গোয়েন্দা নজরদারিতে আইআরডিপি
রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকে প্রতারণার ফাঁদ
১০ লাখ টাকার পুঁজি নিয়ে ১০ হাজার কোটি টাকা প্রকল্পের উদ্যোগ
সমাজসেবার নিবন্ধন নিয়ে নাম পরিবর্তন করে ফাউন্ডেশন গঠন করে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু
ঠিকাদারি কাজের নামে ৮০ কোটি ২৫ লাখ টাকার উৎকোচ গ্রহণ
নিজস্ব প্রতিবেদক:
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মনোগ্রাম(লোগো) ব্যবহার করে রংপুর নগরীতে আইআরডিপি(ইন্টিগ্রেটেড রুরাল ডেফলভমেন্ট প্রোগ্রাম) রহস্যজনক প্রতারণার ফাঁদ ঘেরা কার্যক্রম নিয়ে পুলিশের মহানগর শাখার সিটিএসবি(নগর বিশেষ শাখা) ও ডিবি(গোয়েন্দা শাখা) যৌথভাবে অনুসন্ধান শুরু করেছে।
আমাদের প্রতিদিন এ গত ১৪ মার্চ বৃহস্পতিবার প্রকাশিত সরকারি লোগো ব্যবহার, ‘প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে আইআরডিপি, উদাসীন প্রশাসন, শিরোনামে একটি খবর প্রকাশিত হয়। এর পর স্থানীয় সংসদ সদস্য(সংরক্ষিত) নাছিমা জামান ববি পুলিশ কমিশনারের নজরে আনেন। এর পর রংপুর মহানগর পুলিশের কমিশনার মোঃ মনিরুজ্জামান নির্দেশে আইআরডিপি’র কার্যক্রম সম্পর্কে অনুসন্ধানে কাজ শুরু করে পুলিশের ওই দু’টি গোয়েন্দা সংস্থা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সংস্থাটি মাত্র দশ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে তাদের ১৭টি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে। ওই টাকার জোগার তারা সেবাপ্রার্থী ও সহযোগী সংগঠনগুলোর কাছ থেকে সংগ্রহ করবে এমন তথ্য নিশ্চিত করেছেন সংস্থাটির একাধিক কর্মকর্তা। শুধু তাই নয় ক্ষমতাসীন দলের একাধিক সংসদ সদস্য, কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাদের প্রশয়ে রংপুর নগরীতে আইআরডিপি(ইন্টিগ্রেটেড রুরাল ডেফলভমেন্ট প্রোগ্রাম) নামে প্রতিষ্ঠানটি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে এমন তথ্য মিলেছে। তাদের কার্যক্রমের সাথে কয়েকজন সংসদ সদস্য ও দলের নেতা যুক্ত আছেন বলে ওই সংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল রাসেল এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন। এ ছাড়া তিনি আরও জানিয়েছেন, গাইবান্ধা, ঠাকুরগাঁও, কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ি, দিনাজপুর, পঞ্চগড়সহ একাধিক জেলার একাধিক সরকার দলীয় সংসদ সদস্যসহ আওয়ামীলীগ এর স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে একাধিক নেতা তাদের এই কাজের সাথে যুক্ত তারা তাদের কর্মসূচি সফল করা জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে যুক্ত আছেন। তাদের অনেকেই ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে তাদের কমিিউনিটি ক্লিনিক ও হেল্থ সেন্টার নির্মাণের জন্য দরপত্রে অংশ গ্রহণ করেছেন। অনেকে নির্মাণ কাজ শুরু করেছেন। নির্মাণ কাজের জন্য সংস্থাটির পক্ষে দরপত্রে অংশগ্রহণকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে দরপত্র অনুযায়ী কার্যাদেশ দেয়ার জন্য উৎকোচ হিসেবে ১৫ লাখ টাকা, জামানত হিসেবে ৫ লাখ টাকা ও দরপত্র ক্রয়ের জন্য ৪ হাজার টাকা গ্রহণ করেছেন বলে স্বীকার করেছেন সংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। সেই হিসেব অনুযায়ী রংপুর বিভাগের ৮ জেলার ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে ৫৩৫টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য তাদের নির্ধারিত নির্মাণ ব্যয় বাবদ প্রতিটির বরাদ্দ ৮৪ লাখ টাকা হলে নির্মাণ ব্যয় দাঁড়াবে মোট ৪শ’ উনপঞ্চাশ কোটি ৪০ লাখ টাকা। মাত্র ১০ লাখ টাকা মূলধন নিয়ে কী করে এই বিপুল সংখ্যক টাকার ঠিকাদারি বিল পরিশোধ করা হবে এমন প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারেননি সংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও হেল্থ কমপ্লেক্স নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মোস্তফা কামাল রাসেল। