ঢাকা অফিস:
নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে আলোচনা—সমালোচনা চলছেই। সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে। লিখিত পরীক্ষা না থাকায় আপত্তির শেষ নেই অভিভাবকদের। এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেক শিক্ষাবিদও। অভিভাবক—শিক্ষাবিদদের আপত্তি এবং প্রশ্নের মুখে অবশেষে শিক্ষাক্রমে যুক্ত হচ্ছে ‘লিখিত পরীক্ষা’।
এতে নির্ধারিত নম্বর থাকছে না। থাকছে না নির্ধারিত সময়ও। প্রশ্নপত্রও হবে একেবারে নতুন ধাঁচে। পরীক্ষা ফেরানোর এ রূপরেখা নিয়ে কাজ করছে ১৪ সদস্যের সমন্বয় কমিটি। দ্রুত কমিটি এ বিষয়ে সুপারিশ করবে। এরপর তা চূড়ান্ত করে জুন—জুলাইয়ের মধ্যেই সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠানো হবে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কর্মকর্তা এবং সমন্বয় কমিটির সদস্যরা বলছেন, মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে অনেকের উদ্বেগ—উৎকণ্ঠা রয়েছে; বিশেষ করে অভিভাবকদের। এজন্য পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। মূল্যায়নের দিনে শিক্ষার্থীরা যাতে পরীক্ষার কেন্দ্রে বসে, সেখানে কিছু লেখে— সে বিষয়টি যুক্ত করা হবে। কার দক্ষতা কেমন, তার একটি আনুষ্ঠানিক ‘পরীক্ষা’ সেদিন হয়ে যাবে। এটিই প্রমাণ হিসেবে থাকবে। যাতে ফল প্রকাশের পর কোনো আপত্তি না ওঠে।
এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে অভিভাবকদের বেশ আপত্তি আছে। বিষয়টি আমলে নিয়েই শিক্ষামন্ত্রী একটি সমন্বয় কমিটি করে দিয়েছেন। কমিটির সদস্যরা নিজেরা বসবেন, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করবেন, শিক্ষকদেরও ডাকবেন। সবার মতামত নিয়ে কীভাবে, কতটুকু লিখিত পরীক্ষা যুক্ত করা যায়; সেটা নিয়ে সুপারিশ করবেন। তারপর সে অনুযায়ী নেওয়া হবে চূড়ান্ত ব্যবস্থা।
‘জুন—জুলাই মাসের দিকে অর্ধবার্ষিক বা ষাণ্মাসিক; যেটাই বলেন, সেসময়ের আগে পদ্ধতি কী হবে, তা স্কুলে স্কুলে পাঠানো হতে পারে’, উল্লেখ করেন এনসিটিবি চেয়ারম্যান।
ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার সংবাদমাধ্যমকে বলেন, গত ২ মার্চ ঢাকা বোর্ডে বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের প্রধানদের সঙ্গে এনসিটিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বৈঠক হয়েছিল। সেখানে মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে এনসিটিবির একটি উপস্থাপনা তুলে ধরা হয়। সেখানে তো বিভিন্ন ধরনের মূল্যায়নের কথাই বলা হয়েছে। এরমধ্যে লিখিত অংশ রেখেও কিছু উপস্থাপনা ছিল। বিষয়টি নিয়ে আরও বসবো আমরা। তারপর হয়তো চূড়ান্ত হবে।
লিখিত পরীক্ষা কীভাবে?
