১৪ চৈত্র, ১৪৩০ - ২৮ মার্চ, ২০২৪ - 28 March, 2024
amader protidin

রংপুর আ.লীগের কমিটি বিলুপ্তের  নেপথ্যে স্বেচ্ছাচারিতা ও অভ্যন্তরীণ বিরোধ

আমাদের প্রতিদিন
1 year ago
406


নিজস্ব প্রতিবেদক:

রংপুর জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটি ভেঙে দেওয়ার ঘটনায় সর্বত্র চলছে আলোচনা-সমালোচনা। দীর্ঘদিন ধরে একই নেতৃত্ব বহাল থাকায় দলের মধ্যে স্বেচ্ছাচারিতা ও অভ্যন্তরীণ কোন্দল চলমান ছিল। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও জেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে দলটির প্রার্থীর ভরাডুবি’র পর তা সামনে আসে।

এরই জেরে কেন্দ্রীয় কমিটি গত রোববার রাতে রংপুর জেলা ও মহানগর কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে চার সদস্যের নতুন আহবায়ক কমিটি দেয়। এতে মহানগরের আহবায়ক করা হয়েছে চিকিৎসক নেতা ডা. দেলোয়ার হোসেন ও যুগ্ম আহবায়ক করা হয়েছে বিলুপ্ত কমিটির সহ-সভপতি আবুল কাশেমকে। জেলার আহবায়ক করা হয়েছে বিলুপ্ত কমিটির সহ-সভাপতি ও ড. ওয়াজেদ মিয়ার ভাতিজা একেএম শায়াদত হোসেন বকুল ও যুগ্ম আহবায়ক করা হয়েছে বিলুপ্ত কমিটির সহ-সভাপতি অধ্যাপক মাজেদ আলী বাবুলকে। এর পর থেকে উজ্জীবিত হয়ে উঠে রংপুর আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের পরিক্ষত ত্যাগীরা। যারা এতদিন মূল্যায়ন হয়নি তারাও দলে দলে দলীয় কার্যালয়ে আসছেন। সাবেক ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতৃবৃন্দও আসছেন। অনেকেই মিস্টি বিতরণ ও শুভেচ্ছা মিছিলও করেছেন। গত দুইদিন ধরে নব গঠিত জেলা ও মহানগর নেতৃবৃন্দ নগরীতে ব্যাপক শোডাউন করে জাতির পিতার ম্যূরালে পুস্পমাল্য দেন। তবে সবচেয়ে উচ্ছাস দেখা গেছে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মাঝে। তারা দ্রুত পূর্নাঙ্গ কমিটি গঠন, ইউনিয়ন- থানা-উপেজলা ও মহানগরীর থানা-ওয়ার্ড কমিটিও বিলুপ্ত করে নতুন করে কমিটি গঠনের দাবি জানান।

               ত্যাগী ও মাঠ পর্যায়ে যোগ্যদের মূল্যায়ন

গত ২৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী অ্যাডভোকেট হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া মাত্র মাত্র ২২ হাজার ২৩৯  ভোট পেয়ে চুতর্থ অবস্থানে রয়েছেন। সেই সঙ্গে তার জামানতও বাজেয়াপ্ত হয়েছে। এখানে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বিপুল ভোটে জয়ী হন। এর পর থেকে দলীয় অভ্যন্তরণী কোন্দলের বিষয়টি প্রকাশে আসে। অথচ মহানগর আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠন এবং থানা ও ৩৩টি ওয়ার্ডের সক্রিয় কমিটি থাকার পরও সিটি নির্বাচনে জামানত হারিয়েছেন দলীয় প্রার্থী ডালিয়া। যা দলের জন্য খুবই লজ্জাজনক।

নামপ্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা বলেছেন, রংপুর ‘জেলা ও মহানগরে পরপর দুইবার একই নেতৃত্ব আসায় দলে স্বেচ্ছাচারিতা, কোন্দল, গ্রুপিং বেড়ে গেছে।

         দ্রুত পুর্নাঙ্গ কমিটি গঠনসহ থানা-ওয়ার্ড কমিটি বিলুপ্তের দাবি

এতে করে কমিটি থাকলেও সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে আওয়ামী লীগ। রংপুর নগরীতে ওয়ার্ড ও থানা পর্যায়ে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের প্রায় ৪০ হাজার পদধারী রয়েছে। প্রত্যেক নেতা যদি নৌকায় ভোট দিত তবুও দলীয় প্রার্থী নির্বাচনে কমপক্ষে ৪০ হাজার ভোট পেত। দলের এমন শোচনীয় অবস্থার বহিঃপ্রকাশ হয়েছে রংপুর সিটি নির্বাচনে। আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’

