কুড়িগ্রামে দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দী:পানি কমলেও কমেনি দুভোর্গ মানুষের

ব্যাপক নদী ভাঙ্গন চলতি বন্যায় বিলন ৪৫৮ পরিবার
আহসান হাবীব নীলু,কুড়িগ্রাম:
ব্রক্ষপুত্র নদের কড়াল গ্রাসে ভিটেমাটি হারিয়ে নি:স্ব আমজাদ আলী (৬৫) একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পানির দিকে। চোখ গড়িয়ে পড়ছে পানি, উদাস মন। ডাকদিতেই হকচকিয়ে উঠেন। নদীর পানিতে কি খোজেন বলতেই, হাউমাউ করে কেেঁদ উঠেন। একটু শান্ত হয়ে বলেন,‘ মোর সব শ্যাষ বাবা। ভিটেমাটির কোন চিহৃ নাই। নিজের বলে আর কিছুই নাই। এ্যালা কোটে যামো , কোটে থাকমো । কাইল (শুক্রবার রাতে) সারা রাইতে ঘুমাই নাই। একটার পর একটা বাড়ি খায়া নেইল রাক্ষুসী নদী। চোখের পলকে সব শ্যাস। ঘর সড়ে নেয়ার সময় শিলছে না। মোর বাড়ি গেইল পইল সন্ধ্যাত। এর পর সাড়া রাইতে একের পর এক বাড়ি ভাঙ্গিগেইল শামসুল হক, মোখছেদ আলী, বেলাল, ফাতেমা, মানিক ও মঞ্জু মিয়ার বাড়িঘর সোগ। রাইতজাগি টানাটানি করি যতটুক বাঁচানো যায় কাপড়—চোপর জিনিসপত্র। ভিটেমাটি না থাকলে নিজের বলে আর কিছুই থাকে না। এ্যালা হামার কোন ঠিকানা নাই।’—এই কষ্টের কথা গূলো উলিপুর উপজেলার ব্রক্ষপুত্র নদের মাঝের ইউনিয়ন হকের চর গ্রামের। একই গল্প এখানকার শত পরিবারের।
সাহেবের আলগা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোজ্জাফর হোসেন বলেন, চলতি বন্যায় তার ইউনিয়নে ১৯৭ পরিবার নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়ে নি:স্ব হয়েছে। এর মধ্যে হকের চরে ৯০ পরিবার, দক্ষিণ নামাজের চরে ৪৭ পরিবার ও দৈখাওয়ার চরে ৬০ পরিবার ভাঙ্গনের শিকার হয়। তিনি আরো জানান, এই ইউনিয়নে প্রায় ৬ হাজার ৫০০ পরিবার এর মধ্যে ৫০০ পরিবার স্বচ্ছল। বাদবাকী সবাই কম বেশি গরিব। প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ পানিবন্দী। এখন পর্যন্ত ত্রাণ পেয়েছেন ২টন চাল আর ১০০প্যাকেট শূকনা খাবার। এর মধ্যে বিভাগীয় কমিশনার এসে বিতরণ করেছেন ২৯০ কেজি চাল আর উপজেলা পরিষদ থেকে ১৫০ প্যাকেট শূকনা খাবার। ফলে অনেকের কাছে ত্রাণ পৌছানো সম্ভব হয়নি।
হকের চরের আমজাদ আলীর তিন সন্তান শাহীন (১৭), আয়শা (১৫) ও সুমন (১২) আর স্ত্রীকে নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে হাটছেন। আপাতত আত্নিয়র বাড়িতে আশ্রয় নিবেন। এই হকের চরের মানুষ বন্যায় একদিন শূকনা খাবার ছাড়া আর কোন ত্রাণ তাদেও ভাগ্যে জোটেনি।
হাজরা বেগম বলেন, ‘হকের চরের গুচ্ছ গ্রামে সরকারি ঘরে আছলং। নদী ভাঙ্গনে সে ঘরগেইল। তোমরা একনা নেকিদেন বাহে হামাক জানি সরকার ফির ঘর দেয়। নাইলে থাকমো কোনটে।’
রোকেয়ার স্বামী কৃষি শ্রমিক শাহাবুল। স্বামী—স্ত্রী দুজনে মিলে ভাঙ্গা ঘরের জিনিসিপত্র নিয়ে নৌকায় উঠছেন। রোকেয়া জানান, গুজিমারীর চেও বোনের বাড়িতে আশ্রয় নিতে যাচ্ছেন। ছেলে রুহুল আমিন এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছেন উলিপুরে একটি ছাত্রাবাসে থেকে। আর মেয়ে শারমিন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী পড়শুেনা বন্ধের উপক্রম। কারণ স্কুল অনেক দূরে যাতায়াত সমস্যা।
