উপ -উপাচার্য এবং ট্রেজারার শূন্য বেরোবি; নিয়োগ পেতে বিতর্কিতদের দৌড়ঝাপ
বেরোবি প্রতিনিধি:
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে(বেরোবি) উপ -উপাচার্য, ট্রেজারার এবং প্রক্টরসহ প্রশাসনের শীর্ষ পদে কারা নিয়োগ পেতে যাচ্ছেন তা নিয়ে নানা মহলে চলছে গুঞ্জন । আবারও কি আওয়ামীপন্থীদের দখলেই থাকবে বেরোবি প্রশাসন ? এমন প্রশ্ন উঠেছে বেরোবিতে। তবে নিরপেক্ষতার আড়ালে বিতর্কিত শিক্ষকদের নিয়োগের পায়তারা চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে। দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের পদত্যাগে বিশ্ববিদ্যালয় দায়িত্বশীলশূন্য হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় উপ -উপাচার্য, ট্রেজারার এবং এবং প্রক্টরসহ প্রশাসনের শীর্ষ পদে নিয়োগ পেতে চেষ্টায় বিতর্কিতরাও।
জানা যায়, বেরোবি ৪০ দিন অভিভাবক শূন্য থাকার পর অবশেষে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) ৬ষ্ঠ উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শওকত আলী। উপাচার্যের পদ বাদেও আরো প্রায় ৪৬টি প্রশাসনিক পদ ফাঁকা রয়েছে। ৫ আগস্ট স্বৈরাচার সরকার পতনের পরপরই এ সকল প্রশাসনিক পদ থেকে পদত্যাগ করেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা।
গতকাল ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য অধ্যাপক ড. শওকত আলী যোগদান করেন। এতে বিশ্ববিদ্যালয়টি অভিভাবক ফিরে পেলেও উপ -উপাচার্য, ট্রেজারার এবং প্রক্টরসহ প্রশাসনের শীর্ষ পদগুলো খালি রয়েই গেছে।
এমতাবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়টির বিতর্কিত সিনিয়র প্রফেসরদের অধিকাংশই এসব পদে নিয়োগ পেতে চেষ্টা করতেছে।
বিশ্বস্ত একাধিক সূত্রে জানা যায়, নতুন প্রশাসন আসলে শিক্ষকদের মধ্য থেকে যারা দায়িত্ব পাবেন, তাদের বেশিরভাগ শিক্ষকই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত রয়েছে। বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ আওয়ামী লীগের উপকমিটির সদস্য এবং নীল দলের সদস্য। সরকার পদত্যাগের আগে বেরোবির উপাচার্য হওয়ার জন্য সাবেক রাষ্ট্রপতির সাথেও সাক্ষাৎ করেন বলে জানা গেছে। প্রফেসর হওয়ার গঠিত বোর্ড নিয়েও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে । তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য পদে ছিলেন।
সাবেক উপ উপাচার্য অধ্যাপক সরিফা সালেয়া ডিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলুদ দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) কেন্দ্রীয় নেতা। অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মোরশেদ হোসেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি ,কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগের অর্থ উপ কমিটির সদস্য, পতাকা মামলার আসামি এবং ওয়ান বাংলাদেশ রংপুর জেলার সভাপতি ।
বাংলা বিভাগের প্রফেসর ড. সাইদুল হক (শিমুল মাহমুদ) বিশ্ববিদ্যালয়ের হলুদ দলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং বর্তমানে নীল দলের উপদেষ্টা। তিনি সদ্য পদত্যাগ করা উপাচার্য হাসিবুর রশিদের নিয়োগকৃত শিক্ষা গবেষণা সম্প্রসারণ দপ্তরের পরিচালক।
নীল দলের সহসভাপতি একাউন্টিং বিভাগের শিক্ষক উমর ফারুক এবং একই বিভাগের শিক্ষক ও নীল দলের যুগ্ম সম্পাদক মো. আশানুজ্জামান। পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক গাজী মাজহারুল আনোয়ার সাবেক উপাচার্য জলিলের ভাইরা ভাই এবং অনেক অবৈধ নিয়োগের সহযোগী অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে । তিনি হলুদ দলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং সদ্য সাবেক উপাচার্য হাসিবুর রশিদের আমলে বিভিন্ন পদের সুবিধাভোগী।
