৩ বৈশাখ, ১৪৩১ - ১৬ এপ্রিল, ২০২৪ - 16 April, 2024
amader protidin

পাটের সুতায় সাথীর মাসে আয় লাখ টাকা

আমাদের প্রতিদিন
1 year ago
121


দিনাজপুর প্রতিনিধি:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ব্যাচে পড়ার সুবাদে সিরাজুম মুনিরা সাথীর সঙ্গে পরিচয় হয় ফেরদৌস আহমেদের। পরিচয় থেকে গল্প, আড্ডা, ভালোলাগা। এক সময় প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে দুজনের মধ্যে। একপর্যায়ে সেই সম্পর্ক রূপ নেয় পরিণয়ে।

ছাত্রজীবনে বাম ঘরানার রাজনীতিতে এক সময়ের মাঠ কাঁপানো ছাত্রনেতা ফেরদৌস ছাত্রজীবনেই শপথ নেন দেশ গড়ার। পড়াশোনা শেষে চাকরি নয়, বরং ভিন্ন কিছু করে দেশ গড়ার কাজে মনোনিবেশ করার ইচ্ছা ছিল তার। তবে জীবনের প্রয়োজনে চাকরিতে ঢুকতে বাধ্য হন। কিন্তু মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে সৃষ্টির উন্মাদনা। কর্মজীবনের এক পর্যায়ে উভয়ে এসে থিতু হন উত্তরের জেলা দিনাজপুরে।

স্বামী ফেরদৌসের বাড়ি যশোর জেলায় আর স্ত্রী সাথীর বাড়ি ঠাকুরগাঁও। তারা দুজনে এখন দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার রাজাবাসর গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তাদের পরিচয় হয় ২০০০ সালে। দীর্ঘ আট বছর প্রেমের সম্পর্কের পর ২০০৮ সালে তারা বিয়ে করেন। তাদের দুই মেয়ে। দুজনেই স্কুলে পড়ে।

সিরাজুম মুনিরার সাথীর কর্মস্থল জেলা শহর থেকে ২৮ কিলোমিটার দূরে রেল জংশন খ্যাত গ্রামীণ শহর পার্বতীপুরে। তিনি বেসরকারি একটি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে গবেষণা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। আর ফেরদৌস জেলা সদরে একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত রয়েছেন।

পেশাগত ও পারিবারিক দায়িত্ব পালনের পরও ফেরদৌস-সাথী দম্পতি নতুন কিছু করার ভাবনা থেকে সরে আসেননি। একপর্যায়ে তারা প্রক্রিয়াজাত পাটজাত দ্রব্য নিয়ে কাজ শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়ে পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতে খোঁজ নিতে শুরু করেন। ব্যক্তিগতভাবে নিজেরা ধারণা নেওয়ার পাশাপাশি পার্বতীপুরের রাজাবাসর ও তার পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে নারীদের সংগঠিত করতে থাকেন। বৃটিশ আমল থেকেই এই এলাকাগুলোতে তাঁতের কাজ চালু থাকলেও নব্বইয়ের দশকে ভারতীয় শাড়ি ও অন্যান্য সুলভ কাপড়ের দাপটে তাঁতশিল্প বিলীন হয়ে যায়। বর্তমানে এখানে এ ধরনের সৌখিন কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কোনো কারিগর খুঁজে পাওয়া যায় না।

নিজেদের প্রয়োজনে ফেরদৌস-সাথী দম্পতি এই কাজে আগ্রহী নারীদের সংগঠিত করতে থাকেন। কিন্তু কাজটি তারা যতটা সহজ মনে করেছিলেন বাস্তবে সেটি তত সহজ ছিল না। সংসারের কাজ ফেলে বাড়ির বাইরে গিয়ে নারীদের কাজ করার ব্যাপারে নারীদের পাশাপাশি পুরুষদেরও বোঝাতে হয়েছে। তাদের নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টায় অবশেষে তৈরি হয় কাজের উপযোগী পরিবেশ। রংপুর থেকে প্রশিক্ষক এনে প্রথমে শ্রমিকদের হাতে-কলমে শিক্ষা দেওয়া হয়। একটু একটু করে এগোতে থাকে কাজ।

মাত্র ২০ জন নারী শ্রমিককে সঙ্গে নিয়ে ২০১৭ সালে শুরু হয় ফেরদৌস-সাথী দম্পতির ‘সুতার কাব্য’। সেখানে তৈরি হতে থাকে পুতুল, ফ্লোর ম্যাট, প্লেস ম্যাট, ফ্লোর র্যাগ, টেবিল রানার, ব্যাগ, শতরঞ্জি, ওয়াল হ্যাঙ্গিং, প্ল্যান্ট হ্যাঙ্গিং, প্ল্যান্ট বাস্কেট, লন্ড্রি বাস্কেট, টুল/মোড়া, টয়েজ, মিরর, উডেন শো পিস, গøাস কোস্টার, কুশন কভার, এপ্লিক বেড কভার, পেন হোল্ডার, বুকমার্ক, গ্রেটিংস কার্ড, কি হোল্ডার, কিডস রাগ, টাফটিং রাগ ইত্যাদি।

