আশরাফুজ্জামান বাবু, বদরগঞ্জ, রংপুর:
রংপুরের ঐতিহ্যবাহী জনপদ বদরগঞ্জ। ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বদরগঞ্জ পৌরসভা। পৌরশহর থেকে পার্বতীপুরমুখী সড়ক ধরে এক কিলোমিটার গেলেই পৌরশহরের পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডভুক্ত যুগীপাড়া মহল্লা। অন্তত দশ বা পনেরো বছর আগেও শতবর্ষী এ মহল্লার প্রায় সবারই পেশা ছিল শামুক থেকে চুন বানিয়ে বিক্রয় করা। আর সে কারনেই ‘যুগীপাড়া’ নামে পরিচিতি লাভ করেছিল মহল্লাটি। কিন্তু বর্তমানে বদরগঞ্জে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত মানুষের সংখ্যা প্রায় শূণ্যের কোটায়।
বাংলাদেশের গ্রামীণ মানুষের সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে পান সুপারি। বিয়ে—শাদিসহ যে কোন খানাপিনায় পান সুপারি পরিবেশন অপরিহার্য উপাদান। পান খেয়ে মুখ লাল করতে এবং পান সুপারির ঝাল এবং কষ্টা ভাবটা দূর করে একে মুখরোচক করতে যে উপাদানটি কার্যকর ভূমিকা রাখে তা হচ্ছে ঝিনুকের চুন। এই চুন ছাড়া পান খাওয়ার কথা ভাবাই যায় না। খাল, বিল, নদী থেকে ঝিনুক কুড়িয়ে, নানা পদ্ধতিতে যারা চুন তৈরি করে তারা যুগী বা চুনারু নামে পরিচিত। এ কারণে পান খাওয়ার এই ঝিনুক চুনকে যুগীর চুনও বলা হয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের কতিপয় যুগী পরিবার এখনও রংপুরের বদরগঞ্জ পৌরশহরের যুগীপাড়ায় তাদের আদি পেশাকে আঁকড়ে ধরে তাদের জীবন—জীবিকা নির্বাহ করছে।
বর্তমানে যুগীপাড়ায় ঝিনুক থেকে চুন বানানো পেশার সঙ্গে নিয়মিতভাবে সক্রিয় আছেন মাত্র দু’জন। আর অনিয়মিত ভাবে জড়িত আছেন দু’জন। সক্রিয় দু’জন হলেন বিপিন দেবনাথ ও বিষেদু। অনিয়মিত দু’জন হলেন অজিন ও খগেন। বিপিন ও বিষেদু বদরগঞ্জ পৌরসভার শহরে শামুকের চুন বিক্রয় করেন। অপর দুজন বদরগঞ্জ উপজেলার ইউনিয়নের বিভিন্ন পাড়ায় বা গ্রামে ঘুরে চুন বিক্রয় করেন মাঝে মধ্যে।
যুগীপাড়ার সবচেয়ে প্রবীণ যুগী বিপিন চন্দ্র দেবনাথ। এখন তার বয়স নব্বই ছুঁইছঁুই। তিনি জানান, তার বাবা টাটি দেবনাথ ও মা ধনেশ্বরী এ কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাদের দেখে দেখে বিপিনও এ কাজ রপ্ত করেছেন। স্বাধীনতার পর পরই তার বাবা—মা লোকান্তরিত হলে হাল ধরেন বিপিন। স্ত্রী চেকো বালা (৭৭) বিপিনের এ কাজের বিশাবস্ত সঙ্গী ও সহযোগী।
বিপিন ও চেকো বালা’র পাঁচ সন্তান। বিয়ে হওয়ায় স্বামীর বাড়ি চলে গেছে তিন মেয়ে। আর দুই ছেলে বাতাসু ও বাচ্চু। এ পেশার ভবিষ্যৎ নিয়ে জানতে চাইলে বিপিন দেবনাথ বলেন, আমার মৃত্যুর পর আমার পরিবার থেকে এ পেশার সঙ্গে কেউ জড়িত থাকবে কি না জানি না। কারন, আমার ছেলে মেয়েরা কেউ এ কাজ রপ্ত করতে পারে নি। শুধু ছোটছেলেটা একটু একটু শিখেছে।
বিপিন দেবনাথের বড় ছেলে বাতাসু দেবনাথ বলেন, আমি এ কাজ একদমই করতে পানি না। আমার ছোট ভাই বাচ্চু একটু একটু করতে পারে। ‘এই কাজের প্রতি আপনার আগ্রহ নেই কেন’ জানতে চাইলে বাতাসু বলেন, এ ব্যবসায় এখন সন্তোষজনক লাভ নেই। শামুক পাওয়া যাচ্ছেনা। চড়া দামে কিনতে হয় বাইরে থেকে। খড়িসহ আনুষাঙ্গিক সব খরচ মিলে একদমই লাভ নেই।
বদরগঞ্জ পৌরশহরে সপ্তাহে দু’দিন হাট বসে। সোম ও বৃহস্পতিবার। এই দু’দিন বিপিন দেবনাথ পৌরশহরের পানবাজারে বিক্রি করে নিজের হাতের তৈরি ঝিনুকের চুন। তিনি বলেন, ‘আমি যতদিন আছি, কাজটা করে যাবো। আমার পরে আর কে করবে, আমি জানিনা’।