নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও পলিথিনের ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি
ইবতেশাম রহমান সায়নাভ (বেরোবি):
পলিথিন হলো একটি বহুল ব্যবহৃত কৃত্রিম পলিমার যা ইথিলিন গ্যাসের পলিমারাইজেশনের মাধ্যমে তৈরি করা হয়। পলিথিনের প্রধান সমস্যা হলো এটি অপরিবেশবান্ধব। এটি মাটিতে পচে না, ফলে মাটির উর্বরতা নষ্ট করে। এছাড়া, পলিথিন পুড়িয়ে ফেলা হলে বিষাক্ত গ্যাস উৎপন্ন হয়, যা বায়ুদূষণের কারণ।
বাংলাদেশে পলিথিনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু আইন ও বিধিমালা কার্যকর রয়েছে। পরিবেশের জন্য পলিথিনের ক্ষতিকর প্রভাব কমাতে সরকার বিভিন্ন সময়ে পদক্ষেপ নিয়েছে, যার মধ্যে আইন প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন অন্যতম।
বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে ২০০২ সালের ১ জানুয়ারি বাংলাদেশ সরকার পলিথিন ব্যাগের উৎপাদন, আমদানি, বিপণন এবং ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এটি পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫-এর সংশোধনের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ এর ধারা ৬ অনুযায়ী, কোনো ক্ষতিকর বস্তুর ব্যবহার নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের রয়েছে। এই আইন ভঙ্গ করলে ৫০,০০০ টাকা জরিমানা অথবা কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
পলিথিন ব্যবহার রোধ করতে বাংলাদেশে জুট ব্যাগ আইন, ২০১০ প্রণীত হলেও এর বাস্তবায়নে ত্রুটি দেখা দেয়। এই আইনে চাল, গম, ভুট্টা, চিনি, সার, আলু, পেঁয়াজ বাজারজাতকরণে বাধ্যতামূলকভাবে পাটের ব্যাগে প্যাকেজিং করতে হবে বলা হয়। এরপর ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে দুই দফায় আদেশ দিয়ে আরও ১১টিসহ মোট ১৭টি পণ্যের মোড়ক হিসেবে পাটের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ১ নভেম্বর থেকে কাচাবাজারে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
প্লাস্টিক পলিথিনের অপ্রতিরোধ্য ব্যবহার পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি মাটির উর্বরতা কমিয়ে দিচ্ছে, নদী-নালা ও জলাশয় দূষিত করছে এবং জীববৈচির্ত্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এসব কারণে প্লাস্টিক পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার বন্ধে সব পর্যায়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। তবে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পলিথিন ব্যবহার না করার ক্ষেত্রে উদাসীনতা রয়েছে।
পলিথিন ব্যবহার রোধে কার্যকর পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমন :
• পলিথিনের ক্ষতিকর দিক এবং এর বিকল্প সম্পর্কে জনগণের মধ্যে প্রচারণা চালাতে হবে।
• স্কুল-কলেজে পরিবেশ শিক্ষার প্রচলন:
ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে
• অবৈধ পলিথিন উৎপাদন, আমদানি এবং ব্যবহারের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করতে হবে।
• পলিথিন আইন লঙ্ঘনকারীদের জন্য জরিমানা এবং কারাদণ্ড কার্যকর কররতে হবে।
•পাট, কাগজ, এবং কাপড়ের ব্যাগ সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী করতে উদ্যোগ নিতে হবে।
•পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক এবং বায়োডিগ্রেডেবল পলিথিনের প্রচলন করতে হবে।
•পাটের ব্যাগ বা কাগজের ব্যাগ উৎপাদনে সরকারি প্রণোদনা দিতে হবে।
•ভোক্তাদের মধ্যে পুনঃব্যবহারযোগ্য ব্যাগ ব্যবহারের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
•পলিথিনের বিকল্প পণ্যে বিনিয়োগে ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করতে হবে।
•সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, টেলিভিশন, এবং রেডিওর মাধ্যমে পলিথিন বর্জনের জন্য প্রচারণা চালাতে হবে।
•বাজার বা দোকানে পাট বা কাগজের ব্যাগ সরবরাহ নিশ্চিত করা করতে হবে।
•পরিবেশ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার এবং বেসরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে
•পরিবেশবান্ধব পলিথিনের বিকল্প পণ্য উদ্ভাবনে গবেষণায় বিনিয়োগ করতে হবে।
•পলিথিন নিষিদ্ধে সফল দেশগুলোর (যেমন রুয়ান্ডা, কেনিয়া) অভিজ্ঞতা গ্রহণ করতে হবে।
পলিথিন ব্যবহার রোধে সরকার, জনগণ এবং ব্যবসায়ীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আইন প্রয়োগ, সচেতনতা বৃদ্ধি, এবং পরিবেশবান্ধব পণ্য ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশে পলিথিন দূষণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব।