মানবতার সেবায় বদরগঞ্জের গ্লোরী সমাজ উন্নয়ন সংস্থা
আশরাফুজ্জামান বাবু, বদরগঞ্জ (রংপুর):
মানুষ সৃষ্টিকর্তার প্রিয় শ্রেষ্ঠ জীব। জগতে বেঁচে থাকাকালীন এই মানুষকেই- সম্পদ, জ্ঞান, শক্তি ও শিক্ষার ভিত্তিতে সুস্থ্য অবস্থায় পৃথিবীর আবর্জনার স্তুপ থেকে মঙ্গল গ্রহ পর্যন্ত বিচরণ করতে দেখা যায়। আবার এই জনগোষ্ঠির একটি অংশ সহায় সম্পদহীন হয়ে নানা প্রকার রোগ-শোকে জর্জরিত। তাদের মধ্য থেকে পথে-প্রান্তরে আহত, অচল, নবজাতক থেকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের একটি অংশকে অযত্নে অবহেলায় আবর্জনার স্তুপে নির্বাক মলিন বদনে অসুস্থ্য অবস্থায় মৃত্যুর প্রহর গুনতেও দেখা যায়। সভা সেমিনার কিম্বা বক্তব্যে অসহায় মানুষদেরকে নিয়ে কথা বলতে পারদর্শী মানুষ পাওয়া যত সহজ, ঠিক ততটাই কঠিন, অসহায়দেরকে নিয়ে সত্যিকারার্থে কাজ করার মতো মানুষ। আমাদের সমাজে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মতো লোক খুঁজে পাওয়া বড় কষ্টের বিষয়। সমাজ চলছে, দেশ চলছে, সবই চলছে তার নিজস্ব গতিতে কিন্তু সমাজের অসহায় মানুষদের দিন চলছে অনাহারে, অর্ধাহারে, না খেয়ে, রাস্তায় ময়লার স্তুপে।
এদের কেউ অসুস্থ্য হয়ে, কেউবা দারিদ্রতার যন্ত্রনা সহ্য করতে না পেরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। এরপর রাস্তা কিংবা স্টেশন হয় তাদের ঠিকানা। ফুটপাতের গলিতেই পড়ে থাকেন কেউ। অপরদিকে তাদের আশ্রয় না দিয়ে সমাজের ভালো মানুষগুলোর কেউ কেউ পাগল বলে তাড়িয়ে দেন তাদেরকে। খাদ্য, বস্ত্র ও ঠিকানাহীন এসব মানুষ দিগি¦দিক ছুঁটতে থাকেন। তাদের কেউ দেয়না খাবার, রাখেনা খোঁজ। স্বজনরাও একদিন খুঁজতে খুজতে হয়তো ক্লান্ত হয়ে নিখোঁজ ওই স্বজনকে ফিরে পাবার আশাা ছেড়ে দেন। এভাবেই তাদের ওই নিখোঁজ স্বজনের শেষ পরিনতি হয় বেওয়ারিশ লাশ, যার জন্য একফোটা অশ্রæ ফেলবার কেউ নেই।
রংপুরের বদরগঞ্জের এম এ মারুফ কেইন ওই সব নিরন্ন, গৃহহীন, অসহায় মানুষের সেবায় হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন পরম মমতায়। তিনি অসীম সাহসের সঙ্গে ভালোবাসার বন্ধনে অবদ্ধ হয়ে ওই সব নিরন্ন, গৃহহীন, অপ্রকৃতিস্থ মানবতার গহীনে প্রবেশ করে তাদের ভেতরে আশার আলো জ্বালাতে বদ্ধ পরিকর।
উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের হাসিনা নগরে এই দৃঢ় প্রত্যয়ী মারুফ গড়ে তুলেছেন ‘গেøারী সমাজ উন্নয়ন সংস্থা’ নামে মানব সেবার এক অনন্য প্রতিষ্ঠান। নাম ঠিকানা পরিচয়হীন নিরন্ন গৃহহীন অসুস্থ্য মানুষদের স্বেচ্ছায় সেবা দিয়ে যাচ্ছে এ প্রতিষ্ঠানটি। গোড়ার দিকে মানব সেবায় নিবেদিত মারুফ কেইন ব্যাক্তি উদ্যোগে ২০১২ সাল থেকে এই মহতী কাজ শুরু করলেও প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলেন ২০১৪ সালে।
জানা যায়, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে মানব সেবার লক্ষে গড়ে ওঠে এটি। ৪টি খড়ের আটি, দু’টি চটের বস্তা আর একটি কম্বল দিয়ে একটি ভাড়া করা টিনশেড ঘরে শুরু হয়েছিলো এর কার্যক্রম। পরে অনেকেই এগিয়ে দেন সাহায্যের হাত। এক মুষ্ঠি থেকে এক কেজি চাল, একটি গøাস, একটি প্লেট, একটি মশারি, কিছু পুরাতন কাপড়- এভাবেই একেক জনের ছোট ছোট সাহায্য অসহায় মানুষের সেবায় যোগ হতে থাকে প্রতিদিন। বর্তমানে সংস্থার নামে দশ শতাংশ জমির ওপর গড়ে উঠেছে সংস্থার নিজস্ব অবকাঠামো।
সংস্থাটি এতোদিন প্রতিষ্ঠানে আশ্রিতদের সৎকারের ব্যবস্থা করতো। ২০২৩ সাল থেকে বাহিরের বেওয়ারিশ লাশও দাফনের অনুমোদন পেয়েছে। শুরু থেকে সংস্থাটি ২৬ জনের দাফন সম্পন্ন করেছে। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানে আশ্রিত ২৫ এবং বাহিরের রেওয়ারিশ লাশ ছিল ১টি। এজন্য ৪ শতাংশ জমিতে রয়েছে সংস্থার নিজস্ব কবরস্থান।
সংস্থাটি এ পর্যন্ত ৮২ জন অসহায় নারী-পুরুষকে আশ্রয় দিয়েছে। তাদের মধ্যে ২৫ জন বিভিন্ন সময় সংস্থায় মারা যান। সংস্থার কবরস্থানেই তাদের দাফন সম্পন্ন হয়। তবে পরিচয় নিশ্চিত হওয়ায় ৩ জনের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তরিত হয়। শুধু তাই নয়, পরিচয় জানতে পারায় ৩৬ জনকে সুস্থ্য ও জীবিত অবস্থায় স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
আজ (০২ নভেম্বর) শনিবারে দুপুরে প্রতিষ্ঠানে গিয়ে পুরুষ ৩ জন ও নারী ১৪ জনসহ ১৭ জন অসহায় অজ্ঞাতনামা মানুষকে আশ্রিত পাওয়া যায়। জানা যায়, বর্তমানে ব্যবস্থা রয়েছে প্রায় ২৫ জনের। সরকারি কিছু অনুদান আর এলাকার সাধারন মানুষসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের নিয়মিত ও অনিয়মিত সহযোগিতায় চলছে সংস্থাটি।
গেøারী সমাজ উন্নয়ন সংস্থা’র নির্বাহী পরিচালক মারুফ কেইন বলেন, ‘দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখনও কিছু অসহায় মানুষ ফুটপাতে পড়ে থেকে মৃত্যুর প্রহর গুণছে। তাই আমি সবার সহায়তা নিয়ে তাদের সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি। সুস্থ্য হওয়ার পর যারা নাম ঠিকানা বলতে পারছেন তাদের অভিভাবকদের কাছে ফিরিয়ে দিচ্ছি। আর যারা নাম ঠিকানা বলতে পারেন না তাদের এখানেই রাখার ব্যবস্থা করছি।’