ঘোড়াঘাটে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার আগেই হাতের স্পর্শেই কার্পেটিং উঠে যাচ্ছে

2025-12-30 21:22:31

ঘোড়াঘাট প্রতিনিধি:

দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট পৌরসভার চলমান সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার আগেই ভয়াবহ অনিয়ম ও নিম্নমানের চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রায় ৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন সড়কের কার্পেটিং কাজ এখনো চলমান থাকলেও, এর মধ্যেই বিভিন্ন স্থানে পিচ হাতের স্পর্শেই উঠে যাচ্ছে। কোথাও পা দিয়ে সামান্য নাড়ালেই পিচ খুলে পড়ছে, আবার কোথাও শিশুরা খেলতে খেলতেই সেই পিচ উঠছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, সদ্য কার্পেটিং করা সড়কের বিভিন্ন অংশে পিচের দুর্বল। সঠিকভাবে রোলার ও কম্প্যাকশন না করায় পিচ ভালোভাবে বসেনি। নির্ধারিত থিকনেস ও সংযোগ না থাকায় যে কোনো সময় পুরো সড়কই নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। পৌরসভা সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আইআইডিবি (নগর উন্নয়ন) প্রকল্পের আওতায় ঘোড়াঘাট পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের আংশিক এবং ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মোট ৫ দশমিক ১ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়নের দায়িত্ব পায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এমএস রুনা এন্টারপ্রাইজ। চারটি ভিন্ন প্যাকেজে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কথা রয়েছে। চলতি বছরের জুলাই মাসে কাজ শুরু হয় এবং ২০২৬ সালের জুলাই মাসের মধ্যে কাজ শেষ করার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমানে কাজের গড় অগ্রগতি প্রায় ৪০ শতাংশ বলে ধারণা করা হচ্ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, কাজ শুরু থেকেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এক নম্বর ইটের পরিবর্তে নিম্নমানের তিন নম্বর ইটের খোয়া ব্যবহার করেছে। অনেক জায়গায় সঠিকভাবে খোয়া না দিয়ে শুধু বালু ভরাট করে উপর দিয়ে দায়সারা লোক দেখানো কাজ করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয়দের অভিযোগ উঠলেও, প্রতিশ্রুতি দিয়েও কাজের মান কোনো দৃশ্যমান পরিবর্তন আনা হয়নি। বরং ওই অবস্থাতেই রোলার চালিয়ে দ্রুত কার্পেটিং শুরু করা হয়। খোদাদাতপুর গ্রামের বাসিন্দা বাবু, সালাম, আজিজ, বুলু, হিরো, কিরন, এজাজ, ইয়াসিরসহ শতাধিক এলাকাবাসী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “মাত্র দুই দিন আগেই সামান্য মুরগির পা লেগে রাস্তা থেকে পিচ উঠে গেছে। শিশুরা সেই পিচ তুলে খেলছে। ছোট বাচ্চা আর মুরগিই যদি পিচ তুলে ফেলে, ট্রাক্টর বা ভারী গাড়ি চললে কী হতে পারে?” স্থানীয়দের আরও অভিযোগ, কার্পেটিংয়ের ওপর ট্রাক্টরের চাকা একবার জোরে ব্রেক কষলেই পিচের বড় অংশ উঠে যাওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে। তাদের আশঙ্কা, কয়েকদিন পর নামমাত্র কাজ দেখিয়ে বিল তুলে ঠিকাদার ও সংশি¬ষ্টরা এলাকা ছেড়ে চলে যাবে। তবে মাঠপর্যায়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত পৌরসভার সহকারী ইঞ্জিনিয়ার আনোয়ার পারভেজের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তিনি শুরুতে নিস্নমানের ইট ব্যবহারের কথা স্বীকার করলেও, কাজের অনিয়ম প্রমাণিত হওয়ার পর কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেননি। স্থানীয়রা বলছেন, আসলে কার্যত কাজের দিকে নজরই দেননি তিনি।

স্থানীয়দের অভিযোগ অনুযায়ী, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এমএস রুনা এন্টারপ্রাইজের সঙ্গে সহকারী ইঞ্জিনিয়ার আনোয়ার পারভেজের ঘনিষ্ঠ সমন্বয় ও নমনীয় ভূমিকার সুযোগেই বারবার নিম্নমানের কাজ চলমান থাকলেও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কাজের ত্রুটি চোখে পড়ার পরও তাৎক্ষণিক কাজ বন্ধ, সংশোধন বা লিখিত নির্দেশনা না থাকায় এলাকাবাসীর মধ্যে এই ধারণা আরও জোরালো হয়েছে যে ঠিকাদারের সঙ্গে সংশি¬ষ্ট প্রকৌশলীর ‘সহজ যোগাযোগ ও সুবিধাজনক অবস্থান’ই কাজের মানহীনতার বড় কারণ। এলাকাবাসীর অভিযোগ একটাই পৌর প্রশাসক ভালো কাজ চান, কিন্তু তার নির্দেশ মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। পৌরসভার সংশি¬ষ্ট ইঞ্জিনিয়ার, ঠিকাদার ও সাইট ইঞ্জিনিয়ারদের গাফিলতি ও দায়িত্বহীনতার কারণে কোটি টাকার প্রকল্প প্রকাশ্যেই নিম্নমানের কাজে পরিণত হচ্ছে। এদিকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রজেক্ট ম্যানেজার সুনীল প্রথমে কিছু কাজ খারাপ হয়েছে বলে স্বীকার করলেও পরে তা অস্বীকার করেন। পিচ উঠে যাওয়ার দৃশ্য সামনে দেখানোর পরও তিনি বলেন “৩ থেকে ৪ দিন সময় না দিলে পিচ উঠবেই।”

অন্যদিকে ঠিকাদার নজরুল ইসলাম নিজের ৪০ বছরের অভিজ্ঞতার কথা উলে¬খ করলেও বাস্তব চিত্রের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে একপর্যায়ে স্পিড ব্রেকার প্রসঙ্গ টেনে কথার মোড় ঘুরিয়ে দেন। কাজের অনিয়ম নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে একপর্যায়ে তিনি দায়িত্বশীল আচরণের পরিবর্তে সাংবাদিকদের হেয় করে কথা বলেন। তিনি ইঙ্গিতে জানান, সংবাদ প্রকাশ করেও কোনো লাভ নেই, কারণ কাজটি মন্ত্রণালয় পর্যায় থেকেই অনুমোদন নিয়ে করা হয়েছে। এমন মন্তব্যে উপস্থিত এলাকাবাসীর মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রভাব ও দায়মুক্তি নিয়েই নতুন করে প্রশ্ন ওঠে। এ বিষয়ে পৌর প্রশাসক আব্দুল আল মামুন কাওসার শেখ বলেন, “আমি একাধিকবার এই কাজ পরিদর্শন করেছি। ঠিকাদারকে স্পষ্টভাবে বলেছি, কাজ খারাপ হলে বিল দেওয়া হবে না। পৌরসভার ইঞ্জিনিয়ারকে তদারকির নির্দেশ দিয়েছি। এরপরও কেন চলমান কাজেই কার্পেটিং উঠে যাচ্ছে, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”