কাউনিয়ায় তিস্তার ভাঙনে বিলীন ভিটেবাড়ি, আবাদি জমি

কাউনিয়া (রংপুর) প্রতিনিধি:
রংপুরের কাউনিয়ায় বৃষ্টিপাত আর ভারতের উজানের ঢলে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় তীরে ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। তিস্তার তীরবর্তী গ্রামের বাসিন্দারা ভাঙন আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে। তিস্তার অব্যাহত ভাঙনে দিশাহারা হয়ে পড়েছে ভাঙন কবলিত কয়েক শতাধিক পরিবার। নদীভাঙনে শেষ আশ্রয়টুকু হারাতে যাওয়া এলাকাবাসীর দাবি ত্রাণ নয়, তাঁদের নদীভাঙন থেকে রক্ষা করা হোক।
সরেজমিনে দেখা যায়, তিস্তার অব্যাহত ভাঙনে প্রায় পাঁচ শতাধিক পরিবার হুমকির মুখে রয়েছে। সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছে উপজেলার গদাই ও পাঞ্চরভাঙ্গা গ্রাম। এছাড়াও ঝুঁকিতে রয়েছে তালুকশাহাবজ, নিজপাড়া, ঢুষমারা, আরাজী হরিশ্বর, চরহয়বৎখাঁ ও চরগনাই। এসব গ্রামের বাসিন্দাদের প্রতিটি মুহূর্ত ভাঙনের ভয় আর উৎকণ্ঠায় কাটছে।
গত এক মাসে তিস্তার করাল গ্রাসে গদাই ও পাঞ্চরভাঙ্গা গ্রামের বেশ কয়েকটি পরিবারের বসতভিটা ও প্রায় তিন’শ বিঘা ফসলি জমি, বাঁশঝাড়, গাছপালা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
বালাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনছাড় আলী জানান, গত এক মাসে তিস্তার তীব্র ভাঙনে তাঁর ইউনিয়নের দুইটি গ্রামের অনেকের বসতভিটা ও আবাদি জমি নদীতে তলিয়ে গেছে। তিস্তায় যেভাবে ভাঙন দেখা দিয়েছে, তাতে তাঁর এলাকার তীরবর্তী গ্রামের কয়েক শ ঘরবাড়ি ও আবাদি জমি ভাঙনের মুখে রয়েছে। বাঁশ পুঁতে ভাঙনরোধের চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে এগুলো সাময়িক।
আনছাড় আলী বলেন, ভাঙনরোধে পাউবো কিছু বালু ভর্তি জিও ব্যাগ ফেলেছে। কিন্তু তাতে ভাঙন ঠেকনো যাচ্ছে না। পানির স্রোতে জিও ব্যাগ তলিয়ে যাচ্ছে। ‘জরুরি ভিত্তিতে নদী শাসন ও বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা প্রয়োজন। তা না হলে অনেকের ভিটেমাটি ও আবাদি জমি মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে।’
তিস্তার ভাঙনে বসতবাড়ি হারানো গদাই গ্রামের বাসিন্দা মজিরন নেছা বলেন, তিস্তা ভাঙে আর নদীর উপরা কোনোমতে মাথা গুঁজি থাকি। আবাদি জমি সউগ ভাংগি নিয়্যা গেইচে। এবারও নদীর পাড় ভাইংবার নাইগছে। অ্যালা যামো কটাই, মাথা গুজমো কটাই?’
তিস্তাপাড়ে বসবাসকারী খোকা মিয়া বলেন, তাঁরা ত্রাণ চান না। সরকার যেন বরং নদীতে বাঁধ দিয়ে দেয়। বাঁধ না থাকায় নদী তাঁদের সবকিছু শেষ করে দিতে চলেছে।
গদাই গ্রামের ছাত্তার মিয়া বলেন, ‘কী করমো বাহে? হামার এলাকার সবার বাড়িঘর, আবাদি জমি সইগ তিস্তা নদী গিলি খাইল। তাও কায়েও দেখে না কী করি মানুষগুলা বাঁচি আছে। জীবন আর চলে না। কাম নাই, প্যাটত ভাত নাই। শেষ পর্যন্ত মাথাগুঁজি থাকার সম্বলটাও নদীত চলি যাওছে।’
ছাত্তার মিয়ার প্রতিবেশি মোজাম্মেল হক জানান, নদীর তীরবর্তী এলাকার ঘরে ঘরে তিস্তার ভাঙনের আতঙ্ক। তাঁর প্রশ্ন ঘরবাড়ি সরিয়ে যাবেনইবা কোথায়? তাঁদের বাপ—দাদার ভিটা ও আবাদি জমি সব নদীত চলে গেছে। অবস্থাপন্ন গৃহস্থ থেকে তাঁদের এখন পথের ফকির হয়ে যাওয়ার অবস্থা হয়েছে। ঘরের কিনারায় নদী। পানির গর্জন আর ভাঙনের চিন্তায় রাতে চোখে ঘুম আসে না। বাড়ি সরানোর জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়।
ভাঙন কবলিত গদাই এলাকার সুজা মিয়া অভিযোগ করে বলেন, গত বছর থেকে নদী ভাঙছে। ওই বছর এলাকার প্রায় দেড় হাজার বিঘা ফসলি জমি, বাঁশঝাড়, গাছপালা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। পাউবো শুষ্ক মওসুমে ভাঙন প্রতিরোধে জোড়ালো না নেওয়ায় এখন ভাঙন কবলিত পরিবারের অনেকে নিরুপায় হয়ে বসতঘর সরিয়ে নিচ্ছে। আবার কেউ নদীর কিনারায় বাঁশ পুতে শেষ আশ্রয়টুকু রক্ষার চেষ্টা করছে।
তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানি বলেন, অসময়ের তিস্তার ভাঙনে প্রতিবছর এক লাখ কোটি টাকার সম্পদ নদী গর্ভে চলে যায়। তিস্তা খনন, সংরক্ষণ ও মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন করা ছাড়া এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য বিকল্প নেই।
এ বিষয়ে রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, আমরা সার্বক্ষণিক নদীপাড়ের পরিস্থিতির ও নদী ভাঙনের খোঁজখবর রাখছি। গত বছর কাউনিয়ার নদীর তীরবর্তী বিভিন্ন এলাকায় জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙ্গন রোধের চেষ্টা করা হয়েছিল। চলতি মওসুমে গদাই এলাকায় তিস্তার ভাঙ্গন রোধে জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। পাউবো এই কর্মকর্তা আরও বলেন, তিস্তার মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন হলে তিস্তা অববাহিকায় আর সৃষ্ট বন্যা এবং নদী ভাঙন থাকবে না।