১৪ বৈশাখ, ১৪৩১ - ২৮ এপ্রিল, ২০২৪ - 28 April, 2024
amader protidin

বাজার নিয়ন্ত্রণে আমদানিই কি একমাত্র সমাধান?

আমাদের প্রতিদিন
1 month ago
59


আমাদের ডেস্ক:

দেশে নিত্যপণ্যের বাজার লাগামহীন। নাভিশ্বাস ওঠার অবস্থা ভোক্তাদের। লাগাম টানতে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা অভিযান চালালেও মিলছে না কাক্সিক্ষত সুফল। ফলে বাধ্য হয়ে অনেক পণ্যই আমদানি করে বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় এবার বেসরকারিভাবে চাল আমদানির অনুমতিও দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। তবে তাতে কতটা সফলতা পাবে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে রয়েছে সংশয়।

চলতি বছরের শুরু থেকেই ঊর্ধ্বমুখী নিত্যপণ্যের দাম। রজমান মাসে এসে আরও চড়া হয়েছে বাজার। বেগুন, লেবু, পেঁয়াজ, খেজুর, চাল ও চিনি ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের ফলের দাম এখন আকাশছেঁয়া। এতে সংসার চালাতে হিমশিম অবস্থা সাধারণ ক্রেতাদের।

তবে লাগামহীন এসব পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে বাজারে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা। পাশাপাশি বাংলাদেশ ট্রেডিং করপোরেশনের (টিসিবি) মাধ্যমে স্বল্প দামে তেল, চিনি ও চালের মতো পণ্য বিক্রি করে বাজার নিয়ন্ত্রণ ও ভোক্তার কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করা হচ্ছে। পাশাপাশি রমজানে এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন শিল্প গ্রুপও। সাশ্রয়ীমূল্যে তারা বিক্রি করছে বিভিন্ন পণ্য।

তবু নাগালে আসছে না পণ্যের দাম। এর আগে গত বছর নিত্যপণ্যের বাজারে স্বস্তি ফেরাতে ভারতসহ অন্যান্য দেশ থেকে পেঁয়াজ, আলু, ডিম, লবণ, কাঁচা মরিচ ও টমেটোর মতো পণ্য আমদানিরও সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। এবার সে পথে হেঁটেই চাল আমদানির ঘোষণা দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।

এক বিজ্ঞপ্তিতে খাদ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বেসরকারিভাবে ৪৯ হাজার মেট্রিক টন সিদ্ধ চাল এবং ৩৪ হাজার মেট্রিক টন আতপ চালের আমদানির অনুমতি দিয়েছে সরকার। সেই সঙ্গে দ্রুত চালের বাজারের সংকট কাটিয়ে উঠতে আমদানি করা চাল ২৫ এপ্রিলের মধ্যে বাজারজাত করতে হবে।

বরাদ্দের অতিরিক্ত আইপি (ইমপোর্ট পারমিট) জারি করতে পারবে প্রতিষ্ঠানগুলো। আমদানি করা চাল স্বত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠানের নামে পুনঃপ্যাকেটজাত করতেও নিষেধ করেছে মন্ত্রণালয়। এ চাল বস্তায় বিক্রি করতে হবে। তাছাড়া আমদানি করা চালের পরিমাণ, গুদামজাত ও বাজারজাতকরণের তথ্য জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কাছে দিতেও বলা হয়েছে।

তবে ভোক্তারা বলছেন, পণ্য আমদানির খবরে বাজারে কিছুটা স্বস্তি মিললেও, কিছুদিন বাদেই আবার ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠে আমদানির অনুমতি দেয়া পণ্যের দাম। এ অবস্থায় বাজার নিয়ন্ত্রণে শুধু অভিযান, জরিমানা ও পণ্য আমদানিতে সীমাবদ্ধ না থেকে বাজার সিন্ডিকেট ভাঙার দাবি ভোক্তাদের। তারা বলেন, সরকার নিয়মিত বাজারে অভিযান পরিচালনা করে। এতে কিছুদিন হয়তো বাজার নিয়ন্ত্রণে থাকে। কিন্তু এরপর আবার বাড়ে নিত্যপণ্যের দাম। তাই বাজার নিয়ন্ত্রণে সিন্ডিকেট ভেঙে স্থায়ী সমাধানে আসতে হবে।

