দিনাজপুরের বিরলে পুলিশের গুলিতে নিহতের বাড়ীতে শোকের মাতম এলাকায় বিরাজ করছে চরম আতঙ্ক
বাজারে ওষুধ আনতে গিয়েই পুলিশের গুলিতে নিহত হন বৃদ্ধ মোহাম্মদ আলী
দিনাজপুর ও বিরল প্রতিনিধি :
দিনাজপুরের বিরল উপজেলার ১নং আজিমপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষনাকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় পুলিশের গুলিতে একজন নিহতের ঘটনায় ওই এলাকায় বিরাজ করছে চরম আতঙ্ক। ওষুধ আনতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত মোহাম্মদ আলীর বাড়ীতে সোমবার দিনভর চলে শোকের মাতম। এদিকে এই ঘটনায় সোমবার বিকেল পর্যন্ত থানায় কোন মামলা দায়ের হয়নি, জেলা প্রশাসকের গঠিত তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করবে মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) থেকে।
দিনাজপুরের বিরল উপজেলার ১নং আজিমপুর ইউনিয়নের সিঙ্গুল হামিদ—হামিদা উচ্চ বিদ্যালয়। ১নং আজিমপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ৯টি কেন্দ্রের মধ্যে এটি ছিলো একটি কেন্দ্র। এই কেন্দ্রে রোববার রাতে ফলাফল ঘোষনাকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে বিক্ষুব্ধরা ভোটকেন্দ্রে ইঁপাটকেল ও হামলা চালালে পুলিশ ৬০ থেকে ৭০ রাউন্ড গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে নিহত হন মোহাম্মদ আলী (৬৫) নামে এক কৃষক। আহত হন পুলিশ সদস্যসহ বেশ কয়েকজন। নিহত মোহাম্মদ আলী বিরল উপজেলার সিঙ্গুল ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের মৃত মাহমুদ বক্স—এর ছেলে।
সোমবার দুপুর ১২টায় ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায় থমথমে অবস্থা। সিঙ্গুল হামিদ—হামিদা উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশেই চৌরঙ্গী বাজার। প্রতিদিন এই বাজারটি জমজমাট থাকলেও সোমবার গিয়ে দেখা যায়, অধিকাংশ দোকান বন্ধ, বাজার ফাঁকা। সবার মধ্যেই বিরাজ করছে পুলিশ আতঙ্ক। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দোকানদার জানান, সাধারনত এসব ঘটনার পর অজ্ঞাতনামা মামলায় পুলিশ যাকে ইচ্ছা, তাকে ধরে নিয়ে যায়। এ জন্যই আজ (সোমবার) বাজারে অনেকেই আসছে না। সবার মাঝে বিরাজ করছে পুলিশ আতঙ্ক। ভয়ে দোকান খুলতে চাচ্ছে না কেউ।
শুন্য চৌরঙ্গী বাজারে দেখা হয় রাজকুমার রায় নামে এক ব্যাক্তির। ভোটকেন্দ্রে পোলিং এজেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ঘটনার বিষয়ে তিনি বলেন, ভোট গ্রহন ও গণনা কোন জায়গায় কোন সমস্যা হয়নি। পুরো সময় সাথে ছিলাম। তিনি জানান, সদস্য পদে মোরগ মার্কার প্রার্থীর এজেন্ট পুনরায় গণনা চাইলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গণনা করেছেন। ফল মেনেও নিয়েছেন সকলে। কিন্তু বাইরে মানুষ এত উত্তেজনা করেছে যেটা বলে শেষ করা যাবেনা। মাইকে ফলাফল ঘোষনা করা হয়েছে কিন্তু তারপরও সবাই কাগজ চায়(ফলাফল শীট)। চেয়ারম্যান প্রার্থীর ফলাফলের কাগজ চায়। পুলিশ দুইবার ধাওয়া দিয়ে লোকজনকে সরিয়ে দিয়েছে। পরে গাড়ি নিয়ে বের হবার সময় ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করলে পুলিশ ও অন্যান্য কর্মকর্তারা বৈঠকও করেছেন। এর কিছু সময় মানুষ বেশ উত্তেজিত হয়ে ইঁপাটকেল ও ভোটকেন্দ্রে হামলার চেষ্টা করলে গুলি ছুঁড়তে শুরু করেন পুলিশ।
