অসময়ের ভারী বর্ষণে তলিয়ে গেছে রংপুরের নিম্নাঞ্চল
১৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড
নগরীর পাড়া-মহল্লার সড়কে চলাচলে দুর্ভোগ
বিপাকে নিম্ন আয়ের মানুষ
উঠতি সবজিসহ ফসলের ক্ষতির আশংকা
নিজস্ব প্রতিবেদক:
রংপুর নগরীসহ পাশ্ববর্তী জেলায় গত শুক্রবার থেকে টানা ভারি বর্ষণে তলিয়ে গেছে নিম্নাঞ্চল। পানি বাড়তে শুরু করেছে রংপুর অঞ্চলের তিস্তা, করতোয়া, দুধকুমর, ঘাঘট, ধরলা, বক্ষ্রপূত্র সহ বিভিন্ন নদ-নদীতে। বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছে নদীভাঙন। পানি জমে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। যান চলাচলসহ পাড়া-মহল্লার সড়ক গুলোতে সাধারণ মানুষজনকে চরম দুর্ভোগ পোয়াতে হচ্ছে। উঠতি শাক-সবজি সহ ফসলে ক্ষতির আশংকায় করছেন কৃষকরা। এমন পরিস্থিতিতে করে চরম বিপাকে পড়েছেন দিনমজুর ও শ্রমিকসহ নিম্ন আয়ের মানুষজন। তবে আষাঢ়-শ্রাবণকে হার মানানো অসময়ের এই অবিরাম বৃষ্টিপাতে নদীপাড়েও আবার বন্যার শঙ্কা জেগেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শনিবার একই পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ৬৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। এছাড়াও ধরলা, বক্ষ্রপূত্র, দুধকুমর, করতোয়ায় পানি বেড়েছে।
রংপুর আবহাওয়া বলছে, গত ২৪ ঘণ্টায় (শনিবার বেলা ১২টা থেকে রোববার বেলা ১২টা পর্যন্ত) রংপুর বিভাগে ১ হাজার ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে নীলফামারীর সৈয়দপুরে, ৪১৫ দশমিক ৪ মিলিমিটার। আর শুধু রংপুরে ১৬২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রংপুর নগরীর লালবাগ, খামার মোড়, নেসকো গেট, নূরপূর, কামাল কাছনা, গুপ্তপাড়া, মাহিগঞ্জ, খাসবাগ, বোতলা, নিউ জুম্মাপাড়া, পূর্ব জুম্মাপাড়া, তাজহাট, বাবুপাড়া, মহাদেবপুর, কামারপাড়া, শালবন, মিস্ত্রিপাড়া, ধাপ এলাকা, মুন্সিপাড়া, হনুমানতলা, মুলাটোল, মেডিকেল পাকার মাথা ও জলকর, দর্শনা, আশরতপুর, চকবাজার, চিনিয়াপাড়া, ঈদগাওপাড়া, মর্ডাণ ঘাঘট পাড়া, মিলনপাড়া, মাছুয়াপাড়া, দোলাপাড়া, আক্কেলপুর, বনগ্রাম, নাজিরদিঘর, পানবাড়ি, তামপাট, লক্ষণপাড়া, বড় রংপুর, আরাজী তামপাট, হোসেন নগর, মেকুড়া, ডিমলা, নাছনিয়া,বাহার কাছনা, খলিশাকুড়ি, তপোধন, খটখটিয়া, তালতলা, উত্তম, মনোহরপুরসহ রংপুর নগরীর বিভিন্ন এলাকা ও রংপুর বিভাগের আট জেলার বিভিন্ন এলাকায় পানি জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে।
এছাড়াও রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষীটারি, কোলকোন্দ, গজঘন্টা, মর্ণেয়া, আলমবিদিতর, নোহালী, কাউনিয়ার হারাগাছ, সারাই, বালাপাড়া, টেপামধুপুর, পীরগাছার তাম্বুলপুর, পীরগঞ্জের টুকুরিয়া, চতরা, কাবিলপুর, মাদারগঞ্জ, মিঠাপুকুরের বালুয়া, ছড়ান, মিলনপুর, ভাংনীসহ এ বিভাগের কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর, চিলমারি, নাগেশ্বরী, ফুলবাড়ি, কচাকাটা, সদর, লালমনিরহাটের তিস্তা, সদর উপজেলা, আদিতমারি, কালীগঞ্জ, কাকিনা, হাতিবান্ধা,পাটগ্রাম, নীলফামারীর ডিমলা, ডোমার, জলঢাকা ও গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি, পলাশবাড়ি, সাঘাটা, সদর, নলডাঙ্গাসহ রংপুর অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে ভারি বৃষ্টিপাতে পানি জমেছে।