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঠিকাদারি নির্মাণকার্যাদেশ দেয়ার নাম করে প্রতিটির বিপরীতে ১৫ লাখ টাকা মোট ৮০ কোটি ২৫ লাখ টাকা কী কারণে নেয়া হচ্ছে এর কোন সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি ওই প্রকল্প পরিচালক। তবে তিনি বলেছেন এভাবে তারা সংগঠনের অভ্যন্তরীণ তহবিল হিসেবে পুঁজি সংগ্রহ করছেন। নির্মাণ কাজের বিপরীতে জামানত বাবদ ২৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে। তা নির্মাণ কাজ শেষ হলে ফেরত দেয়া হবে বলে সংস্থাটির পক্ষে জানানো হয়েছে। কোন ব্যাংকে এই বিপুল সংখ্যক আর্থিক লেনদেন হয়েছে এবং কীভাবে নিয়ে সংস্থাটি কোন কর্মকর্তা যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। ২০২২ সালে ডিসেম্বর মাসের ১৯ তারিখ ও সংশোধিত দরপত্র ২৫ তারিখ আহ্বান করে তাদের কার্যক্রম শুরু করা হলেও কতদিনের মধ্যে ওই হেল্থ কমপ্লে্ক্স নির্মাণ কাজ শেষ করা হবে তার কোন উল্লেখ হয়নি দরপত্রে। তাই শুধুমাত্র লোক দেখানোর জন্য কিছু প্রাথমিক কাজ দেখানো হলেও বাস্তবে কোন বৃহৎ কাজ পরিলক্ষিত হয়নি। সংস্থাটির সাথে সরকারের কোন অংশীদারিত্ব নেই তবুও কেন তাদের সকল নথিপত্রে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মনোগ্রাম(লোগো) ব্যবহার করা হচ্ছে তার কোন জবাব পাওয়া যায়নি সংস্থার কোন কর্মকর্তার কাছে। প্রকাশ্যে এই কার্যক্রম চালানো হলেও সরকারের প্রশাসনের নজরে না আসার বিষয়টি রহস্যজনক।
সংস্থার চেয়ারম্যান নাম আসেক আলী(সাবেক কাউন্সিলর, সাবেক রংপুর পৌরসভা) বানিয়াপাড়ায় তার বাড়িতে সংস্থার কেন্দ্রীয় অফিস হিসেবে দেখানো হলেও রংপুর বৃহস্পতিবার দুপুরে নগরির বানিয়াপাড়ায় সংস্থাটির কেন্দ্রীয় অফিসের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। দরপত্রে ও সংস্থাটির বিভিন্ন নথিপত্রে অফিসের কোন ঠিকানা উল্লেখ করা হয়নি। নগরীর গোমস্তপাড়ায় গোপন অফিস কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে সংস্থাটি।
সংস্থাটি সম্পর্কে অনুসন্ধানে আরও উদ্বেগজনক তথ্য পাওয়া গেছে, নথিপত্রে দেখা যায় ২০০৭ সালে এই প্রতিষ্ঠানটি প্রাথমিক পর্যায়ে গাইবান্ধা জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের মাধ্যমে ঢাকা সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধনকৃত। সেখানে প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা রয়েছে ‘আদর্শ যুব কর্মসংস্থা’(এ, জে, কে, এস), ঠিকানা লেখা রয়েছে গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি উপজেলার, কালিবাড়ী বাজার। তাদের শুধু গাইবান্ধা জেলায় কর্মক্রম পরিচালনার কথা ওই নিবন্ধনে লেখা রয়েছে। এরপর সংস্থাটি নাম পরিবর্তন করে ২০১১ সালে ‘আদর্শ যুব কর্মসংস্থা ফাইন্ডেশন’ জয়েন্ট স্টক কম্পানি এণ্ড ফার্ম কর্তৃক নিবন্ধন করে।উল্লেখ্য ফাউন্ডেশন এর নামে নিবন্ধন নিয়ে কোন লাভজনক কাজ করা যায় না। এটি একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন।
সমাজসেবা আইন ১৯৬১ সালের সেচ্ছাসেবী সমাজক্যল্যাণ সংস্থা সমূহ(নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রন) অনুযাীয় ৪৬ নম্বর অধ্যাদেশের আওয়তায় সমাজসেবা অধিদপ্তর নিবন্ধন দিয়ে থাকে। সেখানে স্পষ্ট করে উল্লেখ রয়েছে নিবন্ধকৃত নামের কোন পরিবর্তন ও এলাকার বাইরে কার্যক্রম পরিচালনা করা হলে সে নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে। এর পরও কী করে সংস্থাটি তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে তা রহস্যজনক। এ বিষয়ে ানতে চাইলে রংপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মোঃ মনিরুজ্জামান জানিয়েছেন তিনি স্থানীয় সংসদ সদস্য( সংরক্ষিত নারী আসনের) নাসিমা জামান ববির কাছ থেকে বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের প্রতিদিন এ প্রকাশিত খবরের সূত্র ধরে প্রথমে জানতে পারেন, পরে তিনি বৃহস্পতিবার দুপুরে পুলিশের দু’টি গোয়েন্দা শাখাকে এ নিয়ে অনুসন্ধান করে বিষয়টি তাঁকে অবহিত করতে বলেছেন। তাদের বিরুদ্ধে বেআইনি বা প্রতারণার কোন তথ্য পাওয়া গেলে আমরা আইগত ব্যবস্থা নেব।