১১ বৈশাখ, ১৪৩১ - ২৫ এপ্রিল, ২০২৪ - 25 April, 2024
amader protidin

পা দিয়ে লিখেই লিমনের পঙ্গুত্ব জয়

আমাদের প্রতিদিন
1 year ago
657


বগুড়া ব্যুরো:

লিমন। বগুড়ার গাবতলী উপজেলার নশিপুর ইউনিয়নের বাগবাড়ি এলাকার শহিদুল ইসলাম রতনের ছেলে। পরিবারের সঙ্গে তার বর্তমান বাসস্থল গাতবলী পৌর এলাকার মাস্টারপাড়ায়। বাবা শহিদুল পেশায় পান দোকানদার। বগুড়া শহরের আল আমিন কমপ্লেক্সের নিচে থাকা ছোট্ট একটা দোকানের আয়েই চলে তাদের চার সদস্যের পরিবার।

নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর এই সংসারেই পঙ্গুত্ব নিয়ে জন্ম হয় লিমনের। তবে জীবন গড়ার পথে থেমে যায়নি সে। মানসিক শক্তি দিয়ে সব প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে পা দিয়ে লিখেই এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৪ দশমিক ৮৩ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে।

জন্মগত এমন সমস্যায় থেমে না যাওয়া উঠতি বয়সী এই তরুণের পুরো নাম রাকিবুল হাসান লিমন। আর দশটা মানুষের মতো তার দুটো হাত থাকলেও তা অকেজো। কথা বলাতেও রয়েছে অস্পষ্টতা। প্রকৃতির রহস্যে এমন পরিণামের শিকার হয়েও মনের অদম্য ইচ্ছায় পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে লিমন।

শহিদুল ও লতা দম্পতির আরও এক ছেলে রয়েছে। তবে সে লিমনের থেকে ছোট। আবার শারীরিক ও মানসিকভাবেও পুরোপুরি সুস্থ।

এ বছর বগুড়া সদর উপজেলার গাবতলী তাহেরা টেকনিকাল মাল্টিলিঙ্গুয়াল শর্টহ্যান্ড কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউটের কারিগরি বিভাগ থেকে এইএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয় লিমন। এর আগে স্থানীয় গাবতলী পূর্বপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে জিপিএ-৪ দশমিক ১১ পেয়ে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোয় সে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি লিমন সাবলীল ভঙ্গিতেই ব্যবহার করতে পারেন কম্পিউটার।

আমি পা দিয়ে লিখে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলাম। এবার ইচ্ছে বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজে বিবিএ নিয়ে পড়াশোনা করার। পড়াশোনা শেষ করে পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নিতে চাই। তাই স্বাবলম্বী হওয়ার সংগ্রামে নেমেছি।

মুখের আড়ষ্টতায় কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে রাকিবুল হাসান লিমন ২২ বছরের অদম্য এই তরুণ পলিওমাইলাইটিস উইথ মেনিনজাইটিস নামক রোগে আক্রান্ত। এই রোগের কারণে তার হাত দুটোই অকেজো। ঠোঁটও বাঁকা। এ জন্য কথা অস্পষ্ট শোনা যায়। কাজের সময় লিমনের দুই হাত একটির ওপর অপরটি রেখে বেঁধে দিতে হয় পরিবারের কাউকে। হাত খোলা অবস্থায় কাজ করতে পারে না সে। এমনকি বসে থাকার মতো শক্তিও নেই লিমনের। দীর্ঘসময় একটানা হাঁটতেও পারে না।

এমন শত প্রতিবন্ধকতার মাঝেও ছেলের ভালো ফলাফলে উচ্ছ্বাসিত লিমনের মা লতা খাতুন। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, শারীরিকভাবে ভারসাম্য না পাওয়ায় হাঁটতে গিয়ে কিছুক্ষণ পরপরই পড়ে যায় লিমন। এ নিয়ে পরিবারের সদস্যরা হতাশ হলেও ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ার প্রতি প্রবল ইচ্ছা ছিল লিমনের। বিষয়টি নজরে আসে আমাদের। পরে প্রাথমিক সমাপনী, জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষাতে ভালো ফল করে লিমন।

সন্তানের অদম্য এই যাত্রায় খুশি লিমনের বাবা শহিদুল ইসলামও। তিনি বলেন, ‘ছেলের প্রতিবন্ধকতায় আমার কোনো কষ্ট নেই। আমি মূর্খ মানুষ, আমার ছেলে প্রতিবন্ধী হয়েও পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে, বিষয়টি আমার জন্য গর্বেরই। প্রতিবন্ধকতা নিয়েও ছেলে শিক্ষিত হচ্ছে, এটাই বড় কথা। ছেলে যতদূর চাইবে কষ্ট করে হলেও আমি পড়াশোনা করাব।’

HSC শুধু শহিদুল-লতা দম্পতিই নন, লিমনের এই সাফল্যে উচ্ছ্বাসিত তার শিক্ষকরাও। তাহেরা টেকনিকাল মাল্টিলিঙ্গুয়াল শর্টহ্যান্ড কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ মাকছুদা খাতুন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘রাকিবুল হাসান লিমন আমাদের কলেজের শিক্ষার্থী। তার মেধার প্রশংসা আমাদের কলেজ শিক্ষকরা প্রায় করেন। সে জন্ম থেকে প্রতিবন্ধী হয়েও নানা প্রতিবন্ধকতা জয় করেছে, দেখিয়ে দিয়েছে সমাজকে। শুধু পড়াশোনা না, কম্পিউটার প্রযুক্তিতেও সে দক্ষ। জন্ম থেকেই তার দুটি হাত অকেজো। অথচ পা দিয়েই লিমনের যুদ্ধ চলছে। আমি আশা রাখি, সে ভবিষ্যতে অনেক ভালোকিছু করবে। তবে এখন সবচেয়ে বেশি দরকার সরকারের সহযোগিতা।’

লিমনের শারীরিক জটিলতার বিষয়ে বগুড়া সাইক মেডিকেল ইনস্টিটিউটের লেকচারার ডা. নাফিউজ্জামান চৌধুরী ঢাকা মেইলকে বলেন, রাকিবুল হাসান লিমন শারীরিকভাবে পলিওমাইলাইটিস উইথ মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত। জন্মগতভাবে এ রোগ হয়ে থাকে। চিকিৎসা করেও রোগী সুস্থ হতে পারে না। তবে মুখের কথার অস্পষ্টতা ভালো হওয়া সম্ভব।

নাফিউজ্জামান আরও জানান, এ ধরণের রোগীদের সার্বক্ষণিক নিবিড় পরিচর্যায় রাখা প্রয়োজন। কারও সহানুভূতি নয়, মানুষ হিসেবে মানবিক সহায়তা পেলে লিমনের মতো ছেলেরাও তাদের জায়গা থেকে ভালোকিছু করতে পারবে।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়