১৭ বৈশাখ, ১৪৩২ - ৩০ এপ্রিল, ২০২৫ - 30 April, 2025

রংপুরে কোটা বিরোধী আন্দোলকারী নিহত ১, আহত অর্ধশতাধিক

আমাদের প্রতিদিন
9 months ago
295


ক্যাম্পাসে অবস্থান নিয়েছে শিক্ষার্থীরা

        পুলিশের গাড়ীতে অগ্নি সংযোগ

        চার প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন

নিজস্ব প্রতিবেদক:

রংপুরে কোটা বিরোধী আন্দোলকারী শিক্ষার্থীদের সাথে পুলিশ ও ছাত্রলীগের ত্রিমুখি সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদ নামে বেগম রোকেয়া বিশ^বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে। আহত হয়েছেন সাংবাদিক ও শিক্ষার্থীসহ প্রায় অর্ধশতাধিক। নিহত শিক্ষার্থীর লাশ হাসপাতাল থেকে বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিয়ে আসার পথে পুলিশ ছিনিয়ে নেয়। এর প্রতিবাদে সন্ধ্যায় বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে  পুলিশের গাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। পুলিশের হামলায় একজন শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনার প্রতিবাদে বেরোবি’র ছাত্রলীগ নেতা পিয়াস আহমেদ পদত্যাগ করেছেন।

এর পরপরই নগরীতে বিজিবি মোতায়ের করা হয়েছে।  বেগম রোকেয়া বিশ^বিদ্যালয়লের শিক্ষার্থীসহ নগরীর কারমাইকেল কলেজ, রংপুর পলিটেকনিক্যাল ইনিস্টিটিউট, রংপুর সরকারী কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আন্দোলকারীরা বিশ^বিদ্যালয় ক্যম্পাস, কারমাইকেল কলেজের সামনে লালবাগ, খামার মোড়, চকবাজার,  মর্ডাণ মোড়, পাশ^^বর্তী রংপুর ঢাকা মাহসড়ক ও নগরীর পুলিশ কমিশনারের অফিসের সামনে বক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা অবস্থান নিয়েছে। এ সময় সন্ধ্যায় কাম্পাসে ভিসির প্রটোকলে থাকা পুলিশের গাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে আন্দোলনকারীরা।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনতে রংপুরে পুলিশর পাশাপাশি বিজিবি চার প্লাটুন মোতায়েন করা হয়েছে। পরিস্থিতি যে কোন মূহুর্তে আরও সংঘাতপূর্ণ হয়ে ওঠার আশংকা করা হচ্ছে। নিহত শিক্ষার্থীর মরদেহ রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (রমেক)মর্গে রাখা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা যাতে ওই মরদেহ নিতে না পারে সে জন্য রমেক হাসপাতালের তিনটি গেটে ব্যাপক সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

নিহত সহপাঠীর লাশ রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ষ্ট্রেচারে করে মিছিল নিয়ে আসার পথে পুলিশ লাইনস এর সামনে তাদের গতিরোধ করে। এ সময় পুলিশের সাথে শিক্ষার্থীদের হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এক পর্যায়ে পুলিশের গাড়ীর সামনে শুইয়ে পড়ে প্রতিরোধ গড়ে তুললে পুলিশ লাশ ছিনিয়ে নিয়ে গাড়ীতে করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হীমঘরে নিয়ে যায় এবং সেখানে রেখে

নিহত ওই শিক্ষার্থীর নাম আবু সাঈদ। তিনি বেরোবির ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। তার বাবার নাম মকবুল হোসেন। তার গ্রামের বাড়ি রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার জাফরপাড়া বাবনপুরে বলে জানা গেছে।