অবশেষে নতুন শিক্ষাক্রমে লিখিত পরীক্ষা যুক্ত হচ্ছে, এটা মোটামুটি নিশ্চিত। তবে আগের নিয়মে লিখিত পরীক্ষা হবে না, সেটাও নিশ্চিত করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাহলে কীভাবে পরীক্ষা হবে, এমন প্রশ্নে এনসিটির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, লিখিত পরীক্ষা হতে পারে, আবার কোনো কিছু তৈরি করাও হতে পারে। প্রত্যেকটি বিষয়ই এটা (লিখিত পরীক্ষা) হবে। তবে এতে কোনো নম্বর বরাদ্দ দেওয়া হবে না। এর একটি মানদণ্ড থাকবে, যেটিকে আমরা ওয়েটেস বলি। শিক্ষার্থীর রিপোর্ট কার্ডে এটা কীভাবে যুক্ত হবে, সেই প্রক্রিয়া নির্ধারণে কাজ চলছে।
নতুন ধাঁচের প্রশ্নপত্র বা দক্ষতানির্ভর কাজ দেওয়া হবে জানিয়ে তিনি বলেন, হ্যঁা, লিখিত পরীক্ষা থাকতে পারে। তাই বলে ওপরের তিনটি প্রশ্নের মধ্যে একটি লেখো, এর সংজ্ঞা লেখো, পার্থক্য, বৈশিষ্ট্য, কী কী, কাকে বলে— এ ধরনের প্রশ্নপত্র হবে না। ঘড়ি ধরে ঘণ্টা বাজিয়ে নির্দিষ্ট সময়ও বেঁধে দেওয়া হবে না। নম্বরও থাকবে না। নম্বর বরাদ্দ দিয়ে এমন লিখিত পরীক্ষা যদি ফেরাতে হয়, তাহলে দক্ষতানির্ভর এ কারিকুলাম বাদ দিতে হবে।
মূল্যায়ন পদ্ধতিতেও কিছু পরিমার্জন আসবে জানিয়ে অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, গত নভেম্বরে বার্ষিক সামষ্টিক মূল্যায়ন হয়েছিল। সেখানে একদিনে আমরা তিনটি বিষয়ের মূল্যায়ন নিয়েছিলাম। এতে শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ পড়ে যায়। এবার আমরা একদিনে একটি বিষয়ের মূল্যায়ন করবো। প্রথমে ওরিয়েন্টেশন হবে, তারপর একজন শিক্ষার্থী ফাইনাল কাজটি করবে। দলগতভাবে একটি কাজ করা হবে, আবার প্রত্যেককে এককভাবে পারফর্ম করতে হবে। প্রতিদিন পাঁচ ঘণ্টায় খুব স্বাচ্ছন্দ্যে শিক্ষার্থীরা এ কাজ করতে পারবে।
পরীক্ষা ফেরাতে সমন্বয় কমিটি কাজ করছে যেভাবে
শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই নতুন শিক্ষাক্রমের মূল্যায়ন পদ্ধতিতে সংস্কার নিয়ে কথা বলছেন মহিবুল হাসান চৌধুরী। গত ৪ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে শিক্ষাক্রম এবং পাঠ্যপুস্তক বিতরণ ও মানোন্নয়ন সংক্রান্ত পর্যালোচনা সভা হয়। ওই সভায় মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। এর একমাস পর গত ৪ মার্চ প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ১৪ সদস্যের কমিটি করার কথা জানায় মন্ত্রণালয়।
গঠিত কমিটি এ পর্যন্ত একটি সভা করেছে, তবে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বসতে পারেনি এখনো। আগামী সভায় দুজন বিশেষজ্ঞকে এ কমিটিতে কো—অপ্ট করা হবে। এছাড়া কয়েকজন প্রধান শিক্ষক বা অধ্যক্ষ, শ্রেণি শিক্ষকদেরও ডেকে তাদের মতামত নেবেন কমিটির সদস্যরা।
জানতে চাইলে কমিটির সদস্য ও এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বলেন, কমিটিতে এনসিটিবির প্রাথমিকের (শিক্ষাক্রম) সদস্য রয়েছেন। তিনি নতুন কারিকুলাম প্রণয়ণকারীদের প্রথম পাঁচজনের একজন। আগামী মিটিংয়ে দুজন বিশেষজ্ঞকে কো—অপ্ট করা হবে। তাদের কাছ থেকে মতামত নেবো। নতুন কারিকুলামের কনসালটেন্টের পরামর্শও আমরা নেবো।
