রংপুরের আ.লীগ, জাতীয় পার্টির সঙ্গে মূল প্রতিদ্বন্দ্বি স্বতন্ত্র প্রার্থীরা
রংপুর জেলার ৬টি সংসদীয় আসন
ভোট গ্রহণে প্রস্তুত রংপুর:কয়েক স্তরের নিরাপত্তা বলয় তৈরি
হারুন উর রশিদ সোহেল:
আজ রোববার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এবার নির্বাচনে রংপুরের ছয়টি আসনেই চোখ রাঙাচ্ছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। ভোটের মাঠে দলীয় প্রার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় তারা। ফলে উন্মুক্ত ও ছাড়ের আসনে আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টির (জাপা) সঙ্গে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকবেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এমনটাই জানিয়েছেন প্রার্থী, সমর্থক ও স্থানীয়রা।
এদিকে জেলার ছয়টি সংসদীয় আসনের ৮৫৮টি ভোটকেন্দ্র ঘিরে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়েছে। এরই মধ্যে ব্যালট পেপার ছাড়া বাকি নির্বাচনী সব সরঞ্জাম পাঠানো হয়েছে কেন্দ্রে কেন্দ্রে। শনিবার দুপুরে রংপুর জেলা পরিষদ কমিউনিটি সেন্টার থেকে রংপুর সদর উপজেলা ও মহানগরীর ভোটকেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কাছে নির্বাচনী সরঞ্জাম বুঝিয়ে দেন সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা। এর আগে গত বুধবার বিকেল থেকে রংপুরের জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তার অধীনস্থ ট্রেজারি থেকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ব্যবহৃত গাড়িতে করে বিভিন্ন উপজেলায় ব্যালট পেপারসহ নির্বাচনী সামগ্রী পাঠানো হয়।
জানা গেছে, ব্যালট পেপারসহ নির্বাচন সামগ্রী জেলার ছয়টি আসনের অধীন আট উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার অফিসে পাঠানো হচ্ছে। সেখানে নির্বাচনের দিন কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে রাখা হবে। নির্বাচনের দিন ভোটগ্রহণের আগে সকালেই ব্যালট পেপার কেন্দ্রে পাঠানো হবে। ওইদিন সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ব্যালটের মাধ্যমে বিরতিহীনভাবে অনুষ্ঠিত হবে ভোটগ্রহণ। নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয়েছে পুরো এলাকা। জেলায় এক হাজার ৬২০ জন পুলিশ সদস্য ও ১০ হাজার আনসার সদস্য ছাড়াও বিজিবি, র্যাব, নির্বাহী ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত থাকছেন ভোটের মাঠে। এলাকায় টহল দিচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি মো. আব্দুল বাতেন বলেন, রংপুরের সংসদীয় ছয়টি আসনের ৮৫৮টি কেন্দ্রের মধ্যে জেলা পুলিশের অধীনে ৬৫৯টি এবং মেট্রোপলিটন পুলিশের অধীনে ১৯৯টি কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে রংপুর জেলার ৬৫৯টি কেন্দ্রের মধ্যে ৩১৯টি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র রয়েছে। এসব কেন্দ্রে পুলিশ-আনসারের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি বিশেষ নজরদারি রাখা হবে। সেই সঙ্গে অতিরিক্ত টহল টিম থাকবে। একই সঙ্গে বাড়ানো হবে স্ট্রাইকিং ফোর্স ও ভ্রাম্যমাণ টিমের সংখ্যাও।
রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (আরপিএমপি) কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান জানান, নির্বাচন কমিশনার ও পুলিশের আইজিপি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ করায় বদ্ধপরিকর। এ ঘোষণার সফল বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রংপুর মহানগর এলাকার মোট ১৯৯টি ভোটকেন্দ্রে নির্বাচনী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আরপিএমপির ১ হাজার ১১৪ জন, পিটিসি রংপুরের ৭৮ জন, এপিবিএন’র ১৫০ জন এবং শিল্প পুলিশের ১২২ জনসহ মোট ১ হাজার ৪৬৪ জন পুলিশ কর্মকর্তা-ফোর্স এবং আনসার-ভিডিপির ২ হাজার ৩৮৮ জন সদস্য মহানগর এলাকার দায়িত্ব পালন করবে।
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, রংপুর-১ (গঙ্গাচড়া ও আংশিক সিটি করপোরেশন) আসনে ৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থীই রয়েছেন চারজন। আওয়ামী লীগ এ আসন থেকে নৌকার প্রার্থী তুলে নিয়ে জাতীয় পাার্টর প্রার্থী হোসেন মকবুল শাহরিয়ার আসিফকে (লাঙ্গল) কৌশলগত ছাড় দিয়েছে। তবে ভোটের মাঠ দাপিয়ে বেড়িয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান বাবলু (কেটলি) ও জাতীয় পার্টির বহিষ্কৃত মহাসচিব বর্তমান সংসদ সদস্য (এমপি) মসিউর রহমান রাঙ্গা (ট্রাক)। তারা উঠান বৈঠক, পথসভা ও গণসংযোগ ব্যাপকভাবে চালিয়েছেন। এই আসনে আলোচনায় রয়েছেন আওয়ামী লীগের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান বাবলু (কেটলি) ও জাতীয় পার্টির বহিষ্কৃত মহাসচিব বর্তমান সংসদ সদস্য মসিউর রহমান রাঙ্গা (ট্রাক)। তবে আজ ভোটে চমক হতে পারে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এই রংপুর-১ আসনে ৩ লাখ ৩২ হাজার ২১৯ ভোটারের মধ্যে ১ লাখ ৬৭ হাজার ১৮২ জন পুরুষ, ১ লাখ ৬৫ হাজার ৩৫ জন নারী ও ২ জন তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছেন।
