১২ শ্রাবণ, ১৪৩১ - ২৭ জুলাই, ২০২৪ - 27 July, 2024
amader protidin

ঘোড়াঘাটে ঠিকাদারের দখলে খেলার মাঠ ও মাদ্রাসা

আমাদের প্রতিদিন
5 months ago
176


মোহাম্মদ সুলতান কবির, ঘোড়াঘাট (দিনাজপুর):

দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার একটি মাদ্রাসা ও খেলার মাঠ গত প্রায় এক বছর ধরে দখল নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে মেসার্স জামিল ইকবাল নামে এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। এতে এলাকাবাসী ওই এলাকার তরুণ প্রজন্ম খেলাধুলা সহ সুস্থ বিনোদন ধারা থেকে বঞ্চিত হয়ে মাদক সেবন সহ সামাজিক অবক্ষয়ের দিকে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন। অপরদিকে একটি হাফেজিয়া ও কওমী মাদ্রাসাটি কৌশলে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, উপজেলার ঐতিহ্যবাহী ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সুরা মসজিদ এলাকায় খেলার আর কোনো মাঠ না থাকায় সুরা মসজিদ ও কুন্দারামপুর সহ আশেপাশের কয়েক গ্রামের তরুণ প্রজন্ম খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করতো ওই মাঠে। কিন্তু গত এক বছর থেকে তা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে বন্ধ হয়ে গেছে খেলাধুলার অনুশীলনও। নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে ২ বছরের চুক্তিতে মের্সাস জামিল ইকবাল নামের এক ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কাছে চুক্তি করেন ওই জায়গার ওয়াক্ফ স্টেটের মোতাওয়াল্লি সেকেন্দারের আলী ফকির। চুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের প্রজেক্ট ম্যানেজার হাফিজ উদ্দিন। অপরদিকে টাকার লোভে মাঠ দখলের পূর্বেই কৌশলে মাদ্রাসাটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে করে ওই মাদ্রাসার ছাত্রদের পড়াশুনা বন্ধ সহ অনেকে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ঘোড়াঘাট-হাকিমপুর (হিলি) সড়কটির নির্মাণ সামগ্রী রাখার জন্য পুরো মাঠ জুড়ে ইট, পাথর, বালির বড় বড় স্তুপ ও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন নির্মাণ সামগ্রী। অথচ আগে এখানে ফুটবল খেলার জন্য দুটি গোলবার ছিল। সেখানে রাখা হয়েছে সড়ক নির্মাণের সব ধরনের কাঁচামাল। পূর্ব পাশে স্থাপন করা হয়েছে রেডি মিক্সড কংক্রিটের প্লান্ট। মাঠের উত্তর পাশে সারিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে মালবাহী ট্রাক ও ইস্কেভেটর। মাদ্রাসার ঘরটিতে রাখা হয়েছে সিমেন্টের সারি সারি বস্তা ও ব্যবস্থা করা হয়েছে শ্রমিকদের জন্য থাকার ঘর।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সুরা মসজিদ হাফিজিয়া কওমি মাদ্রাসা ও মাঠের ৮০ শতাংশ জমি ওয়াক্ফ স্টেট বাংলাদেশের সম্পত্তি। এটি দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার চোরগাছা মৌজার অন্তর্ভুক্ত। যার জেএল নং ৯১, আরএস খতিয়ান নং- ৪৬২, সাবেক দাগ নং- ১০২২ এবং বর্তমান আরএস দাগ নং- ৬৭৬। মাদ্রাসাটি মৌজার ঐতিহাসিক সুরা মসজিদের পাশে রাস্তার দক্ষিণ পাশে কুন্দারামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘেঁষে পূর্ব পাশে অবস্থিত। মোতাওয়াল্লির ভয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি বলেন, মাদ্রাসাটি শুধু দেখানোর জন্য মাত্র আসলে এটিকে ঘিরে চলছে লুটপাট। মাদ্রাসার নামে বহু জায়গা থেকে এরা লাখ লাখ টাকা তুলে আত্মসাৎ করেছে। কেউ তাদের বিরুদ্ধে কথা বললে মামলা হামলার হুমকি দিয়ে দমিয়ে রাখে। এদের গোষ্ঠীর লোকেরা লুটপাট করে খাচ্ছে সুরা মসজিদের দান বাক্সের টাকা ও স্টেটের বিশাল সম্পত্তির লভাংশ। যেটি প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের সম্পত্তি। উপর থেকে লোকজন আসলে তাদেরকে নয়-ছয় হিসেব দেখিয়ে কিছু টাকা পয়সা দিয়ে বিদায় করে দেয়। এর আগের ইউএনও’রা বহু চেষ্টা করেও তাদের সাথে পারেননি, আমরা তো সাধারণ মানুষ। এদিকে ওয়াক্ফ স্টেটের মোতাওয়াল্লির সাথে ঠিকাদারের হওয়া চুক্তি নামাতেও পাওয়া যায় গরমিল। জায়গাটি ওয়াক্ফ স্টেটের হওয়ার পরও মোতাওয়াল্লির চুক্তিনামায় নিজেদের দখলীয় সম্পত্তি বলে উল্লেখ করেছেন। আবার ২৩/২৪ সালের কথা বলে দুই মৌসুমে ৫০ হাজার টাকা নেওয়ার কথা বললেও চুক্তিনামায় দেখা যায় মেয়াদ ২৬/০৭/২০২৩ইং হইতে ২৫/০৭/২০২৫ইং পর্যন্ত উল্লেখ রয়েছে। অপর দিকে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের প্রজেক্ট ইনচার্জ এনামুল হক বলছেন চুক্তি নামাটি হয়েছে ১ লাখ টাকার মতো যা মোতাওয়াল্লি প্রথম বছরেই ৫০ হাজার টাকা নিয়েছেন। হয়তো এ বছরের শেষের দিকে বাকি টাকা আমাদের দিতে হবে। আমরা এখনও রাস্তার ৫০ ভাগ কাজও করতে পারিনি।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, শিক্ষক ছাত্রদের ভালোর কথা চিন্তা করে মাদ্রাসাটি বন্ধ করার কথা বলা হলেও রাস্তা নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার ৫ মাস পূর্বেই কৌশলে মাদ্রাসা ও মাঠটি পুরোপুরি ফাঁকা দেখিয়ে একক ক্ষমতাবলে মাদ্রাসাসহ খেলার মাঠের ৮০ শতক জমি ওই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কাছে ভাড়া দেন ওয়াক্ফ স্টেটের মোতাওয়াল্লি সেকেন্দারের আলী ফকির। আর একটি অবাক করা বিষয় মাদ্রাসাটির নাম, যা খোদ মোতাওয়াল্লিও বলতে পারলেন না যে, আসলে মাদ্রাসাটির নাম কি? পরে লোক মুখে শুনে জানা যায় মাদ্রাসাটির নাম সুরা মসজিদ হাফিজিয়া ও কওমি মাদ্রাসা।

