২০ বৈশাখ, ১৪৩১ - ০৪ মে, ২০২৪ - 04 May, 2024
amader protidin

চলমান দাবদাহ: প্রভাব পড়ছে দেশের অর্থনীতিতে

আমাদের প্রতিদিন
1 week ago
41


আমাদের ডেস্ক:

প্রতিদিনের মতো জীবিকার সন্ধানে রিকশা নিয়ে বের হয়েছিলেন আব্দুল আউয়াল। তীব্র রোদ, হল্কা বাতাস আর প্রচণ্ড গরমে শুরু থেকেই হাঁসফাঁস করছিলেন তিনি। রিকশা ঢাকা মেডিকেল এলাকা পর্যন্ত আসতেই অজ্ঞান হয়ে পড়েন আউয়াল, কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যান হিটস্ট্রোকে।

আবহাওয়া অফিসের সর্বশেষ তথ্য বলছে, দেশে সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা যশোর—খুলনা অঞ্চলে। লাগাতার ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরের তাপমাত্রায় দমবন্ধ অবস্থা সেখানে। ঢাকায় তাপমাত্রা দিনের বেলা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশপাশে বিরাজ করছে।

গুগল ওয়েদারের দেয়া তথ্যানুয়ায়ী, তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলেও অনুভূত হচ্ছে ৪০ ডিগ্রির ওপরে। দিনের বেলা চামড়া—পোড়া গরম আর রাতে বাতাসে আর্দ্রতা বেড়ে অস্বস্তির সৃষ্টি হওয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়ছে মানুষ, শিকার হচ্ছে হিটস্ট্রোকের।

রিকশাচালক আব্দুর আউয়ালের মতোই গতকাল মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) হিটস্ট্রোকে মারা গেছেন মধ্যবয়স্ক চাকরিজীবী আলমগীর শিকদার। প্রতিদিনকার মতো অফিসের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হয়ে গুলিস্তান আসতেই অজ্ঞান হয়ে পড়েন তিনি। পরবর্তী সময়ে ঢাকা মেডিকেল নেয়া হলে চিকিৎসকরা জানান হিটস্ট্রোকে আলমগীর মারা গেছেন।

এ তো গেল রাজধানীর কথা। রাজধানীর বাইরে মাদারীপুর ও রাজশাহীতে হিটস্ট্রোকে কৃষকের মৃত্যুর মতো ঘটনা ঘটেছে। এদের প্রত্যেকেই দুপুরে মাঠে কাজ করতে গিয়ে তীব্র রোদে জ্ঞান হারিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন।

তীব্র গরমে সবচেয়ে মানবেতর অবস্থা ঢাকা শহরের রিকশাচালকদের। একদিকে পেটের ক্ষুধা, অন্যদিকে মহাজনের দৈনিক টাকা জমা দেয়ার চাপ এসব ছাপিয়ে যোগ হয়েছে তীব্র দাবদাহ। বাইরে রোদ্দুরে বেশিক্ষণ থাকলে জ্ঞান হারানোর দশা হয় বলে জানান তারা। কিছুক্ষণ রিকশা চালিয়ে ছায়ায় বসে বারবার বিশ্রাম নিতে হয়।

রাজধানীর বউবাজারের রিকশাচালক হানিফ বলেন, ‘এই রোদ্দুরে টানা এক ঘণ্টা রিকশা চালাইলে মাথাব্যথা শুরু হয়। রোদ্দুরের মধ্যে পানি বা শরবত খাইলে বমি আসে, বুক দড়ফড় করে। শুরুতে মাথাব্যথা করলেও পরে মাথা ঘুরতে থাকে। এ অবস্থায় রিকশা চালানো দায় হয়ে গেছে। আগে প্রতিদিন ঘরে ১২০০—১৫০০ টাকা নিয়া ফিরতে পারলেও এখন ৫০০—৬০০ টাকার বেশি থাকে না।’

নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে শান্তিনগরের আরেক রিকশাচালক আরিফ বলেন, ‘কয়দিন আগে মালিবাগ মোড়ে গরমে বেহুঁশ হয়ে গেছিলাম। লোকজন মাথায় পানি দিয়া হুঁশ ফিরাইছে। গরমে রিকশা না বাইর হওয়ার আধা বেলা হইতে না হইতেই শরীর খারাপ করে। টানা চার দিন রিকশা নিয়া বাইর হই নাই।’

রিকশাচালকদের মতোই বেহাল দশা রাইড শেয়ারিংয়ের বাইকারদের। তীব্র দাবদাহে যাত্রীরা যথাসম্ভব বাইক এড়িয়ে চলছেন বলে জানান তারা।

রাজধানীর বাইকার মাহমুদুল্লাহ রুনু বলেন, এমন গরম পড়ছে যে বাইক রেখে দূরে কোনো ছায়ায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। বাইকের সিট গরম হয়ে থাকায় যাত্রীরা বসতে চায় না। অনেকে আবার গরমে হেলমেট পরতে চায় না। সব মিলিয়ে অর্ধেকের বেশি যাত্রী কমে গেছে। আগে সারা দিন বাইক চালালে দিনে ২ হাজার টাকার মতো আয় হতো। এখন ১ হাজার টাকা আয় করতেই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

এদের বাইরে যারা মার্কেটিং ও সেলসে চাকরি করেন দাবদাহে তাদেরও বেহাল অবস্থা। মুরসালিন নামে করপোরেট এক সেলস কর্মকর্তা বলেন, এই গরমে ফরমাল শার্ট—প্যান্ট পরে দোকানে দোকানে ঘুরতে হচ্ছে। এ অবস্থায় বাইরে অবস্থান করা এক রকমের অসম্ভব হয়ে উঠছে। অফিসের অনেকে অসুস্থ হয়ে ছুটিতে আছেন। এতে অফিসের কাজকর্মও ব্যাহত হচ্ছে।

একইভাবে গরমে করুণ দশা পোশাক শ্রমিকদের। অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ায় কারখানার কাজ ব্যাহত হচ্ছে। আবার কারখানার মধ্যে এমন পরিবেশ যাতে লাগাতার কাজ করাও এই গরমে কঠিন হয়ে উঠছে পোশাক শ্রমিকদের জন্য।

রেটরো নিটওয়্যার পোশাক কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলতাফ হোসেন বলেন, গরমের কারণে অনেক কর্মচারী অসুস্থ হয়ে পড়ায় ২০ শতাংশের কম লোক নিয়ে কারখানা চালাতে হচ্ছে। এতে বায়ারদের অর্ডারমাফিক সময়মতো পণ্য সরবরাহের ব্যাপারটিও অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।

চলমান দাবদাহে অতিষ্ঠ জনজীবনের প্রভাব পড়ছে দেশের অর্থনীতিতেও। রিকশাচালকের আয় থেকে শুরু করে দেশের সবচেয়ে বৃহৎ রফতানি খাত পোশাক শিল্পেও দাবদাহের ঘাম ঝরতে শুরু করেছে। এভাবে চলতে থাকলে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতিতেও এর প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

 

শুধু পোশাক খাত নয়, দাবদাহের যন্ত্রণায় ভুগছেন খামারিরাও। বিশেষ করে পোলট্রি ব্যবসায়ীরা পড়েছেন বড় বিপদে। প্রচণ্ড গরমে হাজার হাজার মুরগির মৃত্যুতে বিপাকে পড়েছেন তারা।

চাঁদপুরের পোলট্রি ব্যবসায়ী শাহ আলম বলেন, গরমের কারণে এক দিনে তার ২ হাজার মুরগি হিটস্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছে। বড় রকমের লোকসানে পড়েছেন তিনি।

চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির পোলট্রি ব্যবসায়ী রাতুল বলেন, গরমের কারণে প্রতিদিন ১০০—১৫০টি মুরগি মারা যাচ্ছে। ভয়ে এলাকার খামারিরা মুরগির বয়স হওয়ার আগেই বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছেন। এতে একদিকে তারা লোকসানে পড়ছেন, অন্যদিকে বাজারে মুরগির মাংসের দাম বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক অতনু রব্বানী সময় সংবাদকে বলেন, দাবদাহের সঙ্গে মূল্যস্ফীতির সংযোগ নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। যদি এই আবহাওয়ার কারণে সরবরাহ সংকট দেখা দেয়, তাহলে বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা থাকবে। এই অস্বস্তিকর আবহাওয়ায় পণ্য যাতে নষ্ট না হয়, তাতে যে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে সেখানেও যোগ হচ্ছে বাড়তি খরচ। এর প্রভাব বাজারে পড়া খুব স্বাভাবিক।

কৃষকরা বলছেন, গরমের কারণে এবার ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে। বিশেষ করে এখন মাঠে থাকা বোরো ফসল দাবদাহের কারণে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মাটিতে আর্দ্রতা কমে যাওয়ায় বাড়তি সেচ দিতে হচ্ছে তাদের। ফলে ফসল উৎপাদনে বেড়ে যাচ্ছে খরচ।

বরিশালের বাকেরগঞ্জের কৃষক মকবুল হোসেন বলেন, আগে ক্ষেতে টানা ১০ ঘণ্টা কাজ করতাম। এখন ২—৩ ঘণ্টার বেশি কাজ করাই যাচ্ছে না। টাকা বাড়িয়েও ক্ষেতকামলা পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে ধানের আগা শুকিয়ে যাওয়ায় চিটা ধানের পরিমাণ বেড়ে যাবে বলে শঙ্কা করা যাচ্ছে।

শুধু ধান নয়, দাবদাহের প্রভাব পড়েছে সবজিক্ষেতেও। ঝালকাঠির কৃষক সামসুল হক হাওলাদার বলেন, রোদ্দুরে শসা ও টমেটো ক্ষেতে সবজি শুকিয়ে যাচ্ছে। বেগুনে পোকার পরিমাণ বেড়ে গেছে। সেচ দিয়েও আর্দ্রতা ঠিক রাখা যাচ্ছে না। এর ওপর দফায় দফায় লোডশেডিং হওয়ায় সেচকাজে ঘটছে বড় রকমের ব্যাঘাত।

আম—লিচুর বাগানেও পড়েছে দাবদাহের নেতিবাচক প্রভাব। সাতক্ষীরার আমচাষি নাজমুস সাকিব বলেন, শুরু থেকেই এবার আমের ফলন কম। সেচের জল দিয়ে কোনোরকমে গাছের ফল টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করলেও শেষ ক’দিনে যে পরিমাণে গরম পড়েছে তাতে আমের গুটি ঝরে পড়ছে। কোনোভাবেই গুটি ঝরা ঠেকানো যাচ্ছে না। এতে ফলন বিপর্যয়ের শঙ্কা করছেন তারা।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের লিচুচাষি শরিফুল ইসলাম জানান, প্রখর রোদে লিচুবাগানে এক রকমের খরা দেখা দিয়েছে। সেচ দিয়েও গাছের আর্দ্রতা ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না। তীব্র তাপে লিচু ফুলের শীষ শুকিয়ে যাচ্ছে, পচন ধরছে ফলের গুটিতে।

চলমান দাবদাহে ব্যষ্টিক থেকে সামষ্টিক পুরো অর্থনীতিতে ঝরছে ঘাম। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ মাহফুজ কবির বলেন, রিকশাচালকের আয় থেকে শুরু করে মধ্যবিত্তের ঋণ করে এসি কেনা; সবখানেই নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। শহর থেকে গ্রাম সবখানেই অঁাচ লেগেছে তীব্র দাবদাহের। এভাবে চলতে থাকলে জনজীবনের মতো অর্থনীতিও অস্থির হয়ে উঠবে।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়