পরিবেশ সংরক্ষণ ও দুষণ নিয়ন্ত্রণে অবদানে তেঁতুলিয়ার মাহমুদুল ইসলাম পেলেন জাতীয় পরিবেশ পদক

পঞ্চগড় প্রতিবেদক:
পরিবেশ সংরক্ষণ ও দুষণ নিয়ন্ত্রণে অবদানের জন্য ব্যক্তি পর্যায়ে “জাতীয় পরিবেশ পদক-২০২৪” অর্জন করেছে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার পরিবেশকর্মী মাহমুদুল ইসলাম মামুন। বুধবার সকাল ১০টায় শেরে বাংলা নগরের বাংলাদেশ চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে বিশ্ব পরিবেশ দিবস ও জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান এবং পরিবেশ মেলা ও বৃক্ষমেলা ২০২৫ এর উদ্বোধনী পর্বে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের হাত থেকে এ জাতীয় পরিবেশ পদক ২০২৪ ও সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। এ পুরস্কারের পাওয়ায় ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যম মামুনকে নিয়ে প্রশংসা করছেন উত্তরাঞ্চলের মানুষ।
মাহমুদুল ইসলাম মামুন পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার আজিজনগর গ্রামের আজহারুল ইসলাম ও মাহমুদা বেগমের দ্বিতীয় পুত্র। রংপুর কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর পাস করেও চাকরি পিছনে না ছুটে গত এক যুগের বেশি সময় ধরে পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যাচ্ছেন। দুষণমুক্ত পরিবেশ ও গাছের চারা বিলিয়ে সবুজ পৃথিবী গড়ার স্বপ্নে এক যুগের বেশি সময় ধরে বিনে পয়সায় গাছ বিলিয়ে হয়ে উঠেছেন পরিবেশ ও শিক্ষাকর্মী।
প্রতিদিন ভোরের আলো ফুটতেই সাইকেলে গাছের চারা, বই ও পরিবেশ সচেতনতায় প্ল্যাকার্ড বেড়িয়ে ঘুড়ে বেড়ান গ্রাম থেকে গ্রামে। সবুজ প্রকৃতির গড়ার লক্ষে শহর ও গ্রামে নানান বয়সী মানুষের কাছে উপহার হিসেবে তুলে দেন গাছ। কাউকে পাঠ্যাবাসে মনোযোগী করতে ভ্রাম্যমান পাঠাগার হিসেবে দেন বই। কখন পথে খানাখন্দ দেখলে সড়ক দূর্ঘটনা রোধে সড়কের সেই গর্ত ভরাত ও ঝুপঝাড় পরিস্কার করে।
পরিবেশ দূষিত হয় এরকম পলিথিন কুড়িয়ে এক জায়গায় করেন, বাজারের মাছ-মাংসের উচ্ছিস্ত, প্লাস্টিকের ব্যাগ সংগ্রহ করে এক জায়গায় রেখে এভাবে এক যুগের বেশি সময় ধরে পরিবেশের বন্ধু হয়ে উঠেছেন উত্তরের তেঁতুলিয়ার সীমান্তঘেষা গ্রাম আজিজনগরের মাহমুদুল ইসলাম মামুন। প্রকৃতি ও সমাজের কাছে মামুন শিশুদের কাছে হয়ে উঠেছেন যেন হ্যামিলিয়নের বাঁশিওয়ালা। প্রকৃতির নিবির পরিবেশর বন্ধু। ভ্রাম্যমান পাঠাগারের আরেক পলান সরকার।
২০১৩ সাল থেকে শুরু করা থেকে এখন পর্যন্ত বিনে পয়সায় লক্ষাধিকেরও বেশি গাছ বিলি করেছেন এ তরুণ। ২০-২৫টি গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে তার গাছ। এসব গাছ রোপন করে সচ্ছলতা মিলেছে অনেক পরিবারের। মহামারি করোনাকালেও বাড়িতে বাড়িতে ঔষুধি গাছ ও ফল উপহার দিয়ে স্বাস্থ্য সচেতনতা বার্তা দিয়েছিলেন এ তরুণ। এসব করতে কারও কাছ থেকে নেননি কোন আর্থিক সহযোগিতা। বাড়িতে হাঁস-মুরগী পালন ও সবজি চাষ করে যা আয় হয় সেটা দিয়েই কিনে বই, গাছ, সবজির বীজ।