তিনি আরও বলেন, তিনজন প্রধান শিক্ষককে নেওয়া হবে। তারা নিজেদের স্কুলে নতুন কারিকুলামের পরিস্থিতি জানাবেন এবং পরামর্শ দেবেন। প্রয়োজনে স্কুলের শ্রেণিশিক্ষক এবং বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকদেরও নেওয়া হবে। তারা বাস্তবচিত্র তুলে ধরবেন। এছাড়া কমিটি যখন, যাকে প্রয়োজন মনে করবে, যুক্ত করতে পারবে।
সমন্বয় কমিটির প্রধান, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) মোহাম্মদ খালেদ রহীম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, আমরা কাজ শুরু করেছি। সব পক্ষের মতামত নেওয়া হবে। সার্বিক দিক পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে।
বর্তমানে মূল্যায়ন হচ্ছে যেভাবে
২০২৩ সালে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা হয়। চলতি বছর দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে এ শিক্ষাক্রমে পাঠদান চলছে। ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে, ২০২৬ সালে একাদশ এবং ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে এ প্রক্রিয়া চালু হবে।
নতুন শিক্ষাক্রমে বর্তমানে দুই পদ্ধতিতে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। একটি বছরজুড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিখনকালীন মূল্যায়ন, অন্যটি বছর শেষে সামষ্টিক মূল্যায়ন। শিক্ষাক্রমের রূপরেখা অনুযায়ী, প্রাক—প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা নেই। এ তিন শ্রেণিতে হবে শতভাগ শিখনকালীন মূল্যায়ন।
চতুর্থ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঁচটি বিষয়ে কিছু অংশের মূল্যায়ন হবে শিখনকালীন। বাকি অংশের মূল্যায়ন হবে সামষ্টিক। দশম শ্রেণি শেষে ওই শ্রেণির পাঠ্যসূচির ওপর পাবলিক পরীক্ষা হবে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যসূচির ওপর প্রতিটি বর্ষ শেষে একটি করে পরীক্ষা হবে। এসব পরীক্ষার ফলের সমন্বয়ে চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারিত হবে।
৪০—৫০ নম্বরের পরীক্ষা চান অভিভাবকরা
লিখিত পরীক্ষা রাখা এবং তাতে অন্তত ৪০—৫০ নম্বর বরাদ্দ দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন অভিভাবকরা। তবে নতুন শিক্ষাক্রমের প্রণেতারা বলছেন, নম্বর বরাদ্দ রাখার প্রথা বজায় রাখলে নতুন শিক্ষাক্রম লক্ষ্যচ্যুত হবে। তারপরও অভিভাবকরা কিছুটা হলেও নম্বর যুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন।
মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী আফরিন আক্তার। তার মা আঞ্জুমান আরা সংবাদমাধ্যমকে বলেন, পরীক্ষা যুক্ত করা হচ্ছে, ভালো কথা। তবে নম্বর না রাখলে পরীক্ষা কীভাবে? নম্বর রাখাটা জরুরি। না হলে শিক্ষার্থীরা বাসায় পড়বেও না, লিখবেও না। যদি কোনো কাজও দেওয়া হয়, সেটার জন্য নম্বর বরাদ্দ রাখা দরকার। তাহলে আগ্রহ বাড়বে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সংবাদমাধ্যমকে বলেন, প্রতিযোগিতা থাকা দরকার। একই সঙ্গে অশুভ প্রতিযোগিতা বন্ধ করাও দরকার। জিপিএ—৫ নিয়ে আমাদের দেশের অভিভাবকদের যে অশুভ প্রতিযোগিতা, তা বন্ধ করাটাও জরুরি। সেজন্য পরীক্ষা রাখতে হবে। একেবারে পরীক্ষা না রাখলে ঝরে পড়ার হার বেড়ে যেতে পারে। আবার এমনভাবে পরীক্ষাটা নেওয়া যাবে না, যাতে অশুভ প্রতিযোগিতা বাড়ে। আমার প্রত্যাশা হলো— যারা এটা (কারিকুলাম) নিয়ে কাজ করছেন, তারা এসব বিষয় মাথায় রেখেই এটা (পরীক্ষা পদ্ধতি) চূড়ান্ত করবেন।