শাহাবুদ্দিন (৭০), হাজেরা বেওয়া (৬৫) কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, ২০১০ সাল থেকে এই চরে থাকি। ২০১৯ সালে সরকার গুচ্ছ গ্রামে ঘর দেয়। এই ঘর সব নদী খায়া নিলো। এলা মাথাগোজার ঠাই নাই। যাচ্ছেন দক্ষিণে চিলমারী উপজেলার রাণীগঞ্জ ইউনিয়নের এক চরে। তাদের দাবি সরকার যেন দ্রুততম সময়ে নতুন আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেদেন।
হাতিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল হোসেন বলেন, হকের চরটিকে ব্রক্ষপূত্র ভাঙ্গছে ইউ আকারে। গোটা চরটি পর্যায়ক্রমে নদীর পেটে যাচ্ছে। এই চরের অবস্থান হাতিয়া ইউনিয়ন, নয়ারহাট, সাহেবের আলগা ও রাণীগঞ্জের সীমানা এলাকা। এই চরে এই চার ইউনিয়নের লোক বিভিন্ন সময় নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়ে আশ্রয় নেয়। ফলে কোন ইউনিয়ন পরিষদ এদের খুব একটা খোজ খবর রাখে না। ফলে এরা বরাবরই অবহেলিত থাকছে।
উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের গুজিমারী আবাসনে গিয়ে দেখা যায় ৯০টি পরিবারের চরম দুর্ভোগের চিত্র। প্রায় ২০দিন ধরে এখানকার মানুষ পানিবন্দি জীবন যাপন করছেন।কাজ নেই, নেই হাতে টাকা। ফলে চলছে মানবেতর জীবন যাপন। এর পরেও এই চরে এখন পর্যন্ত পৌছেনি সরকারি কোন ত্রাণ সহায়তা। এমন অভিযোগ করেন ফুল মিয়া (৬৫), দুলু (৬০), মুকুল (৫৭), সাহেরবানু বেওয়া (৭০), রহিমা বেওয়া (৬৫) সহ অনেকে।রহিমা বেওয়া অণ্যেও বাড়িতে কাজ করলে খাবার পায় না পেলে উপোস করতে হয়। বন্যার কারনে এখন তাকে কেউ কাজে নেয় না। ফলে তার দুর্ভোগ সীমাহীন। আর সাহের বানুর জীবন চলে ভিক্ষা করে। কিন্তু বানের পানি চতুর দিকে তাই ভিক্ষেও বন্ধ ।
শনিবার কুড়িগ্রামে ব্রক্ষপুত্র নদের পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিলো। এছাড়া ধরল ও দুধকুমার নদীর পানি কিছুটা হ্রাস পেয়ে বিপদসীমার সামান্য নীচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডেও উপ—বিভাগীয় প্রকৌশলী আফসান জানি এতথ্য নিশ্চিত করে বলেন, একই সঙ্গে পানি কমার সাথে সাথে দেখা দিয়েছে তীব্র ভাঙ্গন।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ জেলা প্রশাসকের দপ্তরের কন্ট্রোল রুমের বরাতে জানান, জেলার ৯ উপজেলা ৫৫টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা বন্যা আক্রান্ত হয়েছে। প্লাবিত হয়েছে ৬৬২ দশমিক ৭৫ বর্গ কি: মিটার। বন্যা আক্রান্ত পরিবারের সংখ্যা ৩৭ হাজার ১০০টি। নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়েছে ৪৫৮টি পরিবার। ফসলের ক্ষতি হয়েছে ৭ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমির। বন্যার্তদের সেবায় ৮৩টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। জেলার ৯ উপজেলায় ১৩০০ মে. টন চাল ও ৩৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এছাড়া দেয়া হয়েছে শূকনা খাবার বরাদ্দ। এখন পর্যন্ত ৫৮৭ মে.টন চাল, ৩২ লাখ ৮৫ হাজার টাকা এবং ২৪ হাজার ৩৬০ প্যাকেট শূকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। বিতরণ কার্যক্রম চলমান আছে। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় মানুষজন ঘরে ফিরতে শুরু করেছে।
এছাড়া বন্যার্তদের মাঝে ৫লাখ ১১ হাজার ৬৫০টি পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, ২০ হাজার ১২৬টি জেরিকেন সরবরাহ, নলকূপ মেরামত করা হয়েছে ৫৫টি, নতুন নলকূপ স্থাপন ৬টি এবং ল্যাট্রিন স্থাপন ৬টি করা হয়। এছাড়া হাইজিন কিটস বক্স ৬৫টি বন্যার্তদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে।