পীরগঞ্জের শান নদীর তীরে ঘুরছে গরুর হাল, ফসল চাষে ঝুঁকছে চাষিরা বারো মাস
"ফসল উৎপাদন বেড়েছে কৃষি পল্লীতে"
"বিলের তলা থেকে চাষিদের গোলায় উঠছে ধান"
"চারিদিকের সবুজের সমারোহ"
আজাদুল ইসলাম আজাদ, পীরগঞ্জ রংপুর:
রংপুরের পীরগঞ্জে বিএমডিএ'র উপহার কৃষিতে জমির শ্রেণি পরিবর্তনে এনে দয়েছে সবজি চাষ। দলা শ্রেণির জমি এখন ভিটা হিসাবে সবজি বুনছে চাষিরা। শান নদী খননের ফলে কৃষিতে পরিবর্তন দেখা দিয়েছ।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানাযায় , পীরগঞ্জ উপজেলার ৩ টি ইউনিয়নের ১০ থেকে ১২ টি বিলের হাজার হাজার একর জমিতে জলাবদ্ধতা কৃষকদের স্বপ্ন কেড়ে নিয়ে ছিল। গত ২ বছর আগেও এলাকার হাজার হাজার একর কৃষি আবাদি জমি থেকে চাষিরা ফসল ঘরে তুলতে পারতো না। আশায় আশায় চাষিরা ফসল বুনে যায় ভরা মৌসুমে কৃষি জমি থেকে চাষিরা খালি হাতে বাড়িতে ফিরিয়ে আসে। চাষিদের স্বপ্ন ফেরাতে বরেন্দ্র উন্নয়ন বহুমুখী কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) মরা শান বা নলেয়া নদী খননের কাজ হাতে নেয়। প্রায় ১৯ কিলোমিটার নদী খনন কাজ শেষ করে। এতে করে শোনার ফসল চাষিদের গোলায় উঠছে। মহা আনন্দে এলাকার চাষিরা স্বপ্নের ফসল বুনছে জমিতে।
খেলা হাটি গ্রামের মৃত সফর উদ্দিনের ছেলে আব্দুর রাজ্জাক প্রধান বলেন, আমাদের এলাকার মানুষ কৃষি কাজের উপর নির্ভর । দীর্ঘদিন থেকে রংপুর ও মিঠাপুকুর এলাকা থেকে বৃষ্টির পানি এসে খাল বিলেগুলোর কানায় কানায় ভরপুর হতো। কতিপয় মানুষ ব্রিটিশ আলমের নদী দখল নিয়ে মাট ভরাট করে প্রবহমান পানির রূপরেখা পাল্টে দিয়েছিল। এতে করে হাজার হাজার একর কৃষি জমির ফসল সময়ে অসময়ে জলাবদ্ধতার খোরাক হিসাবে খেয়ে নিতো। ফলে এলাকার কৃষকের জমি থেকেও নিঃস্ব হয়ে পড়েছিল। অনেকই কৃষি কাজ ছেড়ে কাজকর্মের সন্ধানে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়াতো। এটি খননের ফলে নদী তার প্রাণ ফিরে পেয়েছে সেসাথে চাষিরাও শোনার ফসলের চাষাবাদে ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
তিনি আরও বলেন, জলাবদ্ধতার পানি গিলে খেয়ে ফেলছে শান নদী। নদীর তীরে অনাবাদি ২৪ কাঠা জমি ছিল যে জমিতে বছরের একবার শুধু মাত্র বোরোধানে বীজ তলা হিসেবে ব্যবহার হতো । নদী খননের কারনে নিচু জমি এখন ভিটা জমি হিসাবে পরিবর্তন হয়েছে। এবছর আমি ৬ কাঠা জমির ভুট্টা ১২ হাজার টাকা বিক্রি করি। ভুট্টার আবাদ শেষ করে জমিতে হালচাষ দিয়ে শীতকালীন সবজির চাষ করছি।
একই গ্রামের মৃত এছাব উদ্দিন প্রধান এর ছেলে হবিবার রহমান জানান আমি গত কুড়ি বছর ধরে গরু দিয়ে অন্যের জমি হালচাষ করছি। কেনো দিন এই জমিতে গরু দিয়ে হালচাষ করতে পারেনি। নদীর তীরে মাটি ছাড়িয়ে চাষিরা উঁচু জমি তৈরি বা (ভিটা জমি বানিয়েছে)। এখন আমার হাল ঘুরছে নদীর তীরে ভিটা মাটিতে। এখন বছরে কয়েকপ্রকার কাঁচা মালের আবাদ বা (সবজির চাষাবাদ করা করেছে মানুষ)।