নীল দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ও রসায়ন বিভাগের হারুন-আল-রশিদ, বর্তমানে এ শিক্ষক অর্থ কমিটিরও সদস্য।অন্যদিকে কলা অনুষদের ডীনের দায়িত্ব পালন করছেন নীল দলের সদস্য ও বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. শফিকুর রহমান। বাংলা বিভাগের আরেক অধ্যাপক ড. সাইদুল হক ও গবেষণা ও সম্প্রসারণ দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনিও নীল দলের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য। গুরুত্বপূর্ণ পদে আসতে পারেন নীল দলের সদস্য ও বঙ্গবন্ধু ক্লাব বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ও লোকপ্রশাসন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলাম।
প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসার জন্য জোর তৎপরতা চালাচ্ছেন নীল দলের বর্তমান কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ একই বিভাগের নীল দলের কার্যকরী কমিটির সদস্য গোলাম রব্বানী। এ তালিকা রয়েছেন নীল দলের সদস্য ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. তানজিউল ইসলাম, ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের জেসমিন নাহার ঝুমুর, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের মো. সরোয়ার আহমাদ ও মো. রহমতউল্লাহ এবং পরিসংখ্যান বিভাগের ফারজানা জান্নাত তসি।
এ ছাড়াও আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের আরেকটি অংশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের বেশ কয়েকজন শিক্ষকও তৎপরতা চালাচ্ছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তাবিউর রহমান প্রধান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের আবু রেজা মোহাম্মদ তৌফিকুল ইসলাম, ফাইন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের ড. নুর আলম সিদ্দিকী, ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের মো. রফিউল আজম খান ও ড. মোহাম্মদ আজিজুর রহমান, মার্কেটিং বিভাগের সহকারি অধ্যাপক মাসুদ-উল- হাসান এবং বাংলা বিভাগের অধ্যাপক পরিমল চন্দ্র ও প্রভাষক সিরাজাম মুনিরা। এছাড়াও বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি গণিত বিভাগের অধ্যাপক কমলেশ চন্দ্র রায়ও প্রশাসনিক পদে আসার তৎপরতা চালাচ্ছেন।
গত ১৮ আগস্ট সচিবালয়ের নিজ দপ্তরে শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ জানান, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দ্রুত সম্ভব আমাদের পরিবর্তন করতে হবে। এটা একটা সুযোগও আমি মনে করব। আমরা চাইব, এতোগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে সত্যিকারের শিক্ষানুরাগী ও যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি আসুক। তাদের শিক্ষাগত ও প্রশাসনিক যোগ্যতা থাকতে হবে। এতদিন এই জায়গাটায় আমাদের অবমূল্যায়ন হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলনে যারা সমর্থন জানাননি বরং স্বৈরাচারি সরকারের পক্ষে কথা বলেছেন তাদের কোনো অধিকার নেই বিশ্ববিদ্যালযয়ের গুরুত্বপূর্ণ কোনো দায়িত্ব পালন করার। আন্দোলনে ভূমিকা ছিল এবং একাডেমিকভাবে যোগ্য এমন ব্যক্তিদের শীর্ষ পদে দেখতে চান শিক্ষার্থীরা।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী মাহমুদ কাইসার রাকা বলছেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষক শুধু তেল দিয়ে চলে ক্ষমতার লোভে, নতুন ভিসি আসলে পল্টি মেরে নতুন রূপ ধারণ করে, সেইসব শিক্ষক যাতে কোনোভাবে প্রশাসনের দায়িত্বে না আসে। চরম আওয়ামী লীগপন্থী কোনো শিক্ষককে প্রশাসনিক দায়িত্বে আমরা শিক্ষার্থীরা কোনোভাবেই চাই না।’
এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বেরোবি প্রতিনিধি আরমান বলেন, আমাদের শিক্ষা কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন
এবং বিশ্ববিদ্যালয় সেশনজট মুক্ত করবেন এমন দায়িত্বশীল দেখতে চায় । শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলনে যারা সমর্থন জানাননি বরং স্বৈরাচারি সরকারের পক্ষে কথা বলেছেন তাদের কোনো অধিকার নেই বিশ্ববিদ্যালযয়ের গুরুত্বপূর্ণ কোনো দায়িত্ব পালন করার। আমাদের নতুন উপাচার্য অধ্যাপক ড. শওকত আলী শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ও গবেষণার ক্ষেত্রে যে শূন্যতা ও ব্যঘাত ঘটেছে তা দূর করে বিশ্ববিদ্যালয়কে দ্রুতই গতিশীল করবে বলে আশা করি।
বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা কেমন হওয়া উচিত জানতে চাইলে কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসসি) বিভাগের শিক্ষক ড. ইলিয়াছ প্রামানিক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মাঝে অবশ্যই বৈষম্যবিরোধী চেতনা রক্ত মাংসে লালন করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টি হয়েছে দুটি বিষয়ের জন্য। একদিকে জ্ঞান চর্চা আরেকদিকে জ্ঞান সৃষ্টি। শিক্ষকতার কাজ এবং গবেষণার কাজ এ দুটোকে যারা এগিয়ে নিতে পারবেন একই সাথে প্রশাসনিকভাবে দক্ষ, সাহসী, উদ্যোগী, উদ্যমী এরকম মানুষকেই দায়িত্বে দেখিয়ে চাই।ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে কর্তৃপক্ষ সৎ, দক্ষ, মেধাবী এবং বাংলাদেশপ্রেমী অধ্যাপকবৃন্দকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বশীল পদসমূহে বেছে নিবেন বলে নতুন উপাচার্যের কাছে সকলেই আশাবাদী।
ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. মনিরুজ্জামান বলেন, যেহেতু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষকবৃন্দই আওয়ামী লীগের শাসনামলে নিয়োগপ্রাপ্ত সেহেতু এসব শিক্ষকবৃন্দের মধ্য থেকেই নতুন উপাচার্য যিনি আসবেন তাদেরকে নিয়েই কাজ করতে হবে। অনেকই দলনিরপেক্ষ এবং মেধাবী শিক্ষক রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ধরনের সংস্কৃতি চালু আছে তা হলো যে সরকারের আমলে যিনি নিয়োগপ্রাপ্ত হন তাকে অনেকটা বাধ্য হয়ে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনো না কোনো দলের ফরম পূরণ করতে হয়। তিনি আরো বলেন, নতুন উপাচার্য আসলে তার উচিত পূর্ববর্তী উপাচার্যদের আমলে যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন না তাদের প্রাধান্য দেওয়া, সেই সঙ্গে পূর্বে যারা দায়িত্ব পালনকালে কোনো প্রকার দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, আত্মীয়করণের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না তাদেরকে সুযোগ দেওয়া উচিত।
কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো ফেরদৌস বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারো আওয়ামীপন্থী অনেক শিক্ষক প্রশাসনে আসতে অনেক তোড়জোড় করতেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মূল কাজ নিজে গবেষণা করা এবং ছাত্র-ছাত্রীদের গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করা। যারা এগুলো করতেছে এদের বিগত কর্মকাণ্ড দেখলেই বুঝা যাবে এরা আসলে কি চাচ্ছেন। আমরা সবাই নতুন একটা বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেছি আমাদের নতুন উপাচার্য মহোদয় এসেছেন। উনি একজন ভালো মানুষ আশা করি ভালো কিছু হবে।