জ্ঞানের আলো ছড়াতে নিজেই হয়ে উঠেছেন ভ্রাম্যমান পাঠাগার। পাঠকদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে বই বদলে দেন বই। বই পাঠ শেষ হলে দিচ্ছেন গাছের চারা উপহার। শিশু-কিশোরদের নিয়ে পাড়া মহল্লায় খোলাকাশের নিচে বসান পাঠের আসর। এ পাঠের আসরের নাম দিয়েছেন আকাশতলা পাঠশালা। এ পাঠশালায় শিশুরাসহ থাকেন বয়োজ্যৈষ্ঠ ব্যক্তিরাও। তারা শুনেন মামুনের বই পড়ার গল্প। পাঠের আসরেও দেন গাছ উপহার। বিনে পয়সায় পড়ান দরিদ্র শিক্ষার্থীদের। এখন এলাকার পাঠকদের উদ্বুদ্ধ করে বাড়ির পাশে গোল ছাউনি ঘর করে মাটির তাক তৈরি গড়ে তুলেছেন প্রকৃতি পাঠাগার। সে পাঠাগারের বই পড়তে ছুটে আসছে বিভিন্ন গ্রামের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন বয়সী পাঠকরা।
মাহমুদুল ইসলাম মামুন জানান, আমি পরিবেশ নিয়েই কাজ করে যেতে চাই। এ কাজ করতে গিয়ে আমি ভুলে গেছি সরকারি চাকরিতে আবেদনের কথা। প্রকৃতি বাঁচলে আমরা বাঁচবো সবাই। কারণ প্রকৃতিতে বেঁচে থাকার প্রধান উপকরণ হচ্ছে অক্সিজেন। সে অক্সিজেনই তো বৃক্ষ থেকে উৎপন্ন ও নির্গত হয়। এ থেকেই আমরা বেঁচে আছি। যদি প্রকৃতিতে গাছ না থাকে, তাহলে আমাদের অক্সিজেন সরবরাহ কমে গিয়ে বড় সমস্যায় পড়ে যাব। বর্তমানে কয়েক বছর ধরে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটায় পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়ে তাপপ্রবাহ বয়ে চলেছে। এসব চিন্তা করেই মানুষের মাঝে বৃক্ষরোপনের প্রয়োজনীয়তা জানাতে বিনে পয়সায় গাছ বিলিয়ে আসছি। আমাকে আমার মা, ভাই ও অনেকে উৎসাহিত করে। আমি যে মানুষের জন্য, পরিবেশের জন্য কিছু করতে পারছি, এটাও একটা ইবাদত।
মামুন বলেন, সরকার আমাকে পরিবেশ পদক প্রদানের জন্য মনোনীত করেছেন। আমি খুবই কৃতজ্ঞ ও ধন্য যে আমার কাজকে মূল্যায়ন করায় সরকারকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। একই সাথে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সকল শুভাকাংখিদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি তারা আমাকে পরিবেশের কাজে উৎসাহিত করেছেন। আমার এ পরিবেশ পদক আমার মাকে উৎসর্গ করছি। কারণ আমার মা-ই আমার পরিবেশের জন্য কাজ করতে মানুষের কল্যাণে উৎসর্গ করেছেন।
মামুনের মা মাহমুদা বেগম বলেন, আমার ছেলেটা ছোট থেকেই থেকেই প্রকৃতি পাগল। শিশু বয়স থেকেই গাছ নিয়ে ভাবতো। ছেলেটা অনার্স-মাস্টার্স করেও চাকরির কথা চিন্তা না করে কাজ করে যাচ্ছে পরিবেশ নিয়ে। পিতৃহারা ছেলেটা শৈশব থেকেই মানুষকে বিনে পয়সায় গাছ ও বিভিন্ন সবজির বীজ বিতরণ করে যাচ্ছে। ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারও চালাচ্ছে। সরকার আজ তাকে স্বীকৃতি দিতে পরিবেশ পদক প্রদানে মনোনীত করায় সরকারের প্রতি খুবই কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। মা হিসেবে আমার খুবই গর্ব হচ্ছে। সবাই মামুনের জন্য দোয়া করবেন সে যেন মানুষের জন্য এভাবেই পরিবেশ সুরক্ষার কাজ করে যেতে পারে।
পঞ্চগড় পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মোঃ ইউসুফ আলী বলেন, মাহমুদুল ইসলাম মামুন একজন পরিবেশবন্ধু। নিভৃতভাবে পরিবেশ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। আমরা পরিবেশ অধিদপ্তর, পঞ্চগড় থেকে পরিবেশ পদকের জন্য এর আগেও প্রস্তাব করেছিলাম। এবার তিনি পরিবেশ পদকে মনোনীত হয়েছেন। আমরা তাকে জেলা কার্যালয়ের পক্ষ হতে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।