জানা গেছে, মহানগর কমিটিতে পরপর দুইবার সভাপতি পদে সাফিউর রহমান সফি ও সাধারণ সম্পাদক পদে তুষার কান্তি মণ্ডলকে নির্বাচিত করা হয়। তারা সিটি কর্পোরেশন গঠনের পর থেকে একই পদে বহাল থাকায় দলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ গ্রুপিং ছিল। দুই নেতার অনুসারীরা পদ পদবী পেয়েছেন। যোগ্যতা থাকা সত্বেও অনেক ত্যাগী, পরিক্ষিত ও মাঠ পর্যায়ে জনপ্রিয় নেতা পদ বঞ্চিত হয়েছেন। তারাদের আর্শিবাদে অনেকেই বিভিন্ন পদে অসীন হয়েছেন। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মহানগর সভাপতি সাফিউর রহমান, সাধারণ সম্পাদক তুষার কান্তি মণ্ডল, শ্রমবিষয়ক সম্পাদক এমএ মজিদ, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আতাউর জামান বাবু, মেট্রোপলিটন কোতয়ালী থানার সহ-সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার লতিফুর রহমান মিলন প্রচারণায় থাকলেও দলীয় মনোনয়ন পান জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া। এতে দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নিলেও নেতাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করে। পদ বাঁচাতে দলীয় প্রার্থীর সঙ্গে লোক দেখানো গণসংযোগে নামলেও চিত্র ছিল ভিন্ন। যা ভোটের ফলাফল প্রকাশের পর দেখা গেছে।

তবে দলের অনেকেই মনে করছেন, রংপুর জেলা ও মহানগর কমিটিতে দীর্ঘদিন একই নেতৃত্ব বহাল থাকায় দলের মধ্যে স্বেচ্ছাচারিতা ও অভ্যান্তরীণ কোন্দলের কারণে সাংগঠনিক দুর্বলতা তৈরি হয়েছিল। কেউ বঞ্চিত হয়েছেন। আবার কাউকে বঞ্চিত করা হয়েছে। যোগ্যতা থাকা সত্বেও শীর্ষ নেতাদের অনুসারী না হওয়ার কারণে অনেকেই কাঙ্খিত পদও পাননি। বিভিন্ন ওয়ার্ড-ইউনিয়ন ও থানা কমিটির গঠনের ক্ষেত্রে এমনটাই দেখা গেছে। শুধু আওয়ামী লীগই নয় অঙ্গ সংগঠনের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। শীর্ষ নেতার অনুসারী না হলে যোগ্যতা থাকলেও পদ বঞ্চিত হয়েছেন অনেকেই। কেউ কেউ পদ না পেয়ে অভিমানে রাজনীতি থেকে সরে গেছেন।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ২০২২ সালের ১৭ অক্টোবর রংপুর জেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মনোনয়ন পান সদ্য বিলুপ্ত জেলা কমিটির সহ-সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট ইলিয়াস আহমেদ। দলীয় প্রার্থীর সঙ্গে  প্রতিদ্বদ্বিতা করেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক উপদেষ্টা ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ জেলার সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোছাদ্দেক হোসেন বাবলু। ওই নির্বাচনে অসহযোগিতাসহ দলীয় প্রার্থীকে হারাতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার অভিযোগ ওঠে কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে। যদিও পরবর্তীতে সিটি নির্বাচনী উত্তাপের কারণে বিষয়টি চাপা পড়ে গেছে।

জেলার ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশনের সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান থাকলেও ওই নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর পরাজয় হয়। এ নির্বাচনে ১ হাজার ৮৫টি ভোটের মধ্যে মোছাদ্দেক হোসেন বাবলু পান ৬০১ ভোট এবং আওয়ামী লীগের প্রার্থী ইলিয়াস আহমেদ পান ৪৮৪ ভোট। দলের ‘বর্ণচোরা’ নেতাকর্মীদের কারণে হেরেছেন বলে অভিযোগ করেন ওই নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী ইলিয়াস আহমেদ।

এদিকে জেলা আওয়ামী লীগের সদ্য বিলুপ্ত কমিটির সভাপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রেজাউল করিম রাজুর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছে। এতে করে জেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এরই জের ধরে দলের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম রাজু দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ সভা আহ্বান না করার অভিযোগ তোলেন জেলা সভাপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে।  জেলা সভাপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদও সাধারণ সভার নামে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে চক্রান্ত করার অভিযোগ তোলেন দলের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম রাজুর বিরুদ্ধে। চলমান উত্তাপের মধ্যে গত ১৯ নভেম্বর দলীয় কার্যালয়ে সহ-সভাপতি ইলিয়াস আহমেদের সভাপতিত্বে জেলা আওয়ামী লীগের বিশেষ সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে দলের সভাপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদকে দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকার অভিযোগে  সাময়িক অব্যহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। জেলা কমিটির ৭৫ সদস্যের মধ্যে ৫৩ জন এই সিদ্ধান্তে সম্মতি প্রকাশ করেন।

মহানগর আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত আহ্বায়ক ডা. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের যে ভরাডুবি হয়েছে, তা আমাদের জন্য চরম লজ্জার। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ফিরিয়ে এনে আওয়ামী লীগের আগের সুনাম ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করবো। এটাই এখন আমাদের একমাত্র কাজ।’  তিনি আরও বলেন, ‘কোনও হাইব্রিড বা ভাইয়ের লোক নয়, দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের স্থান দিয়ে দলকে আরও শক্তিশালী করা হবে।’

জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক একেএম শায়াদত হোসেন বকুল বলেন, ‘মহানগর আওয়ামী লীগকে কেন্দ্রের নির্দেশনা অনুযায়ী পুনর্গঠন করে আওয়ামী লীগের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যকে আবারও ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করবো। দলে নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করে তাদের যথাযথ সম্মান দিয়ে দলকে গতিশীল করার জন্য কাজ করা হবে।

 

 

সর্বশেষ

জনপ্রিয়