সিঙ্গুল হামিদ—হামিদা উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যালয় প্রাঙ্গন জুড়ে পড়ে আছে ইট—পাটকেল। বিদ্যালয় খোলা থাকলেও নেই কোন ছাত্রছাত্রী। আগের দিন পুলিশের গুলিতে একজন নিহত হওয়ায় আতঙ্কে বিদ্যালয়ে আসেনি ছাত্রছাত্রীরা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মিজানুর রহমান জানান, এই বিদ্যালয়ের মোট ছাত্র—ছাত্রী ৬৩৫ জন। কিন্তু সোমবার সকালে উপস্থিত হয় মাত্র ২৫/৩০ জন। পরে তাদেরকেও ছুটি দিয়ে দেয়া হয়।
সোমবার মোহাম্মদ আলীর বাসা ঘুরে দেখা যায়, বাড়ির বারান্দায় বসে বিলাপ করছেন নিহতের স্ত্রী মরিয়ম বেগম(৫৮)। তাঁর কান্না থামানোর চেষ্টা করছেন স্বজনরা। বিলাপ করে মরিয়ম বেগম বলছেন, ‘ওয় চোর—ডাকাত নাহায় বা, ওয় সাদাসিদা মানুষ। ওয় হজ্ব করি আইছে বা। পাড়ার মানুষেরঠে শুনো ওয় ভালো না খারাপ। মানুষটা এমন করি চলি গেইল বা।’
মোহাম্মদ আলীর বাড়ি থেকে ভোটকেন্দ্রের দূরত্ব প্রায় আধা কিলোমিটার। মরিয়ম বেগম জানান, ‘রোববার সন্ধ্যায় বাড়িতে মাগরিবের নামাজ পড়েছেন মোহাম্মদ আলী। পরে বাজারের ব্যাগ হাতে স্ত্রীর ওষুধসহ কিছু বাজার করার জন্য বের হন। অন্যান্যরা যখন বাসায় ফিরেছেন তখন স্বামীর কথা জিজ্ঞেস করছিলেন মরিয়ম। কিন্তু কেউ বলতে পারছিলেন না। হঠাৎ কেউ একজন ফোনে জানান ভোট কেন্দ্রে গন্ডগোল লাগছে মোহাম্মদ আলীর গায়ে গুলি লাগছে। পরে নিহতের নাতি সাব্বির হোসেন বাজারে এসে দাদাকে হাসপাতালে নিয়ে যান।
নিহত মোহাম্মদ আলী পেশায় একজন কৃষক। তার তিন মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন একমাত্র ছেলে মানসিক প্রতিবন্ধী। নিহতের বড় ভাই মজিবর রহমান বলেন (৮৮) বলেন, আমরা পাঁচ ভাই। মোহাম্মদ আলী চতুর্থ। ২০১৬ সালে দুই ভাই একসাথে হজ্জ্ব করেছি। ও ভীষন সাধাসিধা প্রকৃতির। বাড়ি আর বাজার ছাড়া কোথাও যেতনা। সকালে ভোটকেন্দ্রে ভোটও দিয়ে আসছি দুই ভাই।
রোববার সন্ধ্যার কিছু আগে স্ত্রী মরিয়মের জন্য চৌরঙ্গী বাজারে ওষুধ কিনতে গিয়েছিলেন মোহাম্মদ আলী(৬৫)। বাজারে গ্রাম্য চিকিৎসক ইলিয়াস আলীর দোকানে বসে ছিলেন। ওষুধের দোকান থেকে দুইশ মিটার দূরে সিঙ্গুল হামিদ—হামিদা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান ফটক। সন্ধ্যায় বিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে তখন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষনা নিয়ে বিভিন্ন প্রার্থীর সমর্থক ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে তুমুল উত্তেজনা চলছিলো। হঠাৎ পুলিশের ধাওয়া ও গুলি ছোঁড়ার শব্দ। যে যার মত ছুঁটছে। বয়সের ভারে দৌঁড় দেওয়া হয়নি মোহাম্মদ আলীর। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে রাতে দিনাজপুর এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষনা করেন।
এদিকে দিনাজপুর এম. আব্দুর রহিম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে সোমবার বেলা ২ টায় মোহাম্মদ আলীর লাশ বাড়ীতে গিয়ে পৌছলে পরিবার ও স্বজনদের কান্না আর আহাজারীতে ভারী হয়ে উঠে পরিবেশ। এসময় দিনাজপুর জেলা প্রশাসক শাকিল আহমেদ ও পুলিশ সুপার শাহ ইফতেখার আহমেদসহ প্রশাসন ও পুলিশের অন্যান্য কর্মকর্তারা নিহতের পরিবারের পাশে গিয়ে তাদের সান্তনা দেন এবং নিহতের দাফনের জন্য আর্থিক অনুদানও দেন।
