৩১ ভাদ্র, ১৪৩১ - ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ - 15 September, 2024
amader protidin

বছরে পড়ছে দুই কোটি টন পলি,তিস্তায় কমছে পানির ধারণ ক্ষমতা

আমাদের প্রতিদিন
1 week ago
44


নির্মল রায় , গঙ্গাচড়া(রংপুর):

দেশের সবচেয়ে দারিদ্র্য ও গরিব জেলাগুলোর পাঁচটিই সর্বনাশা তিস্তাজুড়ে। ভারতের সিকিম থেকে বাংলাদেশে ঢুকে পড়া খরস্রোতা নদীখ্যাত তিস্তা প্রবাহিত হয়েছে লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার বুক চিরে। এখানকার লাখ লাখ মানুষের দুঃখ-দুর্দশার নাম এই নদী। ২৩৭ বছর বয়সী তিস্তার প্রবাহ এই পাঁচ জেলার বুক চিরে প্রতিবছরই ডেকে আনছে বন্যা ও খরা। প্রতিবছর সময়-অসময়ে বন্যায় পানির ধারণক্ষমতা কমে গেছে তিস্তা নদীর। উজানের পলিতে ভরাট হয়েছে নদীর বুক। ফলে বর্ষায় ভারতে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিতে তিস্তায় বন্যা দেখা দিচ্ছে। ফসল, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাটসহ অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। অপরদিকে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদী শুকিয়ে মরা খালে পরিণত হচ্ছে। অনেক স্থানে হেঁটে নদী পারাপার হন স্থানীয়রা।

রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, উজানের ঢলের সঙ্গে প্রতি বছর দুই কোটি টন পলি বয়ে আনে তিস্তা নদী। এতে করেই তিস্তা নদীর বুক ভরাট হচ্ছে এবং স্বল্প বৃষ্টিতেই বন্যা দেখা দিচ্ছে। গত বছর অক্টোবরে ভারতে বাঁধ ভেঙে যায়। ফলে তিস্তা নদীতে সেই বাঁধ ভাঙ্গা পানি প্রবাহিত হয়। ওই বছর ব্যাপক পরিমাণ পলি বয়ে আসে তিস্তা নদীতে।

তিস্তার বুক পলিতে ভরে যাওয়ায় কাউনিয়া পয়েন্টে বিপদসীমা পরিবর্তন করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। পূর্বে কাউনিয়া পয়েন্টে বিপদসীমা ছিল ২৮ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটার। গত জুন মাসে এ পয়েন্টে বিপদসীমা ৫৬ সেন্টিমিটার বাড়িয়ে ২৯ দশমিক ৩১ সেন্টিমিটার নির্ধারণ করা হয়েছে।

জানা যায়, বর্ষা মৌসুমে বেশি বৃষ্টি হলে গজলডোবা বাঁধের সবগুলো জলকপাট খুলে দেয় ভারত। পানির চাপ বেশি হলে লালমনিরহাটের তিস্তা ব্যারেজের সব জলকপাট খুলে দিতে হয় কর্তৃপক্ষকে। এতে করে নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধায় জেলায় বন্যা দেখা দেয়। বন্যার ঘোলাটে পানির স্রোত ধেয়ে আসতে থাকে ভাটির দিকে। এর সঙ্গে বিপুল পরিমাণ পলি আসায় তিস্তা নদীর বুক ভরাট হয়ে এসেছে। পলিতে নদীর বুক উঁচু হওয়াতে স্বল্প পানিতেই নদী টইটম্বুর হয়। পানি ঢুকে পড়ে লোকালয়ে। সেই সঙ্গে বর্ষা ও শৎরকালে বারবার ক্ষণস্থায়ী বন্যায় ভাসতে হয় তিস্তা পাড়ের মানুষকে। নষ্ট হয় তাদের জীবিকার একমাত্র পথ চরের কৃষি। নদী শাসন, ড্রেজিং না হওয়ায় প্রতি বছর নতুন নতুন করে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা বাড়ছে।

রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার লহ্মীটারী ইউনিয়নের মহিপুর এলাকার আসিফ মিয়া বলেন, এই যে দ্যাখতোছেন তিস্তার পানি। সউগ কিন্তু ঘোলা। মানে নদীর পানির সাতে ম্যালা মাটিও আসতোছে। শুকানের সমায় এই মাটি দেখা যায়। নদী তো মাটিত ভরি গেইছে। হামরা নদীর মাঝোত সেই মাটিত আবাদ করি। নদী ভরাট হয়া গেইছে, সেই জন্তে অল্প একনা পানিতেই হামরা ভাসি যাই।

চর ইছলি গ্রামের কৃষক মফিজুল ইসলাম বলেন, হামরা নদীপাড়ের মানুষ। সুখ-দুক্কের হিসাব করার সময় নাই। খরা, বান-সাঁতাওয়ের সঙ্গে হামার বসবাস। এ তিস্তা নদী হামাক কোনো সময় কান্দায়, ফির হাসায়। নদীত আর আগের মতো গভীরতা নাই। বছরে বছরে পলিবালু পড়ি পড়ি নদীর বুক ভরাট হওছে। সরকার তো নদী খননসহ তিস্তা মহাপরিকল্পনার কতা কছলো কিন্তুক কাম করে নাই। এ্যলা বন্যা হইলে ঘোলা পানি বেশি আইসে।

রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, পাহাড়ি ঢল থেকে তিস্তা নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। প্রতি বছর তিস্তা নদী দুই কোটি টন পলি বয়ে আনে। গত বছর অক্টোবরে ভারতে বাঁধ ধসের কারণে বিপুল পরিমাণ পলি এসেছে। ফলে তিস্তা নদীর বুক উঁচু হয়েছে। তাই অল্প পানিতেই উত্তরের ৫ জেলায় বন্যা দেখা দিচ্ছে।

রিভারাইন পিপলের পরিচালক অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, উত্তরের জীবন রেখা তিস্তা নদী। এটির বয়স ২৩৫ বছর। কিন্তু এই নদী নিয়ে এখন পর্যন্ত যৌথ কোনো সমীক্ষা হয়নি। তিস্তা ১০ হাজার কিউসেক পানি ধারণ করতে পারে। কিন্তু সেখানে ওই পরিমাণে পানি শুষ্ক মৌসুমে আসে না। তিস্তার বুক ভরাট হওয়ায় আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে নদী ড্রেজিং করতে হবে।’ তিস্তার পানি ভারত আটকে না রাখলে, তা বঙ্গোপসাগরে চলে যেত। একদিকে পানির প্রবাহ নেই, অপরদিকে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। বাংলাদেশের উচিত আন্তর্জাতিক পানি কনভেনশনে স্বাক্ষর করে তিস্তার মতো যৌথ নদীগুলোর পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করা।’

তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি নজরুল ইসলাম হক্কানী বলেন, খরাকালে গজলডোবায় বাঁধ দিয়ে শুকনো মৌসুমে পানি আটকে রাখে ভারত। আবার একটু পানি বেশি হলেই বাংলাদেশকে কিছু না জানিয়ে গজলডোবার গজবে ভাসাচ্ছে এ অ লের মানুষদের। এতে প্রতিবছর ব্যাপক ফসলহানি ঘটছে। হুমকিতে পড়ছে খাদ্যনিরাপত্তা। নদীভাঙনে বাড়ছে উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা, বাড়ছে রংপুর বিভাগে গড় দারিদ্র্যের হার। তিস্তায় সারা বছর পানির প্রবাহ ঠিক রাখা, ভাঙন, বন্যা, খরায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকসহ অসহায় মানুষের স্বার্থ সংরক্ষণ এখন সময়ের দাবি। তিস্তা বাঁচাতে শুধু আশ্বাস নয়, চুক্তির মাধ্যমে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়