১৩ বৈশাখ, ১৪৩১ - ২৭ এপ্রিল, ২০২৪ - 27 April, 2024
amader protidin

গ্যাসের দাম বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতি উসকে দেবে, বিষিয়ে উঠবে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের জীবন

আমাদের প্রতিদিন
1 year ago
205


ঢাকা অফিস:

বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ছয় দিনের মাথায় গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে সরকার। আবাসিক ভবনের রান্নার চুলা, যানবাহন ও সার কারখানা ছাড়া বৃহৎ শিল্প উৎপাদন, হোটেল-রেস্তোরাঁসহ সব ধরনের গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে, যা ফেব্রæয়ারি মাস থেকে কার্যকর হবে। নির্বাহী আদেশে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি করা হয় বলে বুধবার এক প্রজ্ঞাপনে জানিয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়।

গ্যাসের এই বৃদ্ধির ফলে মূল্যস্ফীতি আরও উসকে উঠতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এর ফলে দ্রব্যমূল্য আরেক দফা ঊর্ধ্বমুখী হয়ে স্বল্প আয়ের মানুষসহ নিম্ন ও মধ্যবিত্তের জীবন বিষিয়ে উঠবে। আর্থিক টানাটানিতে সংকটাপন্ন হয়ে কোনো মতে খুঁড়িয়ে চলা জীবনযাত্রাকে ঠেলে দেবে চরম অনিশ্চয়তার ভেতর। বৃহৎ শিল্পে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ১১ টাকা ৯৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছে। শিল্পে উৎপাদিত নিজস্ব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের (ক্যাপটিভ) জন্য ইউনিট প্রতি গ্যাসের দাম ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছে।

হোটেল ও রেস্তোরাঁখাতে ব্যবহৃত বাণিজ্যিক শ্রেণির গ্রাহকের ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ২৬ টাকা ৬৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা ৫০ পয়সা করা হয়েছে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ১০ টাকা ৭৮ পয়সা থেকে ৩০ টাকা করা হয়েছে। মাঝারি শিল্পে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ১১ টাকা ৭৮ পয়সা ৩০ টাকা করা হয়েছে।

এছাড়া সিএনজি প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৪৩ টাকা, বাসাবাড়িতে দুই চুলায় ১০৮০ টাকা, সার কারখানায় ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ১৬ টাকা ও চা বাগানের গ্যাসের প্রতি ইউনিট ১১ টাকা ৯৩ পয়সা অপরিবর্তিত থাকছে। এসব গ্রাহকের গ্যাসের দাম বাড়েনি।

তবে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির অস্বস্তির ভেতরেই গ্যাসের দাম বৃদ্ধি অস্বস্বি বাড়িয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ফেব্রæয়ারি মাসে কার্যকর হওয়া গ্যাসের নতুন মূল্য সমন্বিত বিল গ্রাহকরা মার্চ মাসে পরিশোধ করবেন। আর তখনই উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির বিষয়টি সামনে এনে আরেক দফা বৃদ্ধি করা হতে পারে পণ্য-দ্রব্যের মূল্য। একই সঙ্গে এ মূল্যবৃদ্ধি এক মাস বা তারও বেশি সময়ের মধ্যে প্রভাব ফেলবে নিত্যপণ্যের বাজারে। অন্য জিনিসপত্রের দামও বাড়তে পারে। আর এতে মূল্যস্ফীতি আরও উসকে উঠতে পারে। দ্রব্যমূল্যের আরও ঊর্ধ্বমুখী অবস্থা সৃষ্টি হলে স্বল্প আয়ের মানুষসহ নিম্ন ও মধ্যবিত্তের জীবন বিষিয়ে উঠবে। আর্থিক টানাটানিতে সংকটাপন্ন হয়ে কোনো মতে খুঁড়িয়ে চলা জীবনযাত্রাকে ঠেলে দেবে চরম অনিশ্চয়তার ভেতর।

অর্থাৎ ফেব্রæয়ারি মাসের বিল মার্চ মাসে দিতে হবে। গ্যাসের দাম বাড়ায় পণ্য ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয় বাড়বে, তা গিয়ে ঠেকবে ক্রেতার কাঁধে। সব মিলিয়ে গ্যাসের দাম বাড়ায় সাধারণ মানুষের ওপর বড় ধরনের অর্থনৈতিক বোঝা চেপে বসবে।

