আহসান হাবীব নীলু,কুড়িগ্রাম:
নারী শ্রমিক মোহছেনা বেগমের গলায় ক্ষোভের আগুন। বলেন,‘‘আমি চার মেম্বারের আমল থাকি মাটিকাটার কাজ করি। আমি ভোট দেই নাই দেখি আমার নাম কেটে দিয়েছে। এজন্য মামুন মেম্বার বলে ‘শেখ হাসিনা আসলেও তোমার নাম থবোনা’।” উলিপুর উপজেলার গুনাইগাছ ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের মেম্বার মামুনের বিরুদ্ধে এ বিষয়ে উপজেলায় লিখিত অভিযোগ করা হলেও কোন কাজ হয়নি।উলিপুর উপজেলার গুনাইগাছ ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের শ্রমিক সর্দার স্বাধীন মিয়া বলেন, আমাদের ওয়ার্ডের মেম্বার অনিয়ম করে আমাকেসহ ১৫জন শ্রমিককে ছাটাই করে তার লোকজনকে নিয়েছে। শ্রমিক ফাতেমা বেগম বলেন,মাটিকাটা কর্মসূচির শুরু থেকে আমি কাজ করেছি। একাউন্ট আছে,বিলও পাইছিলং। কিন্তু মামুন মেম্বার পাঁচ হাজার টাকা চাইছিল। সেই টাকা দিবার পাই নাই দেখি মাটিকাটাত নাম থয় নাই।
কুড়িগ্রাম জেলায় হতদরিদ্রদের জন্য চালুকৃত ১১০দিনের ইজিপিপি প্লাস বা কর্মসৃজন কর্মসূচির নামে জনপ্রতিনিধিরা পকেট ভারী করছে। ভিলেজ পলিটিক্সের কারণে সুবিধাভোগীদের সিমকার্ড না দিয়ে এবং শ্রমিক ছাটাইয়ের অযুহাতে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেবার অভিযোগ উঠেছে। অনিয়ম আর দুর্নীতির অভিযোগে জেলা এবং উপজেলা প্রশাসন বরাবর একাধিক লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
কুড়িগ্রাম সদর,রাজারহাট এবং উলিপুর উপজেলায় ইজিপিপি প্লাস বা কর্মসৃজন কর্মসূচি প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়মের চিত্র উঠে আসে। জনপ্রতিনিধিদের স্বচ্ছল আতœীয়স্বজনের নামসহ উৎকোচের বিনিময়ে সুবিধাভোগী নির্বাচন করা,সুবিধাভোগীর নিকট সিমকার্ড না দিয়ে জনপ্রতিনিধিরা তাদের নিকট রেখে ন্যায্য বিল না দেয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে জেলার সিংহভাগ ইউনিয়ন গুলোতে।
সরেজমিনে দেখাযায়,(১৩ মে)শনিবার দুপুরে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডে কর্মসৃজন কর্মসূচির শ্রমিকরা ধান কাটছে। দিনমুজরির বিনিময়ে নয় কর্মসৃজন কর্মসূচি প্রকল্পের সভাপতি আব্দুল হক তার নিজের জমির ধান কেটে নেন প্রকল্পের শ্রমিক দিয়ে।এছাড়াও কিছু শ্রমিক দিয়ে তার বাড়িতে মাটি কাটার কাজ করান। এই ওয়ার্ডে চলমান কর্মসূচিতে মেম্বারের আত্বীয়স্বজদের থাকলেও তারা কাজ না করলেও তাদের নাম বিল তোলা হয়েছে।