মেষ্টা গ্রামের রিজু মিয়া জানান, আমরা এলাকার জমিগুলোতে আবাদি ফসল না পেয়ে বড় কষ্টের মধ্যে ছিলাম। উজানের পানি বা বৃষ্টি পানি আর কোথাও আটকে না সোজা নদী দিয়ে চলে যায়। বর্তমানে জমিগুলো আমাদের কে হিসাবের চেয়েও বেশি ফসল দিয়ে যাচ্ছে, যে কারনে ফসল উৎপাদন বেড়েছে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, বহুদিন আগের নদী কতিপয় মানুষ দখল নিয়ে মাঝে মাঝে মাটি ভরাট করার জন্য নদী তার গতি হারিয়ে মরা নদী রুপ নিয়ে ছিল। শানেরহাট, পাঁচগাছি এবং মিঠিপুর ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের লোকজনের সংসারে অন্ধকারের প্রদীপ জ্বলছিল। এটি খননের পর থেকেই এলাকার কৃষক ধান, পাট,গম,কচু,আলু,মুলা, পটোল,গাজর,বেগুন, টমেটো, শিম,মরিচ, আদা,রসুন এবং পীরগঞ্জের অর্থকারী ফসল পান, সুপারি চাষে ঝুঁকছে। এখন অন্ধকার দূর করে আশায় আলো দেখছেন চাষিরা।
খোলাহাটি গ্রামের শ্রীঃ পরিমল জনান, একসময় শান নদী অনেক বড় ছিল এবং সেই নদী থেকে আমাদের বাপদাদারা মাছ ধরে সংসার চালাতেন, বহুদিন পরে আবার ফিরে পেলাম আমরা সেই নদী। বর্তমানে এই নদীতে ছোট মাছের সংখ্যা বেশি আর এই নদীর মাছ আমাদের লোকজন অনেকেই ধরে বাজার বিক্রি করে সংসার চালিয়ে নিচ্ছে।
দামোদরপুর সরকারি আশ্রয়ণ কেন্দ্রের বাসিন্দা মিনারুল ইসলাম আমাদের প্রতিদিন প্রতিবেদকে জানান, বর্ষামৌসুমে এ অঞ্চলের চারিদিকে পানি আর পানি। পানি বের হবার কোনো রাস্তা না থাকায় উঁচু নিচুতে পানি সমান হয়ে যায়। সেই পানিতে সাপ এবং জোক ঘরে ভিতর ঢুকে পরে যে কারনে অনেকেই ঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়। আমাদের আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৫৫ বছরের মুরুব্বি মানুষ পানিতে পড়ে মারা যায় এবং তার লাশের হদিস না পেয়ে ফায়ারসার্ভিসের লোকজন ১ দিন পরে লাশ উদ্ধার করে। নদী খননের পর থেকে এলাকায় পানি নেই। আমাদের আশ্রয়ন প্রকল্পের বাসিন্দারা শান্তিপ্রিয় ভাবে বসবাস করছেন এবং চাষিরা সময়মতো জমিতে হালচাষ করে ফসল ফলাচ্ছে।
জাহাঙ্গীরাবাদ এলাকার এসো গড়ি সমাজ বহুমুখী সমবায় সমির সভাপতি মেহেদুল ইসলাম জানান, আমি এলাকায় নার্সারিরির ব্যবসা করি এখানে ঔষধী, ফলজ ও বোনজসহ সকল প্রকারের চারা গাছ বিক্রি করে থাকি। বর্ষামৌসুমে বৃষ্টি বাদলের পানি এলাকায় জমিয়ে থাকে এতে করে আমার নার্সারির অনেক চারাগাছের ক্ষতি হয়। গত ২ বছর থেকে এসব এলাকায় পানি আর জমিয়ে থাকে না। এখন এ এলাকার কৃষকদের অনেক সুবিধা হয়েছে। নদীটি খননে আগে এলাকায় শুধু মাত্র কিছু কিছু জমিতে ধানের চাষ হতো। এটি খননের ফলে সবজি চাষের আগ্রহ বাড়ছে চাষিদের মাঝে। শুধু তাই নয় এ এলাকার জেলে পল্লীর লোকজন এখন নদীতে মাছ ধরে উপার্জন করছে।
পীরগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিসার সাদেকুজ্জামান সরকার এর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ৩ টি ইউনিয়নে বেশ কিছু বিল রয়েছে বর্ষামৌসুমে এগুলোতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। কৃষি কাজে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সেই জলাবদ্ধতার পানি। জলাবদ্ধতার দিন শেষ হয়েছে। চাষিরা ধান,গম,ভুট্টাসহ সকল ফসলের চাষাবাদ করছে। অই এলাকার সকল ফসলের চাষাবাদ করা হচ্ছে।
বিএমডিএ'র রংপুর সার্কেল এর প্রকল্প পরিচালক মোঃ হাবিবুর রহমান খান জানান, কৃষি খাত এগিয়ে নিতে সবসময় বিএমডিএ কৃষকদের পাশে রয়েছে। কৃষি প্রধান দেশেএ কৃষক ও জনগণের উন্নয়ন খাত এগিয়ে নিতে "ভূ-উপরিস্থ পানি সর্বোত্তম ব্যবহার ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে বৃহত্তর রংপুর জেলায় সেচ সম্প্রসারণ" প্রকল্পের মাধ্যমে নদীনালা, খাল বিল ও পুকুর খনন এবং যোগাযোগের জন্য সেতু নির্মানের কাজ করে যাচ্ছে বিএমডিএ।