প্রত্যক্ষদর্শীর ভাস্যমতে ও সরজমিনে দেখা গেছে, মঙ্গলবার দুপুরে বেরোবির কোটা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে শহরের লালবাগ এলাকা থেকে ক্যাম্পাসের দিকে যায়। এরপর ক্যাম্পাসে প্রবেশের চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের বাঁধা দেয়। এক পর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ বাধে। ঘটনার সময় ওই শিক্ষার্থী বিশ^বিদ্যালয়ের গেটের বিপরীতে পুলিশের সামনে বুক পেতে পুলিশের গুলির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। তখন পুলিশ একপি দল বিশশ^বিদ্যালয়ের গেটের সামনে থেকে নিহত শিক্ষার্থীকে লক্ষ্য করে সরাসরি গুলি ছোড়ে। পর পর কয়েকটি গুলি ছুড়লে সে ঘটনাস্থলে লুটিয়ে পড়লে তার সহাপাঠিরা তাকে রিকশা করে রংপুর মেপেকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে জরুরী বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক আশিক আরিফিন তাকে মৃত ঘোষনা করেন। ওই চিকিৎসক জানিয়েছেন তার সামনে বুকের মধ্যে একাধিক বুলেট ইঞ্জুরি রয়েছে। ময়না তদন্ত রিপোর্টে জানা যাবে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ। ঘটনা সময় দেখা গেছে পুলিশের একটি অতি উৎসাহী দল বিনা উস্কানিতে ছাত্রদের ওপর পেরোয়া হয়ে ওঠে। প্রায় শতাধিক রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর।  শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে রাবার বুলেট ছোড়ে। এ সময় বিশ^বিদ্যালয় এলাকার প্রায় অর্ধ কিলোমিটার জুড়ে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। এঘটনায় অন্তত অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছে বলে জানা গেছে। পুলিশের সাথে হামলার ঘটনায় ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাকর্মীরা ওই হামলার সাথে যোগ দেয় বলে প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন। রমেক হাসপাতারে জরুরী বিভাগের ভর্তি রেজিষ্টা্ররে  হাসপাতালে ভর্তিকৃত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আহত শিক্ষার্থীদের তালিকা ২৪ জনের নাম জানা গেছে। এদের মধ্যে রয়েছেন, নুর(২৪), শাহিদ(২৪), ছাব্বির(২৪), অজানা(২২), সিয়াম(২৩), তুহিন(২৫), হাসান, (২৫), সোহেল রানা (২২), নাঈমুল(২৮), সবুর(২২), সোহান(২৩), জাহিদ(১৮), নাহিন(১৮), সন্তু শর্মা(২৩), চন্দ্র শিখর(২২), মতিউর(২২), বেলাল(২৩), মারুফ (২৭), শরিফুল ইসলাম সুমন(২৫), আলাউদ্দিন(২২), আবির হোসেন(১৯), রায়হান(২৪), বেঞ্জির(২৫) পাপুল(২৩) ও সময় টেলিভিশন এর ক্যমেরাপর্সন তরিকুল ইসলাম(৩৩)। এছাড়া আহত হয়েছেন রংপুর সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজের শিক্ষার্থী মেফতাহুল জান্নাত(১৯) তার চোখের নীচে রাবার বুলেটের ছড়া লেগেছে। তার বাবা  নগরীর আনন্দলোক বিদ্যাপীঠ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মফিজুল ইসলাম। তিনি জানিয়েছেন মেয়েকে তিনি চিকিৎসক দেখিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। চিকিৎসক জানিয়েছেন তার মেয়ে শংকামুক্ত আছেন। খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে আহত হয়েছেন, সময় টিভির সাংবাদিক আব্দুর রশিদ জীবন(২৪), এশিয়ান টিভির সাংবাদিক বাদশা ওসমানি(৩৮), দৈনিক পরিবেশের সাংবাদিক শাকিল হোসেন(২৬), যুগান্তরের উদয় চন্দ্র বর্মন( ৩৩), বাংলা ভিশন টিভির ক্যামেরা পার্সন শাহ নেওয়াজ জনি এদের বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। হাসপাতল সূত্রে জানা গেছে যারা আহত হয়েছেন তাদের বেশিরভাগই বুলেট, টিয়ার শেল ও ইট ও লাঠির আঘাতে আহত হয়েছেন।

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ইউনুস আলী জানিয়েছন হাসপাতালে আহতদেও চিকিৎসার জন্য সার্বক্ষনিক নাজরদারী রাখা হয়েছে।