শ্রমিক ভোলা মিয়া বলেন,সরকার তো দিছে হামাক মাটি কাটপার। আর হামাক পাঠে দিছে ধান কাটপার। হামরা ১৩/১৪জন ধান কাটপার আসছি। আর বাকি গুলা মেম্বারের বাড়িত মাটি কাটপার নাগছে। ধান কাটার জন্য আলাদা কোন মজুরি দিবার নয়। ধান না কাটিয়া তো হামার উপায় নাই।
লিখিত অভিযোগকারীওই ওয়ার্ডের শ্রমিক জকরুল ইসলাম বলেন,আমি রোজার মধ্যে ১৭দিন মাটিকাটার কাজ করেছি। পরে হক মেম্বার আমার নিকট ১০হাজার টাকা দাবী করেন। টাকা না দিলে কাজে আসতে নিষেধ করেন। কষ্ট করে দু’হাজার টাকা দিয়েছি। বাকি টাকা না দেয়ায় হক মেম্বার আমার নাম বাদ দেয়। পরে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের নিকট বিচার দিলে পরিষদে সবার সামনে হক মেম্বার আমাকে দেড় হাজার টাকা ফেরত দেন। কিন্তু আর কাজ করতে দেন না। এই তালিকায় মেম্বারের স্কুল পড়–য়া ছেলে লুৎফর রহমান, ভাই ব্যবসায়ী আব্দুল খালেক,ঢাকায় এনজিও চাকুরি করে ভাই নুরনবী মিয়া, জামাই সফিকুল ইসলাম, বোন নবিনা বেগম,চেয়ারম্যানের ড্রাইভার ছামিউলসহ বেশ কিছু নাম ঢুকায়। তারা কেউ মাটিকাটার কাজ করে না।এই বিষয়ে বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিলেও কোন লাভ হয়নি।
শ্রমিক রফিকুল ইসলাম বলেন,আমি ৫/৬দিন কাজ করার পর অসুস্থ হয়ে পড়ি। শরীর সুস্থ হবার পর কাজে গেলে হক মেম্বার আমার কাছ থেকে ১০হাজার টাকা চায়। সেই টাকা দিতে না পারায় আমার নামসহ তিন জনের নাম কেটে দিয়েছে। এজন্য প্রতিবাদ করলে হুমকি দেয়।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক এক শ্রমিক বলেন,হক মেম্বার তার মর্জি মোতাবেক বিনা মজুরিতে শ্রমিকদের দিয়ে তার জমির ধান কেটে নিয়েছেন। মেম্বারের বাড়ির মাটি কেটে নিলেও কোন মজুরি দেয়নি। এই কাজের বিল মাটিকাটা বিল হিসেবে ধরা হয়েছে। এখন নাম কাটার ভয়ে বাধ্য হয়ে মেম্বারের কথা মতো কাজ করতে হয়। শ্রমিকের নামের তালিকায় তার আত্বীয় স্বজন আছে তারা কাজ করে না। কেউ তদন্তে আসলে ভাড়াটিয়া শ্রমিক এনে উপস্থিত করে মেম্বার। আর বিল তুলে হাজিরা অফিসারসহ ভাগবাটোয়ারা করে নেন।
ভোগডাঙ্গা ইউপি মেম্বার আব্দুল হক এই বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। উল্টো নিউজ না করতে বাধা প্রদান করেন।
অপরদিকে রাজারহাট উপজেলার রাজারহাট সদর ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের কিসাশত পুলকর গ্রামে ৩৭জন নারী-পুরুষ শ্রমিক মাটি কাটার কাজ করছেন। অথচ সেখানে ৪৯জন শ্রমিক কাজ করার কথা থাকলেও ওই ওয়ার্ডের আত্বীয়স্বজন শ্রমিক হওয়ায় তারা কাজ করেন না। গত ঈদের আগে এই উপজেলায় ৩২দিনের কাজের বিল দেয়া হয় ১২হাজার ৮শ টাকা। এরমধ্যে ২৬জন শ্রমিক বিলপাননি। আর বাকি শ্রমিকরা ঈদের দিন ও পরের দিন মাত্র আট হাজার টাকা মেম্বারের নিকট থেকে পেয়েছেন। এছাড়াও শ্রমিকরদের নিকট সিম থাকার কথা থাকলেও সেই সিম তাদের নিকট নেই বলে দাবী করেন।
