আমন আবাদ নিয়ে চরম বিপাকে দিনাজপুরের কৃষকরা

আমন আবাদের শুরুতেই হোচট খাচ্ছেন কৃষক
দিনাজপুর ও বীরগঞ্জ প্রতিনিধি:
ষড়ঋতুর এই বাংলাদেশে আষাঢ় ও শ্রাবন বর্ষাকাল। বাংলা দিনপঞ্জির হিসাবে আষাঢ় পেরিয়ে শ্রাবনের অর্ধেক মাস গড়ালেও ভরা বর্ষাকালে কাঙ্খিত বৃষ্টির দেখা নেই ‘ধানের জেলা’ হিসেবে খ্যাত দিনাজপুরে। এতে আমন ধান আবাদ নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। কাঙ্খিত বৃষ্টি না হওয়ায় জমিতে পানির অভাবে অনেক কৃষক এখন সেচ দিয়ে রোপন করছেন আমন চারা। পাশাপাশি জমির রোপনকৃত চারা রক্ষায় প্রায় প্রতিদিনই সেচ দিতে হচ্ছে সেচযন্ত্র দিয়ে। এতে বৃষ্টি নির্ভর এই আমন আবাদ করতে বিঘাপ্রতি বাড়তি খরচে হিমসিম খাচ্ছেন কৃষকরা। বর্ষা মৌসুমেও স্বাভাবিক বৃষ্টি না হওয়ায় কৃষি বিভাগ এই পরিস্থিতিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে আখ্যায়িত করে কৃষকদের সম্পুরক সেচ ব্যবস্থায় আমন চারা রোপনের পরামর্শ দিচ্ছেন। কৃষি বিভাগের হিসাবমতে, দিনাজপুর জেলায় ভরা বর্ষাকালেও বর্তমানে ১৭ হাজার ৩০১টি সেচযন্ত্র চালু করে আমন আবাদ করছেন কৃষকরা।
সোমবার (২৯ জুলাই) দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার গ্রামাঞ্চলে গিয়ে শোনা যায়, ফসলের প্রান্তর জুড়ে শ্যালো মেশিনের শব্দ। বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে স্থাপন করা হয়েছে শ্যালো মেশিন। আমনের চারা রোপনের সময় গড়িয়ে যাওয়ায় অবশেষে শ্যালো মেশিন স্থাপন করেই আমন রোপন শুরু করেছেন কৃষকরা। আবার কেউ কেউ রোপনকৃত আমনের চারা রক্ষায় জমিতে নিয়মিত সেচ দিচ্ছেন।
বীরগঞ্জের নিজপাড়া ইউনিয়নের দামাইক্ষেত্র গ্রামে কথা হয় কৃষক শাহজাহান সিরাজ বুলবুলের সাথে। তিনি জানান, কাঙ্খিত বৃষ্টির অভাবে জমিতে পানি না থাকায় ৩০ বিঘা জমিতে সেচ দিয়ে আমন রোপন করতে হয়েছে। চারা রোপনের সময় প্রতিবিঘায় সেচ দিতে ডিজেল খরচ হয়েছে প্রায় ৪ লিটার। এতে চারা রোপন করতেই বিঘাপ্রতি বাড়তি খরচ হয়েছে প্রায় ৫’শ টাকা। এই ৩০ বিঘা জমির মধ্যে ১০ বিঘা জমি উচু। এই উচু জমির রোপনকৃত চারা রক্ষায় প্রতিদিনই দিতে হচ্ছে সেচ। এতে প্রতিদিন এক বিঘা জমিতে সেচ দিতে খরচ হচ্ছে ২ লিটার ডিজেল। যাতে প্রতিদিন বিঘাপতি খরচ হচ্ছে প্রায় আড়াই’শ টাকা করে। এই বাড়তি খরচ যোগাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে বলে জানালেন তিনি।
একই উপজেলার সুজালপুর গ্রামে কথা হয় কৃষক সফিকুল ইসলামের সাথে। তিনি বলেন, ১০ বিঘা জমির আমন চারা রোপন করেছি সেচ দিয়ে। এখন আবার রোপনকৃত আমন ক্ষেত রক্ষায় একদিন পর পর সেচ দিতে হচ্ছে। বৃষ্টি হলে এই খরচ তার লাগতো না। তিনি বলেন, আমরা যখন ধান বিক্রি করি, তখন ঠিকমতো দাম পাইনা। এই বাড়তি খরচ তুলবো কি করে?