অন্যদিকে ঘটনার পরের দিন সোমবার বিকেল পর্যন্ত এই ঘটনায় কোন মামলা দায়ের হয়নি, তদন্তকাজ শুরু করেনি দিনাজপুর জেলা প্রশাসকের গঠিত তদন্ত কমিটি।
সোমবার বিকেলে বিরল থানার ওসি গোলাম মওলা জানান, ঘটনার আনুসঙ্গিক কাজ করা হচ্ছে। মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে।
দিনাজপুরের পুলিশ সুপার শাহ ইফতেখার আহমেদ নিহতের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে জানান, বিষয়টি গুরুত্বের সাথে তদন্ত করা হচ্ছে। প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন করা হবে। এলাকায় পুলিশী আতঙ্কের বিষয়ে তিনি বলেন, নিরপরাধ কাউকে গ্রেফতার বা আটক করা হবে না। তাই যারা নিরপরাধ তাদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছুই নেই। এর আগের দিন রাতে পুলিশ সুপার ইফতেখার আহমেদ জানান, শান্তিপুর্ণভাবে ভোটগ্রহন শেষে ফলাফল ঘোষনার পরে বিক্ষুব্ধ লোকজন ভোটগ্রহন কর্মকর্তা ও পুলিশ সদস্যদের উপর হামলা চালায়। এসময় পুলিশ আত্মরক্ষার্থে ৬০ থেকে ৭০ রাউন্ড গুলিবর্ষন করে। পরে জানাযায় গুলিতে মোহাম্মদ আলী নামে একজন মারা গেছে। নিহত মোহাম্মদ আলী ওই ওয়ার্ডেও বিজয়ী ইউপি সদস্য জোবায়দুর রহমানের চাচা।
দিনাজপুর জেলা প্রশাসক শাকিল আহমেদ বলেন, এই ঘটনায় দিনাজপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মোঃ জানে আলমকে প্রধান করে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। আগামীকাল (মঙ্গলবার) থেকে তদন্তকাজ শুরু করবে কমিটি। ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বলেণ, প্রশাসন বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বসহ দেখছে। এ জন্য আমি গতকাল রাতেও হাসপাতালে গিয়েছি, আজকেই নিহতের বাড়ীতে এসেছি।
সোমবার বিকেলে সিঙ্গুল মাদ্রাসায় জানাযা শেষে সিঙ্গুল ডাঙ্গাপাড়া গোরস্থানে মোহাম্মদ আলীর দাফনকাজ সম্পন্ন হয়।
উল্লেখ্য, গত রোববার দিনাজপুরের বিরল উপজেলার তিনটি ইউনিয়ন পরিষদের ভোটগ্রহন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এরমধ্যে একটি হচ্ছে আজিমপুর ইউনিয়ন পরিষদ। সারাদিন সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণ শেষ হলেও গন্ডগোল বাঁধে ফলাফল ঘোষনার মূহুর্তে। বিভিন্ন প্রার্থীর সমর্থক ও উৎসুক জনতা ভোটের ফলাফল নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে নানা গুজব ছড়াতে থাকেন। একটা সময় পুলিশের উপরে চড়াও হন উৎসুক জনতা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রন ও আত্মরক্ষার্থে গুলি ছোঁড়ে পুলিশ। পুলিশের গুলিতে নিহত হন মোহাম্মদ আলী। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত অর্ধশতাধিক(পুলিশ সদস্যসহ)।
ওই ভোট কেন্দ্রে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন বিরল উপজেলা রিসোর্স সেন্টারের ইনস্ট্রাক্টর মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ৬টায় ভোট গণনা শেষ হয়েছে। ৬টা ২০ মিনিটে ফলাফল ঘোষনা করা হয়েছে। ফলাফলের এক কপি বাইরেও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরও আমাদেরকে গেট বন্ধ করে দিয়ে আটকে রাখা হয়েছিল। ইটপাটকেল ছোঁড়া হয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে গুলি চালিয়েছে পুলিশ।