আরেক দিকে ব্যবসায়ীরা জানান, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অধিক মুনাফার লোভে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করে থাকে। তবে এদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে জরিমানা করছে ভোক্তা অধিকার।

আর দাম নিয়ন্ত্রণে পণ্য আমদানির বিষয়ে ব্যবসায়ীরা বলেন, শুধু আমদানির অনুমতি দিলেই হবে না। আমদানি কার্যক্রম নির্বিঘ্ন করতেও ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমদানি শুল্কের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে।

কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন,বাজার নিয়ন্ত্রণে পণ্য আমদানি একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ মাত্র। এটা স্থায়ী পদক্ষেপ নয়। তবে বাজার নিয়ন্ত্রণে পণ্য আমদানি সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত। না হলে কোনো পণ্যের ঘাটতি দেখা দিলে বা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা বাজার লাগামহীন করে ফেলতে পারে।

নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে সিন্ডিকেটকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কোনো বিকল্প নেই বলে জানান ক্যাব সভাপতি। তিনি বলেন, কোনো ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর স্বার্থ সরকারকে দেখলে চলবে না; দেখা উচিতও নয়। সরকার দেখবে দেশের মানুষের স্বার্থ।

অর্থনীতিবিদ মাহফুজ কবির বলেন, রমজানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা সত্ত্বেও নিত্যপণ্যের দাম কমায়নি ব্যবসায়ীরা; উল্টো বাড়িয়েছে। গত ৭—৮ মাস ধরেই তারা পণ্যের দামে কারসাজি করছে। রমজানে চালের দাম আগে কখনও তেমন একটা না বাড়লেও এবার হাতেগোনা কিছু মিল মালিকের কারসাজিতে ঊর্ধ্বমুখী চালের বাজারও। তাই বাজার নিয়ন্ত্রণের সাময়িক পদক্ষেপ হিসেবে সরকার চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

তবে দাম নিয়ন্ত্রণে পণ্য আমদানি একটি সাময়িক সমাধান মাত্র উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটি একমাত্র ও সবচেয়ে ভালো সমাধান নয়। বাজার নিয়ন্ত্রণে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর ও বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থাকে তদারকি আরও বাড়াতে হবে।

পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে চাহিদা ও যোগানের বিষয়টি বিবেচনায় নেয়ার কথা জানিয়ে মাহফুজ কবির বলেন, অবশ্যই চাহিদা অনুযায়ী পণ্য আমদানি করতে হবে। কারণ চাহিদার তুলনায় বেশি আমদানি হলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কৃষকের ওপর। সেই দিকটিও সরকারকে নজরে রাখতে হবে।

আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক সংস্থা এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কেন্দ্রের (সিরডাপ) পরিচালক (গবেষণা) ড. মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন বলেন, বাজারে সরবরাহ কমে গেলে দাম বাড়বে। এ দাম নিয়ন্ত্রণে সরবরাহ বাড়াতে কখনো কখনো আমদানির প্রয়োজন হতে পারে। সেই কাজটিই সরকার করেছে। যেটি যুক্তিসঙ্গত।

এছাড়া চাহিদার তুলনায় সরবরাহ আনুপাতিক হারে না বাড়াতে পারলে কখনোই ভোক্তা অধিকার ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না বলেও মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ।

তিনি বলেন, শুধু আমদানি করলেই চলবে না। দেশের উৎপাদক ও কৃষকদের কথাও ভাবতে হবে। কারণ অধিক পরিমাণে আমদানি করলে দেশের চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে সৃষ্টি হবে ভিন্ন সমস্যা। তাছাড়া ডলারের বিষয়তো রয়েছেই।

নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শাস্তি, জরিমানা বা দাম বেঁধে দিলে ব্যবসায়ীরা সবসময় সেটি মানবে না। কিন্তু বিদেশ থেকে আমদানি বাড়ালে দাম কমতে বাধ্য। কারণ আমদানি হলে চাহিদার তুলনায় যে ঘাটতি সৃষ্টি হয়, সেটি পূরণ হবে। ফলে দাম নেমে আসবে।

তবে অস্থায়ী পলিসিগুলো বাজারকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে যেতে পারে বলেও সতর্ক করেন অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন। তিনি বলেন, সবসময় অস্থায়ী পলিসি দিয়ে দীর্ঘমেয়াদে ভালো ফল হয় না। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, বিদেশ থেকে পণ্য এলে দাম কমে যাবে; তবে পরে বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এটিও অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়