দিনাজপুরের বিরল উপজেলার রাজারামপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায় একই চিত্র। ওই গ্রামের কৃষক ফনিন্দ্র নাথ রায় বলেন, আমরা সাধারণত বোরো চাষ করি সেচ দিয়ে, আর বর্ষাকালে আমন আবাদ করি বৃষ্টির পানি দিয়ে। কিন্তু এবার বৃষ্টির আশায় থেকে থেকে আমন রোপনের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। তাই বাধ্য হয়েই শ্যালো মেশিন দিয়ে আমন রোপন শুরু করেছি। তিনি বলেন, বোরো আবাদের সময় সেচের জন্য নালা করলেও বৃষ্টি নির্ভর আবাদ হওয়ায় আমন মৌসুমে তা তুলে ফেলা হয়েছে। এখন একদিকে ডিজেল কিনতে হচ্ছে, অন্যদিকে সেচ দেয়ার জন্য নালার বদলে পাইপ কিনতে হচ্ছে। এতে বাড়তি খরচ যদি এখনই করে ফেলি, তাহলে পরবর্তীতে সার—বিষ কিনবো কি করে। এ নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় কৃষক ফনিন্দ্র নাথ রায়।
রাজরামপুর ইউনিয়নের উপ—সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আফজাল হোসেন জানান, আমন আবাদের প্রকৃত সময় আষাঢ় মাসের ২৫ তারিখ থেকে শ্রাবন মাস পর্যন্ত। কিন্তু শ্রাবন মাসের অর্ধেক চলে যাচ্ছে। এরপরও কাঙ্খিত বৃষ্টি না হওয়ায় জমিতে পানি নেই। তাই কৃষকদের সম্পুরক সেচ ব্যবস্থা চালু করে আমন রোপনের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। যদিও এতে কৃষকদের বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে বলে জানান তিনি।
দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ—পরিচালক মোঃ নুরুজ্জামান জানান, দিনাজপুর জেলায় মোট ২ লাখ ৬০ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে আমন ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই ১ লাখ ২৪ হাজার ১৪৫ হেক্টর জমিতে আমন রোপন করা হয়েছে। যা মোট লক্ষ্যমাত্রার ৪৮ শতাংশ। ভরা বর্ষা মৌসুমেও কাঙ্খিত বৃষ্টি না হওয়াকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করেন তিনি। তিনি বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপেক্ষা করে আবাদ তো করতে হবে। তাই কৃষকদের সম্পুরক সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে আমন রোপনের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে। এতে বাড়তি খরচ হলেও কয়েকদিনের মধ্যে বৃষ্টি হলেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
উপ—পরিচালক মোঃ নুরুজ্জামান জানান, জমিতে সেচ দেয়ার জন্য দিনাজপুর জেলায় গভীর ও অগভীর মোট ৭৬ হাজার ৬৪২টি সেচযন্ত্র। যা সাধারণত বোরো মৌসুমে ব্যবহৃত হয়। বর্ষা মৌসুমেও কাঙ্খিত বৃষ্টি না হওয়ায় ইতিমধ্যেই দিনাজপুর জেলায় ১৭ হাজার ৩০১টি সেচযন্ত্র চালু করে আমন আবাদ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
দিনাজপুর আঞ্চলিক আবহাওয়ায় পর্যবেক্ষনাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তোফাজ্জল হোসেন বলেন, দিনাজপুরে সবশেষ মাত্র ৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে গত ২২ জুলাই। তার আগে ২০ জুলাই বৃষ্টিপাত হয় মাত্র ১ মিলিমিটার। বর্ষাকাল হিসেবে যা সামান্যই বলা যায়। আবহাওয়ার পুর্বাভাস অনুযায়ী তিনি আশাপ্রকাশ করেন দু—একদিনের মধ্যেই সামান্য বৃষ্টিপাত হতে পারে। আর আগামী ৬ আগস্ট থেকে এই অঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।