আহসান হাবীব নীলু, কুড়িগ্রাম:
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুড়িগ্রাম-১ আসনে (নাগেশ্বরী ও ভূরুঙ্গামারী) সম্ভাব্য প্রার্থীদের ভোটের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। সম্ভাব্য প্রার্থীরা শুরু করেছেন জনসংযোগ। যোগ দিচ্ছেন স্থানীয় বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে। সভা-সমাবেশ, উঠান বৈঠক, পোষ্টার, বিলবোর্ডে নিজেদের অস্তিত্ব তুলে ধরার পাশাপাশি এবং স্থানীয় বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকায় নাম লিখিয়েছেন তারা। এবার এই আসনে বিএনপি, জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের মধ্যে ত্রিমুখী লড়াইয়ের কথা বলছেন ভোটাররা। তবে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নিলে বদলে যাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার চিত্র।
জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন ও খেলাফত মজলিস ইতোমধ্যে এই আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। জামায়াতের প্রার্থী সহকারী অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম, ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী হারিসুল ইসলাম রনি, খেলাফত আন্দোলনের প্রার্থী শহিদুল ইসলাম ফয়েজি।
বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে সবার আগে উচ্চারিত হচ্ছে সাবেক এমপি ও কেন্দ্রীয় বিএনপির সদস্য সাইফুর রহমান রানার নাম। তবে উপজেলা বিএনপি আহবায়ক গোলাম রসুল রাজা, ড্যাব নেতা ডা. ইউনুছ আলী ও ডা. মাহফুজার রহমান মারুফ দলের মনোনয়ন পেতে লবিং শুরু করেছেন। এর বাইরে জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি মোস্তাফিজুর রহমান, গণঅধিকার পরিষদের বিন ইয়ামিন মোল্লাসহ কয়েকজন সম্ভাব্য প্রার্থীও শুরু করেছেন জনসংযোগ।
নাগেশ্বরী ও ভূরুঙ্গামারী উপজেলা নিয়ে কুড়িগ্রাম-১ আসন। ২৪টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় নিয়ে গঠিত এ আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ৫ লাখ ২৯ হাজার ১৬৩ জন। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৬৩ হাজার ২৫৩ জন ও নারী ভোটার ২ লাখ ৬৫ হাজার ৯০৭জন, তৃতীয় লিঙ্গের তিনজন।
কুড়িগ্রাম-১ আসনটি নানা কারণে জাতীয়পার্টির দুর্গ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এ আসনের জনপ্রিয় সংসদ সদস্য আ.খ.ম শহিদুল ইসলাম বাচ্চুর মৃত্যুর পর তার ভাগ্নে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি এ.কে.এম মোস্তাফিজার রহমান ৫ বার সংসদ নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ প্রার্থী আসলাম সওদাগরের কাছে হেরে গেলেও ২০২৪ সালের সর্বশেষ নির্বাচনে তিনি মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। মোস্তাফিজার রহমান এই আসনে সব সময় শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বি।
এই আসনে জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমান রানা সব সময় শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলছেন। ‘৯৬ এর ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। তবে ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে সামান্য ভোটে হেরে যান তিনি। যদিও তিনি অভিযোগ করেছেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনে কারচুপি করে শেষ মুহূর্তে হারিয়ে দেয়া হয় তাকে। নির্বাচনী এলাকার সর্বত্র-বিশেষ করে দুধকুমারের ওপারের চরাঞ্চলের কয়েকটি ইউনিয়নে তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তা রয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তিনি এবার নিশ্চিত বিজয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। এ আসনে এতোদিন সাইফুর রহমান রানার একক আধিপত্য ছিল। তবে এখন সাইফুর রানার গ্রুপ ছাড়াও বিরোধী একটি গ্রুপ তাকে চ্যালেঞ্জ করছে। এই গ্রুপিং নিয়ে একাধিকবার সহিংসতাও হয়েছে। দুটি গ্রুপ একত্রিত না হলে ভোটের রাজনীতিতে প্রতিপক্ষ সুবিধা নিতে পারে বলে জানিয়েছে বিএনপির একাধিক সূত্র।
বিএনপির মনোনয়ন প্রার্থী সাইফুর রহমান রানা বলেন, সারাবছর আমাদের জনসংযোগ কার্যক্রম চলে আসছে। এখন আরো গতি বেড়েছে। যেখানেই যাচ্ছি, জনগনের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। তিনি জানান, দুধকুমারের ভাঙনরোধ, কালিগঞ্জে দুধকুমার সেতু, সোনাহাট স্থলবন্দরে ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট চালু ও কর্মসংস্থানের জন্য ইপিজেড স্থাপন তাঁর উন্নয়ন পরিকল্পনায় আছে। এছাড়া মাদক ও সন্ত্রাস প্রতিরোধ, সামাজিক শৃংখলা রক্ষা, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে তাঁর এক গুচ্ছ পরিকল্পনা আছে।
নাগেশ্বরী উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী গোলাম রসুল রাজা বলেন, আসনটিতে বিএনপির ভোটব্যাংক থাকলেও জোট মহাজোটের কারণে বিএনপির প্রার্থী বারবার পরাজিত হয়েছে। আসন্ন নির্বাচনে আসনটি পাওয়ার জন্য আমরা জোরগতিতে কাজ করে যাচ্ছি। আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের নেতা ছিলাম। এরপর এলাকায় এসে যুবদলকে সংগঠিত করি। পরবর্তি সময়ে বিএনপিকে সংগঠিত করতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছি। দল আমার ত্যাগ, সাংগঠনিক দক্ষতা ও জনপ্রিয়তা মূল্যায়ন করবে বলে আশাবাদী।
জামায়াতে ইসলামের মনোনীত প্রার্থী আনোয়ারুল ইসলাম রংপুর মডেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক। তিনি জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রিয় ইউনিটের সদস্য এবং রংপুর মহানগর শাখার সাবেক নেতা। তিনি বলেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলাম ন্যায় ও ইনসাফের ভিত্তিক বৈষম্যহীন একটি সমাজ কায়েম করতে চায়। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এলাকার সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথা বলে প্রধান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছি।
তিনি আরো বলেন, কুড়িগ্রাম জেলা দীর্ঘদিন ধরে বৈষম্যের শিকার। আমি প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে কথা বলছি। আল্লাহপাক যদি জনগনের খেদমত করার তৌফিক দান করেন, তাহলে আমার আসনে মানুষের সমস্যা-সম্ভাবনা নিয়ে পর্যায়ক্রমে কাজ করব।
গণ অধিকার পরিষদের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে ছাত্র অধিকার পরিষদের কেন্দ্রিয় সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা ইতোমধ্যে নির্বাচনী এলাকায় সভা সমাবেশ শুরু করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের সামনের কাতারের একজন নেতা হিসেবে এবং তরুণ প্রার্থী হিসেবে তিনি ব্যাপক সাড়া পাচ্ছেন। দলের প্রার্থী হিসেবে তিনি উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানসহ জনগনের ভাগ্য পরির্বতনের দাবী নিয়ে উচ্চকণ্ঠ থাকবেন।
ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী হারিসুল ইসলাম রনি বলেন, ‘নির্বাচনী এলাকায় জনসংযোগকালে জনগনের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। এই এলাকার মানুষ দীর্ঘদিন উন্নয়ন বঞ্চিত ছিল। উন্নয়ন হয়েছে একটি শ্রেণির। তাই তারা সৎ, নিষ্ঠাবান ও ইসলামী আদর্শের নেতৃত্ব চায়। নির্বাচিত হলে নদী ভাঙন রোধ, কর্মসংস্থান বৃদ্ধির পাশাপাশি ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে কাজ করবো ইনসআল্লাহ।’
বরাবরের মত এবারো এ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন ভূরুঙ্গামারী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হাই মাষ্টার। এলক্ষ্যে অব্যাহত রেখেছেন তিনি তার গণসংযোগ। তিনি ভূরুঙ্গামারী উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান। ২০১৪ সালের নির্বাচনে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে গেলেও অভিনব প্রচার কৌশল ও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোট পেয়ে চমক সৃষ্টি করেন। ২০২৪ সালের নির্বাচনসহ আগের কয়েকটি নির্বাচনে জাকের পার্টির প্রার্থী হিসেবে নিজের প্রচার নিজেই করে আলোচনায় থাকেন তিনি।
কুড়িগ্রাম-১ আসনটি সীমান্তবর্তী অঞ্চল হওয়ায় সীমান্তবাসীর নিরাপত্তা, মাদক ও গবাদিপশু চোরাচালান রোধ জনপ্রতিনিধিদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। রয়েছে বিশাল নদীপথও। নাগেশ্বরী ও ভূরুঙ্গামারীর একাধিক ইউনিয়ন ভারতের সীমান্ত ঘেঁষা হওয়ায় গবাদি চোরাচালান, মাদক, অনুপ্রবেশ এবং নিরাপত্তা হুমকির মুখে রয়েছে। তরুণদের একটি অংশ মাদকে জড়িয়ে পড়ছে বলে অভিযোগ উঠছে বিভিন্ন মহল থেকে। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য তরুণ ভোটাররা যোগ্য প্রার্থী নির্বাচনের জন্য মুখিয়ে আছে।