রংপুর-২ (বদরগঞ্জ-তারাগঞ্জ) আসনে ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবুল কালাম মো. আহসানুল হক চৌধুরী ডিউক (নৌকা) ও জাতীয় প্রার্থী আনিছুল ইসলাম মণ্ডলের (লাঙ্গল) সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিশ্বনাথ সরকার বিটু (ট্রাক)। বিশ্বনাথ সরকার বিটু হিন্দু সম্প্রদায়কে টার্গেট করে ভোটযুদ্ধে নেমেছেন বলে নৌকার প্রার্থী অভিযোগ রয়েছে। এদিকে আওয়ামী লীগের ভোট দুই ভাগে বিভক্ত হওয়ায় নির্বাচনে তুলনামূলক স্বস্তিতে রয়েছেন জাপার প্রার্থী আনিছুল ইসলাম মণ্ডল। রংপুর-২ আসনে ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৪৬ জন ভোটারের মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৭৭ হাজার ২৫৩, নারী ১ লাখ ৭৭ হাজার ২৫৩ ও তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার ৮ জন।
রংপুর-৩ ( সদর উপজেলা ও সিটি কর্পোরেশন আংশিক) আসনে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের (লাঙ্গল) রংপুর-৩ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাপার সমঝোতার ২৬ আসনের মধ্যে রয়েছে এ আসনটি। ফলে আওয়ামী লীগ এ আসনে প্রার্থী দিলেও তা পরে প্রত্যাহার করে নেয়। তবে রংপুর-৩ আসনের সিটি এলাকা ও সদরের ইউনিয়নগুলোতে ব্যাপক প্রচারণা করে আলোচনায় আসেন স্বতন্ত্র প্রার্থী তৃতীয় লিঙ্গের আনোয়ারা ইসলাম রানী (ঈগল)। এই আসনে অন্য প্রার্থীরা প্রচারের মাঠে সক্রিয় ছিলনা। রংপুর-৩ আসনে ৪ লাখ ৯৪ হাজার ৭৬৮ ভোটারের মধ্যে পুরুষ ২ লাখ ৪৭ হাজার ৪৭২, নারী ২ লাখ ৪৭ হাজার ২৯৪ ও তৃতীয় লিঙ্গের ২ জন।
রংপুর-৪ (পীরগাছা-কাউনিয়া) আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি (নৌকা)। এ আসনে তিনজন প্রার্থী নির্বাচনে থাকলেও টিপু মুনশির মূল প্রতিদ্ব›দ্বী জাতীয় পার্টির মোস্তফা সেলিম বেঙ্গল (লাঙ্গল)। দুই প্রার্থীই শেষ মুহূতে জোরেশোরে নির্বাচনী প্রচার চালিয়ে শেষ করেছেন। তবে ভোটের মাঠে বর্তমান এমপি টিপু মুনশি কিছুটা অস্বস্তিতে রয়েছে। এই আসনে বাংলাদেশ কংগ্রেসের প্রার্থী সিরাজুল ইসলাম পাটোয়ারি।
রংপুর-৫ (মিঠাপুকুর) আসনের বর্তমান এমপি আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ এইচএন আশিকুর রহমান এবারের নির্বাচনে অংশ নেয়নি। তার স্থলে ছেলে ছেলে রাশেক রহমান আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছেন। তবে রাশেকের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছেন মিঠাপুকুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করা আওয়ামী লীগ নেতা জাকির হোসেন সরকার। জাকির হোসেনকে রাশেকের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বি হিসেবে মনে করছেন স্থানীয় ভোটাররা। এই আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী আনিছুর রহমান আলোচনায় রয়েছেন। এই আসনে জাপার প্রার্থী আনিছুর রহমানসহ মোট আট প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এ আসনে ৪ লাখ ৪০ হাজার ৩৩৫ ভোটারের মধ্যে মধ্যে পুরুষ ২ লাখ ১৮ হাজার ৩৪৭, নারী ২ লাখ ২১ হাজার ৯৮৪ জন ও তৃতীয় লিঙ্গের ৪ জন।
গত ২৬ ডিসেম্বর পীরগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জনসভায় আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের রংপুর-৬ (পীরগঞ্জ) আসনের প্রার্থী জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীকে নিজের মেয়ে সম্বোধন করে তার জন্য নৌকার পক্ষে ভোট চান। এ আসনে নৌকার সঙ্গে লড়াই হবে প্রধানমন্ত্রীর ভাতিজি জামাই ও জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সিরাজুল ইসলাম সিরাজ (ট্রাক) প্রতীকের। ভোটযুদ্ধে নৌকার সঙ্গে লড়তে দিন-রাত এক করে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ছুটছেন সিরাজ। জাতীয় পার্টির প্রার্থী নুর আলম মিয়াসহ (লাঙ্গল) প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন মোট সাত প্রার্থী। এ আসনে ৩ লাখ ২৯ হাজার ৭৫৪ ভোটারের মধ্যে ১ লাখ ৬৪ হাজার ২৫২ জন পুরুষ, ১ লাখ ৬৫ হাজার ৪৯৮ নারী ও ৪ জন তৃতীয় লিঙ্গের।
রংপুর জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করতে ইতোমধ্যে যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। জেলার ৮৫৮ কেন্দ্রই গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনে কোনো বিশৃঙ্খলা বা অপ্রীতিকর ঘটনায় ছাড় দেওয়া হবে না।
তিনি আরও বলেন, সাধারণ কেন্দ্র বা গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, তা নির্বাচন কমিশন থেকে গাইডলাইন দেওয়া আছে। আমরা সেই গাইডলাইন ফলো করবো। তা ছাড়া অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে যা প্রয়োজন আমরা সবই করবো, সেই প্রস্তুতি আমাদের আছে।