১২ বৈশাখ, ১৪৩১ - ২৫ এপ্রিল, ২০২৪ - 25 April, 2024
amader protidin

দুই টাকায় বই ভাড়া দেন ‘বইদাদু’

আমাদের প্রতিদিন
1 year ago
335


নিজস্ব প্রতিবেদক:

আর্থিক অনটনের সংসার জীবনে অন্য পেশায় গেলেও বই পড়া নেশার টানে ফিরে আসেন বইয়ের জগতে। নিজে তো বই পড়েনই, অন্যদেরও পাঠের অভ্যাস গড়ে তুলতে সহযোগিতা করে চলেছেন নিরন্তর। সত্তর পেরোনো ওমর শরীফ রংপুর জেলাসহ আশে পাশের জেলার বইপ্রেমিদের কাছে পরিচিত ‘বইদাদু’ নামে।

রংপুর নগরীর শহিদ জররেজ মার্কেটে অন্যের দোকানে বসে ভাড়ায় বই দেন ওমর শরীফ। বই নিয়ে পড়া শেষে পাঠক তাঁকে বইটি ফিরিয়ে দিয়ে যান। এরপর সেই বই ঘুরতে থাকে এক পাঠক থেকে আরেক পাঠকের হাতে। গল্পসমগ্র, উপন্যাস, কবিতা ও আত্মজীবনীমূলক বইসহ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র, জীবনানন্দ দাশ, বাংলা সাহিত্যের প্রধান লেখকদের অধিকাংশ বই, এমনকি উইলিয়াম শেকসপিয়ার, ম্যাক্সিম গোর্কি, টলস্টয়ের বইও রয়েছে তাঁর সংগ্রহে।

রংপুর সিটি করপোরেশনের উল্টো দিকে শহিদ জররেজ মার্কেটে ঢুকলেই হাতের ডান দিকে চোখে পড়বে কম দামি বইমেলার দোকান। দোকানের ভেতরে এককোণে বইয়ের মধ্যে ওমর শরীফ বসে থাকেন। মাত্র দুই টাকা ভাড়ার বিনিময়ে বই পাঠে উদ্বুদ্ধ করেন পাঠকদের। তবে বইয়ের ভাড়া প্রকারভেদে ১০ থেকে ৫০ টাকা করা হয়েছে এখন।

কিশোর, তরুণ থেকে শুরু করে সব বয়সের পাঠকই তাঁর কাছ থেকে বই নিয়ে পড়েন। যদিও তথ্যপ্রযুক্তির প্রবাহে পাঠকের হাতের মুঠোয় বই পৌঁছালেও, বইদাদুর বই ভাড়ায় তেমন ভাটা পরেনি। বরং সময়ের সাথে বাড়ছে নিত্য নতুন বইয়ের চাহিদা।

বইদাদু ওমর শরীফ শৈশব থেকেই ছিলেন বইয়ের পোকা। হাতে টাকা পরলেই বই কিনতেন তিনি। এভাবেই ধীরে ধীরে বইয়ের সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে তার। কর্মজীবনের শুরুতে কাপড়ের ব্যবসা শুরু করলেও পরে কাজ নেন পণ্য উৎপাদনকারী

একটি প্রতিষ্ঠানে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে চলতে থাকে বই সংগ্রহের কাজ। বই সংগ্রহের পেছনে ছুটতে গিয়ে হাতছাড়া হয়ে যায় চাকরি। চাকরি হাতছাড়া হলেও দমে যাননি। বরং নতুন উদ্যোমে বই পড়ার আগ্রহটা অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পুরাতন বই সংগ্রহের কাজ শুরু করেন।

ওমর শরীফ ২০০১ সাল থেকে জোরেশোরে শুরু করেন বই সংগ্রহের কাজ। বিভিন্ন বইয়ের দোকানের সামনে ঘুরতেন। কোথাও বইয়ের সন্ধান পেলে ছুটে যেতেন তাদের বাড়িতে। কম দামে বই কিনে আনতেন। আবার পুরোনো কাগজ-বিক্রেতা বা ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকেও বই কিনতেন। এভাবে সংগ্রহ করতে করতে বইয়ের এই বিশাল ভান্ডার গড়ে তোলেন তিনি।

একসময়ে তার ঠাঁই হয় শহিদ জররেজ মার্কেটে। বই সংগ্রহ করতে গিয়ে পরিচয় হয় পুরাতন বই ব্যবসায়ী রুহুল আমিনের সাথে। চেনাজানা ও বইয়ের প্রতি প্রচÐ আগ্রহ থেকেই রুহুল আমিন তাকে নিজের দোকানের একটি অংশ ছেড়ে দেন বিনামূল্যে। আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় পাঠকের সঙ্গে তার বই লেনদেনের সম্পর্ক। শুরুতে মাত্র দুই টাকার বিনিময়ে শিক্ষার্থীসহ নানা পেশার পাঠককে বই ভাড়া দেয়া শুরু করেন তিনি। এখন অবশ্য বইয়ের প্রকারভেদে তা বেড়ে ১০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে। পাঠকদের আগ্রহ বাড়াতে কখনো বিনিময় ছাড়াও বই দেন তিনি। আবার কারো যদি বই পড়ে ভালো লাগে, তাহলে বিনামূল্যেও তাকে বই পড়তে আরো বই দেন। ভাড়া নেওয়া বই অনেক সময় কেউ কেউ ফেরত দেয় না। তবে অধিকাংশ পাঠকই ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে বই ফেরত দিয়ে নতুন করে বই নিয়ে যান বলে জানান তিনি। খাতা কলমে সঠিক হিসেব না থাকলেও বর্তমানে তার বই ভাড়া নেয়ার পাঠকের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। যদিও সবাই এখন সক্রিয় না।

ওমর শরীফ ব্যক্তি জীবনে স্ত্রী ও দুই ছেলে সন্তান নিয়ে বর্তমানে মুলাটোল এলাকাতে বসবাস করছেন। বই ভাড়া আর বিক্রি থেকে সামান্য যে আয় হয় তাতেই কোনো রকমে সংসার চলছে তার। তবে প্রচার বিমুখ ওমর শরীফ বই পড়তে এবং বই পড়াতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন।

বই দাদুর দোকানে গেলেই দেখা মিলবে বইপ্রেমিদের। কেউ আসেন বই নিতে আবার

কেউ আসেন বই জমা দিতে। যারা নিয়মিত বই নিয়ে থাকেন তারা সবাই সময়ের আগেই জমা দিয়ে নতুন বই নিয়ে থাকেন। এমন কয়েকজন পাঠকের সাথে কথা হয় প্রতিবেদকের সাথে। ছড়াকার ও গীতিকার এস এম খলিল বাবু বলেন, সাহিত্যের যে কোন বই এখানে পাওয়া

যায়। নামমাত্র মুল্যে সেটি ভাড়া নেয়া যায়। আমরা সেই সুযোগটাই নিয়ে থাকি। শরীফ ভাই নতুন নতুন বই আসলে তিনি খবর পাঠান। আমরা নিয়ে যাই। পড়া শেষে আবার জমা দিই। ছড়াকার বেলায়েত হোসেনও একই কথা জানান। তিনি বেশিরভাগ ছড়া সম্বলিত বই ভাড়া নিয়ে থাকেন। পড়া হলেও ফিরত আবারো বই নেন তিনি। রংপুর টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ফারহানা বিথি বলেন, পুরাতন বই কিনতে এসে বইদাদুর কথা জানতে পেরেছি। প্রায় তিন বছর ধরে ভাড়ায় পরেন তিনি। তাছাড়া বই ভাড়া দেওয়ার বিষয়টা বেশ ভালো লেগেছে তার।

অল্প টাকায় বই নিয়ে পড়া যায়। একই প্রতিষ্ঠানে আসিফুল ইসলাম জানান, তিনিও বই ভাড়ায় নিয়ে পড়ে থাকেন। এভাবে রংপুর টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজের মতো সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, পুলিশ লাইন্স স্কুল এন্ড কলেজ, রংপুর সরকারি কলেজ, রংপুর জিলা স্কুলসহ বেশ কিছু স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী নিয়মিত বই ভাড়ায় নেন। নাহিদা ইয়াসমিন পেশা সমাজসেবা কর্মকর্তা। চাকরি জীবনে ব্যস্ত থাকলেও অবসরে লেখালেখি করেন তিনি। লেখালেখিতে যে কোনো বইয়ের প্রয়োজনে বইদাদুর সহযোগিতা নিয়ে থাকেন তিনি। কেননা বইদাদুর সংগ্রহে অনেক বেশি দুষ্প্রাপ্য বই রয়েছে, যা অন্য কোথাও সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না।

এদিকে বইদাদু ওমর শরীফ যার আন্তরিক সহযোগিতায় শহিদ জররেজ মার্কেটে ঠাঁই হয়েছে, সেই কম দামি বইমেলা দোকানের মালিক রুহুল আমীন মারা গেছেন প্রায় দুই বছর আগে। এখন তার ছেলেরা বইয়ের ব্যবসা করছেন। কথা হয় মেঝো ছেলে তপুর সাথে। তপু জানান, ওমর দাদুর বই পড়ার আগ্রহ দেখে বাবা দোকানের একটি অংশ বিনামূল্যে দিয়েছেন। সেখানে দাদু নিজে বই পড়েন এবং ভাড়াও দেন। প্রতিদিনই সেখানে পাঠক আসে। পাঠকদের বই পড়তে উৎসাহিত করেন। এভাবেই দাদু অল্প টাকার বিনিময়ে বই পড়াতে আগ্রহী করে তোলেন পাঠককে।

ওমর শরীফ আক্ষেপ করে বলেন, বয়স বাড়ছে, নানা অসুখ পেয়ে বসছে। তাছাড়া দ্রব্যমুল্যের ঊর্ধ্বগতিতে এখন আর পর্যাপ্ত বই সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। সরকারি বেসরকারিভাবে কিছু বই সংগ্রহে সহযোগিতা করলে উপকার হতো। এখন পর্যন্ত কেউ সহযোগিতায় এগিয়ে আসেননি।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়