বুধবার গ্যাসের দাম বাড়নোর সরকারি ঘোষণার পর জ্বালানি বিশেষজ্ঞ, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ- ক্যাবের সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ড. শামসুল আলম তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ভোক্তার আতঙ্কের মাত্রা বহুগুণে বেড়ে গেল এই গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করায়। মাত্র ক’দিন আগে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সরকার। যার নেতিবাচক প্রভাব একমাসের বেশি সময় বা নির্দিষ্ট একটি ট্রানজেকশন পিরিয়ড শেষে বাজারে পড়বে। এর ওপর গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির বিরূপ প্রভাবও পড়বে কাছাকাছি সময়েই। এই দুটি খাতই পণ্য-দ্রব্যসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র উৎপাদনে জড়িত। একই সময় দুই খাতের মূল্যবৃদ্ধির চাপ একসঙ্গে ভোক্তার ওপর পড়লে তারা আরও অর্থ সংকট ও অনিশ্চতার মুখে পড়বেন। আর সরকার যদি মূল্যস্ফীতি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও বাজার ব্যবস্থার আরেক ধাপ ঊর্ধ্বমুখিতা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়, তাহলে ভোক্তা বর্তমানে যে টানাটানির ভেতর দিয়ে জীবন চালাচ্ছেন- ততটুকু চাপেই থাকবেন। অন্যথায় কষ্টের সীমা থাকবে না।’

এর আগে গত ১২ জানুয়ারি সরকারের নির্বাহী আদেশে গড়ে ৫ শতাংশ বাড়ানোর হয় গ্রাহক পর্যায়ে খুচরা বিদ্যুতের দাম। গত বছরের ৫ আগস্ট নির্বাহী আদেশে বাড়ানো হয় জ্বালানি তেলের দাম। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে কাজ করে থাকে। বিইআরসির কাছে দাম বাড়ানোর আবেদন করতে হয়, তারপর সেই আবেদনের ওপর গণশুনানি করা হয়। গণশুনানি শেষে বিইআরসি মূল্যবৃদ্ধির আদেশ দেয়।

গত বছরের ডিসেম্বরে রাষ্ট্রপতির আদেশে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন, ২০০৩ এর কিছু পরিবর্তন আনা হয়। সেই পরিবর্তনে বিইআরসির পাশাপাশি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় নির্বাহী আদেশে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির ক্ষমতা হাতে নেয়। সেই ক্ষমতাবলেই সরকার বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করল।

সরকারি ও বেসরকারি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম এতদিন কম ছিল। সরকারি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের গড় উৎপাদন ব্যয় ছিল ১ টাকা ২০ পয়সার মতো। আর বেসরকারিতে এই ব্যয় ৩ টাকা ৫০ পয়সার মতো ছিল। তখন গ্যাসের দাম বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে ছিল ৫ টাকা ২০ পয়সা।

সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ৫ টাকা ২০ থেকে নতুন দাম ১৪ টাকা প্রতি ইউনিট গ্যাস কিনতে হবে। এতে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ব্যয় আরও অনেক বেড়ে যাবে। অন্যদিকে কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ব্যয় ১২ টাকা থেকে ২৪ টাকা পর্যন্ত। ফলে বিদ্যুতের দাম খুচরা পর্যায়ে ফের বাড়াবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিদ্যুতের একক পাইকারি প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) এবার লোকসানে থাকবে ৪০ হাজার কোটি টাকা। সরকার এর মধ্যে ১৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে। এর বাইরেও ঘাটতি থাকবে ২৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে গ্যাসের দাম বাড়ায় এই ঘাটতি আরও বাড়বে। ঘাটতি কমাতে পিডিবি পাইকারি বিদ্যুতের দাম বাড়াবে।

এ ছাড়া গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় শিল্প উৎপাদনের খরচও বেড়ে যাবে। শিল্পে ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাধ্যমে নিজেরা বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। সেই ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ১৬ টাকা থেকে ৩০ টাকা করা হয়েছে। আবার বৃহৎ শিল্পে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ছিল ১১ টাকা ৯৬ পয়সা। সেই দামও বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছে।

শুধু বৃহৎ শিল্পেই বাড়ানো হয়নি, মাঝারি ও কুটির শিল্পেও ৩০ টাকা করা হয়েছে। ফলে শিল্প উৎপাদনের খরচ বেড়ে যাবে। এতে দেশে পণ্যের দাম বাড়বে। পাশাপাশি উৎপাদন ব্যয় বাড়ার কারণে রপ্তানিমুখী শিল্পে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে দেশীয় উদ্যোক্তাদের। এতে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে রপ্তানি আয়ে।

গ্যাস সংকট নিয়ে দেশের ব্যবসায়ীরা সরকারের নীতি নির্ধারকদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছিল। তখন তারা বলেছিল, গ্যাস যদি নিরবচ্ছিন্নভাবে শিল্পে সরবরাহ করা হয়, তাহলে দাম বাড়লেও তারা মেনে নেবে। তাদের পক্ষ থেকে শিল্পে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম প্রতি ইউনিট ২২ টাকা রাখার প্রস্তাব করা হয়েছিল। তবে ব্যবসায়ীদের সেই দাবি থেকেও ইউনিট প্রতি ৮ টাকা বেড়েছে গ্যাসের দাম।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়