ছোট্ট পরিসরে কাজ শুরু হওয়ায় নেই কোনো শোরুম। গ্রামীণ পরিবেশে এসব সৌখিন পণ্যের ক্রেতাও অপ্রতুল। তাই অনলাইনে পণ্যের কেনাবেচা শুরু করেন। সময়ের ব্যবধানে বাড়তে থাকে চাহিদা। বাড়ে ব্যবসার পরিধিও। দৃষ্টিনন্দন ডিজাইন আর চমৎকার নির্মাণশৈলীর কারণে গত বছর এসএমই মেলায় তারা জিতেছেন শ্রেষ্ঠ পাটজাত পণ্যের স্টলের পুরস্কার। পাটের পাশাপাশি বাঁশপণ্য ও মাটির কারুশিল্প নিয়েও কাজ করার পরিকল্পনাও রয়েছে তাদের। সময়ের ধারাবাহিকতায় সুতার কাব্য আগামী ফেব্রুয়ারিতে আমেরিকায় অনুষ্ঠিতব্য নিউইয়র্ক নাউ মেলায় অংশ নিতে যাচ্ছে। 

বর্তমানে পার্বতীপুর-দিনাজপুর সড়কের কোলঘেঁষে ১০ কাঠা জমির ওপর কারখানা গড়ে তুলেছেন ফেরদৌস-সাথী দম্পতি। সেখানে ৭০ জন শ্রমিক দিন-রাত বুনে চলেছেন স্বপ্নের পসরা। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে তাঁতের খট খট শব্দে বুনে চলেছেন সুতার কাব্য।

সুতার কাব্যে কর্মরত ঠাকুরগাঁওয়ের সুখন চন্দ্র আমাদের প্রতিদিনকে জানান, তিনি ভারতের পানিপথে ৪ বছর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। দেশে ফিরে নিজ এলাকাতেই কাজ করছিলেন। পরে এখান থেকে যোগাযোগ করা হলে গত ৭ মাস ধরে তারা কয়েকজন মিলে এখানে কাজ করছেন। প্রতি মাসে তিনি ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা আয় করেন।

ভারতের পানিপথে প্রশিক্ষণ নিয়ে কর্মরত আরেক শ্রমিক প্রদীপ রায় আমাদের প্রতিদিনকে জানান, তিনি ৮ মাস ধরে এখানে কাজ করছেন। কাজের পরিবেশ ভালো। বর্তমানে তিনি মাসে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা আয় করেন।

এখানে কর্মরত নারী শ্রমিক মনি বেগম আমাদের প্রতিদিনকে জানান, তিনি এখানে ২ বছর ধরে কাজ করছেন। আগে বাড়িতে সাংসারিক কাজের বাইরে আর কোনো কাজ করা হতো না। ফলে সাংসারিক সকল খরচের জন্য স্বামীর রোজগারের ওপর নির্ভর করতে হতো। তবে বর্তমানে স্বামীর পাশাপাশি নিজেও মাসে ৭-৮ হাজার টাকায় আয় করেন। আয়ের টাকায় তিনি সন্তানের পড়াশোনার খরচ যোগানোর পাশাপাশি প্রতি মাসে কিছু সঞ্চয়ও করেন।

আরেক নারী শ্রমিক রওশন আরা খাতুন আমাদের প্রতিদিনকে জানান, তিনি এখানে সাড়ে তিন বছর যাবত কাজ করছেন। শুরুতে মালিকপক্ষের সহায়তায় প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। বর্তমানে তিনি নতুনদের প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন। নিজে অর্থ উপার্জন করতে পারায় বেশ খুশি।

সুতার কাব্যের স্বত্বাধিকারী সিরাজুম মুনিরা সাথী আমাদের প্রতিদিনকে বলেন, ছাত্রজীবনেই পরিকল্পনার শুরু হলেও শুরুটা খুব সহজ ছিল না। ২০১৭ সালে ২০ জন শ্রমিককে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করি। বিশেষ করে নারীদের বাড়ির বাইরে নিয়ে আসা, কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ, নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ নানাবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে। বর্তমানে নিজস্ব জায়গায় কারখানাটি চালু করেছি। শুধুমাত্র বিদেশে সুতার কাব্য রপ্তানি নয়, সৃজনশীল কাজগুলোর দেশে একটি মার্কেট তৈরি করার পরিকল্পনা চলছে। আজকের অবস্থানের জন্য আমার স্বামী ফেরদৌসের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। এখন সব খরচ বাদ দিয়েও মাসে লাখ টাকার ওপর আয় হয়।

সাথীর স্বামী ফেরদৌস আহমেদ আমাদের প্রতিদিনকে বলেন, সাথীর ইচ্ছাশক্তি আর নিষ্ঠার কারণে সুতার কাব্য এগিয়ে চলছে। চাকরি করে সংসার সামলে বিকল্পধারার একটি প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিতে অসম্ভব ইচ্ছাশক্তি প্রয়োজন। আমি ছুটির দিনগুলোতে তাকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করি। তবে মূল কাজগুলো শক্তহাতে সাথীকেই সামাল দিতে হয়।

মনমথপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ওয়াদুদ আলী শাহ বলেন, সুতার কাব্য প্রতিষ্ঠানটি আমি ব্যক্তিগতভাবে ভিজিট করে আসছি। সেখানে আমার ইউনিয়নের প্রায় ৫০ জন নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। তাদের হাতের পাটের সুতা দিয়ে তৈরিকৃত পণ্য দেশ ও দেশের বাহিরে যাচ্ছে। তাতে ফেরদৌস ও সাথী দেশে বসে বেকারদের কর্মসংস্থান ও পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছেন।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়