এ বিষয়ে কথা হলে মেসার্স জামিল ইকবালের প্রজেক্ট ম্যানেজার হাফিজ উদ্দিন বলেন, এ স্টেটের মোতাওয়াল্লির সাথে আমাদের প্রতিষ্ঠানের চুক্তিনামাটি আমার আগের প্রজেক্ট ম্যানেজার আব্দুল মালেক এর সাথে হয়েছিল। আমি চুক্তিনামার ব্যাপারে এর চেয়ে বেশি কিছু জানি না। চুক্তিনামা অনুযায়ী ২ বছর পর আমরা মালামাল অন্যত্র স্থানান্তর করবো। অপরদিকে রাস্তা নির্মাণ কাজের ব্যাপারে তিনি বলেন, ঘোড়াঘাটের ওসমানপুর হিলি মোড় থেকে হাকিমপুর হিলির ২৬ কিলোমিটার রাস্তার কাজের ৩টি প্যাকেজে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৩৪ কোটি টাকা।

অপর দিকে ওয়াক্ফ স্টেটের মোতাওয়াল্লি সেকেন্দারের আলী ফকিরের কাছে জানতে চাইলে তিনি টাকার বিনিময়ে চুক্তির কথা স্বীকার করে বলেন, বর্তমান ইউএনও’র পূর্বে যে ইউএনও ছিলেন (রাফিউল আলম) তার কাছে বসে ঠিকাদারের সাথে চুক্তিনামা করেছি। মাদ্রাসার কার্যক্রম আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে যাতে করে ছাত্র শিক্ষকদের কোন ক্ষতি না হয়। আমি ব্যক্তিগত ভাবে মাঠটি ভাড়া দেইনি। ওয়াক্ফ স্টেট বাংলাদেশের চিঠিপত্র আমার কাছে আছে বিধায় ভাড়া দিয়েছি। এর আগের ইউএনও মমিনুল ইসলাম প্রতিষ্ঠানে তালা লাগিয়েছিল। আমরা হাইকোর্টে তার বিরুদ্ধে রিট করেছিলাম। তিনি ভালো অপমানিত হয়েছিলেন।

এ ব্যাপারে ঘোড়াঘাট সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাহমুদুল হাসান বলেন, যেহেতু ওই জায়গা ওয়াক্ফ স্টেটের, সেকারণে আমি বা ইউএনও মহোদয় এ ব্যাপারে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারিনা। আমরা বিষয়টি দিনাজপুর জেলা ওয়াক্ফ পরিদর্শককে জানিয়েছি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দিনাজপুর জেলা ওয়াক্ফ পরিদর্শক নুরম্নজ্জামান প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, বিষয়টি অপনাদের মাধ্যমেই জানতে পারলাম। ওয়াক্ফ তৈরী হয়েছে বিভিন্ন সেবামূলক কাজ করার জন্য। মোতাওয়াল্লি কোনো ভাবেই মাদ্রাসা বন্ধ করে দেয়ার ক্ষমতা রাখেন না। উনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার কে? আমি মোতাওয়াল্লির সাথে কথা বলে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়