রাজারহাটের ৩নং ওয়ার্ডের শ্রমিক সর্দার সত্বেন রায় বলেন,আমার অধিনে ৪৯জন শ্রমিক কাজ করার কথা। কিন্তু নিয়মিত কাজ ৩৭/৩৯জন নারী-পুরুষ শ্রমিক। বাকিরা আসে না কাজও করে না। ঈদের আগে আমরা ২৬জন শ্রমিক বিল ও সিম পাইনি। বাকিরা ১২হাজার ৮শ টাকা বিল হলেও তারা সব টাকা পাননি। এ নিয়ে ইউএনও স্যার, চেয়ারম্যানকে লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে।
শ্রমিক মজিদা বেগম বলেন,ঈদের আগে ৩২দিনের বিল হইচে। কিন্ত আমি বিল পাইনি। তাই মানুষের নিকট হতে পাঁচ হাজার টাকা ধার করে ঈদ পার করেছি। বিল পাইলে সেই টাকা শোধ দিবো।
শ্রমিক স্বপ্তমি রাণী বলেন,ঈদের ৩২দিনের কাজের বিল হইচে। কিন্তু ঈদের পরের দিন আশরাফ মেম্বার আমার বাড়িতে এসে আট হাজার টাকা দিছে। আমার কাছে কোন সিম নেই। সিমের কথা বললে মেম্বার বলে চেয়ারম্যানের কাছে আর চেয়ারম্যানের কাছে গেলে বলে সিম মেম্বারের কাছে। ডাক দিলে আসি কাজ করি আর বিল হলে হাতে হাতে টাকা দেয়।
এই বিষয়ে মেম্বার আশরাফ আলী তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন,ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আমরা ১০জন ইউপি সদস্য ১৪টি বিষয়ে অনিয়মের অভিযোগ এনে লিখিতভাবে অনাস্থা প্রস্তাব দিয়েছি। চেয়ারম্যানের ভয়ে শ্রমিকরা নিজেদের কাছে সিমকার্ড রেখে মেম্বারদের দোষ দিচ্ছে।
ইউপি চেয়ারম্যান এনামুল হক বলেন,মেম্বাররা যে অভিযোগ এনে অনাস্থা প্রস্তাব দিয়েছে তার কোন ভিত্তি নেই। কেননা তারা ইজিপিপি প্লাস প্রকল্পে আতœীয়স্বজন,সিমকার্ড নিজেদের কাছে রাখা এবং কম শ্রমিক দিয়ে কাজ করায়। সঠিক শ্রমিকের বিল স্বাক্ষর করায় তাদের আয় বন্ধ হয়েছে বলেই তারা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। তিনি আরও বলেন,আমার ইউনিয়নে মোট ৪৮১জন শ্রমিক। এরমধ্যে৩নং ওয়ার্ডের ২৬জন,৪নং ওয়ার্ডে ২০জন এবং ৮নং ওয়ার্ডে ৪০জন শ্রমিকসিম এবং বিল না পাওয়ার অভিযোগ দিয়েছে। এছাড়াও ২নং ওয়ার্ডে ৫৩জন শ্রমিকের মধ্যে ৩০জন, ৩নং ওয়ার্ডে ৪৯জন শ্রমিকের মধ্যে ৩৭জন এবং ৫নং ওয়ার্ডে ৫৩জনের মধ্যে ৩৩জন শ্রমিক উপস্থিত পাওয়া যায় কাজে। বাকিদের কোন হদিস নেই।
ভোট না দেবার অভিযোগ গ্রাম্য রাজনীতির স্বীকার উলিপুর উপজেলার গুনাইগাছ ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডে ১৫জন শ্রমিকের নাম ছাটাই করে নতুন নাম অন্তর্ভূক্তির অভিযোগ উঠেছে।
ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের শ্রমিক ভোলা মিয়া বলেন,আমি মাটিকাটার কর্মসূচিতে ৪শ টাকা মজুরিতে কাজ করি। কিন্তু মেম্বার ১৪জন মাটিকাটা শ্রমিক দিয়ে তার জমির ধান কেটে নিচ্ছেন।
এই বিষয়ে জেলা কো-অর্ডিনেটর এসএম জাবেদ বলেন,কুড়িগ্রাম জেলার ৯টি উপজেলার ৭৩টি ইউনিয়নে ইজিপিপি প্লাস প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। চলতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে এই প্রকল্পের উদ্বোধন হয়ে আগামী ৭জুন পর্যন্ত ইজিপিপি প্লাস প্রকল্পের প্রথম ফেজ শেষ হবে। প্রত্যেক শ্রমিক দৈনিক হাজিরা হিসেবে ৪শ টাকা এবং প্রতিটি ওয়ার্ডে একজন করে সর্দার পাবে ৪৫০টাকা করে। যারা একদিন অনুপস্থিত থাকবেন তারা কোন বিল পাবেন না। শ্রমিকদেরকে তাদের নিজস্ব মোবাইলে রকেটের মাধ্যমে এসব বিল প্রদান করা হয়। শুধুমাত্র উলিপুর উপজেলা বাদে বাকি উপজেলায় গত ২৯মার্চ পর্যন্ত শ্রমিকদের বিল পরিশোধ করা হয়েছে। এই কর্মসূচি শ্রমিকের হাজিরা দেখভাল করার জন্য জেলার ৯টি উপজেলায় ১৮জন কমিউনিটি মোবাইলাইজিং সদস্য কাজ করছে। বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন হচ্ছে।
তিনি আরো জানান, জেলায় মোট ২৭হাজার ৯২৮জন শ্রমিক মধ্যে নারী-১২হাজার ৩৯১জন এবং পুরুষ- ১৫হাজার ৫৩৭জন। এরমধ্যে ভূরুঙ্গামারী উপজেলায় নারী-এক হাজার ৩৭২জন,পুরুষ দু’হাজার ৬০জন, চররাজিবপুরে নারী-৪৫০জন,পুরুষ-৭৫১জন,চিলমারীতে নারী-৯৮৩জন,পুরুষ-৮৬৯জন,ফুলবাড়িতে নারী-৪৩৭জন,পুরুষ-এক হাজার ৯২৩জন, কুড়িগ্রাম সদরে নারী-এক হাজার ৩৮৫জন,পুরুষ-দু’হাজার ১১৬জন, রাজারহাটে নারী- এক হাজার ৬১০জন,পুরুষ- এক হাজার ২১জন, রৌমারীতে নারী-এক হাজার ৯৩৯জন, পুরুষ- ৯৯২জন এবং উলিপুর উপজেলায় নারী-দু’হাজার ৭৬৮জন এবং পুরুষ-দু’হাজার ৩০৩জন শ্রমিক রয়েছে।
জেলা প্রশাসক সাইদুল আরীফ বলেন,অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসৃজন কর্মসূচি সরকারের একটা অসাধারণ কল্যাণকর উদ্যোগ। এই কর্মসূচির মাধ্যমে অতিদরিদ্র মানুষজন তাদের জীবন জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। এই প্রকল্পে আমরা বেশ কিছু অভিযোগ পেয়েছি। নীতিমালার বাইরে যাবার কোন সুযোগ নেই। মোবাইল ব্যাকিংযের মাধ্যমে শ্রমিকদের বিল প্রদান করা হচ্ছে। তারপরও বিচ্ছিন্ন ভাবে কিছু অভিযোগ আছে। সেই অভিযোগ গুলো আমরা যাচাই-বাছাই করে আমরা কিছু সমাধান করতে পেরেছি। আর যেগুলো পেয়েন্ডিং রয়েছে সেগুলো যথাযথ প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হবে।