এর মধ্যে রংপুর অঞ্চলের তিস্তা, করতোয়া, দুধকুমর, ঘাঘট, ধরলা, বক্ষ্রপূত্র সহ নদ-নদীতে পানি বাড়তে শুরু করেছে। আবার কোথাও কোথাও দেখা দিয়েছে নদীভাঙন। টানা বৃষ্টিতে রংপুর নগরীর বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। অনুন্নত ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষজন। সড়কে যানবাহন চলাচল কিছুটা কমেছে। অবিরাম বৃষ্টির কারণে অনেক মার্কেটে খোলা হয়নি দোকানপাট।
এদিকে রংপুর নগরীর পানি নিষ্কাশনের প্রবাহপ্রাণ শ্যামাসুন্দরী ও কেডি খাল গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিপাতে ভরে গেছে। অনেক জায়গায় জলাবদ্ধতায় অপ্রস্তুত এক বিড়ম্বনায় পড়েছে মানুষজন।
রংপুর নগরীর তামপাট এলাকার হুমায়ন রশীদ শাহীন ও আশরাফুল আলম বলেন, গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিপাতের কারণে তাদের এলাকারসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় পানি জমে জলাবদ্ধাতা দেখা দিয়েছে। অনেক স্থানে সড়কে পানি উঠেছে। মানুষজনকে কষ্ট করে চলাচল করতে হচ্ছে।
রংপুর নগরীর কলেজ রোড নেসকো ওয়াপদা মোড় এলাকার কামরুল হাসান টিটু বলেন, পাড়া-মহল্লার মোড়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। মানুষজন ড্রেনের মুখগুলো ময়লা-আবর্জনায় বন্ধ হওয়াতে এ অবস্থা দেখা দিয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
৩২ নম্বর ওয়ার্ডের নগর মীরগঞ্জ এলাকার সামসুল আলম শ্রাবণ বলেন, রাত থেকে মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছে। নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় দুর্ভোগে পড়েছেন মানুষ। অনেকের বাসা-বাড়িতে পানি উঠেছে। রান্নাসহ কাজ কর্মে ব্যাঘাত ঘটছে।
নগরীর উত্তম মনোহরপুর এলাকার মনিরুজ্জামান মনির ও বুড়িরহাট কলেজপাড়ার মিজানুর রহমান বলেন, পানি বৃদ্ধিতে হয়েছে। মানুষের দুর্ভোগ চরম পর্যায়ে দেখা দিয়েছে। সরকারি-সহযোগিতা প্রয়োজন।
গঙ্গাচড়া উপজেলার কোলকোন্দ ইউনিয়নের বাবুপাড়া এলাকার রাজমিস্ত্রী বিষ্ণু চন্দ্র রায় (২৭) বলেন, রংপুর শহরে রাজমিস্ত্রির কাজ করে সংসার চলে। তিন দিন থাকি বৃষ্টির কারণে কাজে যাইতে পারি নাই। এতে করে সংসার চালাতে কষ্ট হয়েছে। আরও কয়দিন যে বৃষ্টির জন্য বাড়িত থাকা লাগে।
রাজারহাট উপজেলার রতিগ্রাম এলাকার আমজাদ হোসেন বলেন, তিন দিন থাকি ধান পানিত ডুবি আছে। আর কয়েক দিন থাকলে ধান নষ্ট হয়া যাবে।
গঙ্গাচড়া সদর ইউনিয়নের ধামুর গ্রামের কৃষক শ্যামল রায় (৩৫) বলেন, একদিন রিকশা নিয়ে বের হতে না পারলে দেনা বেড়ে যায়। শুক্রবার থেকে টানা বৃষ্টির কারণে বাইরে মানুষের চলাফেরা কমে গেছে। অটো চালা বন্ধ করে ঘরে বসে দিন পার করছি।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোস্তাফিজার রহমান বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় রংপুর বিভাগে হওয়া ১ হাজার ৩০০ দশমিক ৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের মধ্যে নীলফামারীর সৈয়দপুরে সর্বোচ্চ ৪১৫.৪ মিলিমিটার এবং রংপুরে ১৬২৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এছাড়া দিনাজপুরে ৩১৮.৪ মিলিমিটার, নীলফামারী ডিমলায় ২০৪.৭, পঞ্চগড়ে ১৩৭ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। যা এ মৌসুমে ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত। আরও দুই দিন বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ওবায়দুর রহমান মণ্ডলবলেন, এখন ধানের মৌসুম। এই বৃষ্টি ধানের জন্য খুবই উপকারী। তবে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে সবজিখেতে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে, যা পানি নেমে যাওয়ার পর বুঝা যাবে।