ঠতলায় সুয়িং অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন তিনি। দুর্ঘটনার পর তাঁকেও আর পাওয়া যায়নি। নিখেঁাজের তালিকায় নাম ছিল শাবানার।

কথা হয় শাবানার স্বামী আতাউর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যাই। অনেক খেঁাজাখুঁজি করেও তার সন্ধান পাইনি। তবে নিখেঁাজ তালিকায় শাবানার নাম থাকায় ১৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছি। কিন্তু পাইনি স্ত্রীকে কিংবা তাঁর মরদেহ। সেদিনের ঘটনায় এলোমেলো হয়ে যায় আমার সাজানো সংসার। মাহারা শিশুদের অনেক কষ্টে লালন—পালন করেছি। স্ত্রীকে হারানোর ব্যথা আজও বয়ে বেড়াই, স্মৃতিগুলো মনে পড়ে।’

আতাউর রহমান বলেন, ‘সে সময় (দুর্ঘটনা) আমাদের ছেলে সাজ্জাদ আহম্মেদ সজীবের বয়স ছিল ৫ বছর। এখন তার বয়স ১৮। সে এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। মেয়ে সোহানা আফরিন সানু ছিল ৩ বছরের, বর্তমানে তার বয়স ১৪। সে বর্তমানে স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ছে। আজ তাদের মা থাকলে কত খুশি হতো।’

শাবানার মেয়ে সানু বলে, মায়ের চেহারাটা মনে নেই। মাকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করে। আজ মা থাকলে কত আদর করত।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়