এবিষয়ে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, কোটা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিভিন্ন স্কুল—কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা যোগ দেন। তারা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান। অনেক পুলিশ সদস্য এতে আহত হয়েছেন। কিন্ত তিনি তৎক্ষনিক কোন আহত পুলিশ সদস্যেও নাম জানননি। একজন শিক্ষার্থী মারা গেছে বলে শুনেছি তিনি কীভাবে মারা গেছেন তা বলতে পারছি না।

এদিকে মঙ্গলবার কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা ও শিক্ষার্থীদের অবমাননা করার প্রতিবাদে রংপুরে রাজপথে সকাল থেকে নেমে আসে নগরীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তাদের স্লোগানে উত্তাল রংপুর নগরী। এতে সরকারি—বেসরকারি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী অংশ নেন।

সকাল সাড়ে ১০টায় রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতাল চত্বরে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে। তারা দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেওয়া সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা, নির্যাতন ও গুলিবর্ষণের ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান। একই সঙ্গে কোটার যৌক্তিক সংস্কারসহ মেধার মূল্যায়নে যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

এদিকে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রংপুর জিলা স্কুল মোড় থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। রংপুর জিলা স্কুলের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীদের ব্যানারে মিছিলটি বের হলেও এতে রংপুরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। শুরুতে পুলিশ তাদের মিছিলে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও পরে পুলিশি নিরাপত্তায় শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে প্রেসক্লাবের দিকে এগিয়ে যান। এসময় রংপুর মেডিকেল কলেজ, রংপুর সরকারি কলেজ, সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজ, রংপুর সরকারি সিটি কলেজ, রংপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, রংপুর জিলা স্কুল, সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও লায়ন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে যুক্ত হলে মিছিল বড় আকার ধারণ করে। তাদের বিভিন্ন স্লোগানে স্লোগানে উত্তাল হয়ে উঠে নগরী।

মিছিলটি প্রেসক্লাব চত্বরে পেঁৗছালে শিক্ষার্থীরা আবারও পুলিশের বাঁধার মুখে পড়েন। প্রায় বিশ মিনিট সেখানে সড়কে অবস্থান করার পর মিছিল নিয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন রংপুর—ঢাকা মহাসড়ক অভিমুখে রওনা দেন তারা। নগরীর লালবাগ এলাকায় পেঁৗছলে এই মিছিলে কারমাইকেল কলেজ ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মিছিলে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কোটাবিরোধী স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে নগরীর প্রধান সড়ক ও পাশ^বর্তী এলাকা

আন্দোলনকারীরা মিছিল থেকে অভিযোগ করে বলেন, কোটা সংস্কারের দাবিতে সারাদেশে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলা করেছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের শরীর থেকে রক্ত ঝড়িয়েছে। হামলার শিকার আহত শিক্ষার্থীরা হাসপাতালেও নিরাপদ নন, সেখানেও ছাত্রলীগ হামলা চালিয়েছে। শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলনকে ভিন্নভাবে প্রভাবিহ করতে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে তারা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। যে স্লোগান নিয়ে আন্দোলনকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে, সেই স্লোগানের পুরোটা তাদের কানে পেঁৗছেনি। অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অংশ নেওয়া কি অপরাধ?

এদিকে বিক্ষোভ থেকে যেকোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে মিছিলের সামনে—পেছনে বিপুল সংখ্যাক পুলিশ দেখা গেছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা মিছিলে বিভিন্ন স্লোগান সম্বলিত প্ল্যাকার্ড, পোস্টার, ব্যানার প্রদর্শন করেন। এর পাশাপাশি তাদের অনেকের হাতে থাকা লাঠিতে জাতীয় পতাকা বেধে রাখতে দেখা যায়। এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ( বিকেল ৬ টা পর্যন্ত) আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন পার্ক মোড় এলাকায় অবস্থান নিয়েছে হাজার হাজার শিক্ষার্থী।

এর আগে বেলা ১১টার দিকে রংপুর প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। সমাবেশ থেকে তারা কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ—পুলিশের হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। একই সঙ্গে অবিলম্বে শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি মেনে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্য সংস্কারের দাবি করেন।

 

 

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

// Set maxWidth