মজুরী বৈষম্যের শিকার কৃষি নির্ভর দিনাজপুর জেলার ৪ লক্ষাধিক নারী কৃষি শ্রমিক
‘কাম করি সমান-বেতন পাই আর্ধেক’
দিনাজপুর প্রতিনিধি:
সমাজের সবক্ষেত্রে নারী—পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা হলেও কৃষি নির্ভর জেলা দিনাজপুরে চরম মজুরী বৈষম্যের শিকার ৪ লক্ষাধিক নারী কৃষি শ্রমিক। ফসলের মাঠে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সমানতালে কাজ করেও পুরুষের তুলনায় প্রায় অর্ধেক মজুরী পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নারী কৃষি শ্রমিকরা। শ্রম অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এই বৈষম্যের কথা স্বীকার করে বলেছেন, এ বিষয়ে কেউ অভিযোগ করলে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
দিনাজপুরের মোট জনসংখ্যা ৩৩ লাখ ১৫ হাজার ২৩৮ জন (২০২২ সালের জনশুমারী অনুযায়ী)। সরকারী হিসেবে অনুযায়ী, এই জনসংখ্যার ২৯ দশমিক ১৯ শতাংশ কৃষি শ্রমিক। যা সংখ্যায় দাঁড়ায় ৯ লাখ ৬৭ হাজার ৭১৮ জন। আর এর প্রায় অর্ধেকই নারী। এই হিসেব অনুযায়ী দিনাজপুরে নারী কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা ৪ লক্ষাধিক। কৃষি নির্ভর দিনাজপুর জেলায় কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধিতে বিশাল ভুমিকা থাকলেও চরম মজুরী বৈষম্যের শিকার এই ৪ লক্ষাধিক নারী কৃষি শ্রমিক। ফসলের মাঠে সমান কাজ করেও পুরুষের তুলনায় তাদের দেয়া অর্ধেক মজুরী।
দিনাজপুর সদর উপজেলার গোপালপুর গ্রামে মঙ্গলবার গিয়ে দেখা যায়, টমেটো ক্ষেতে কাজ করিছিলো ১১ জন নারী ও ৩ জন পুরুষ কৃষি শ্রমিক। দুপুরের কাকফাটা রোদে টমেটো গাছ থেকে টমেটো সংগ্রহের কাজ করছিলো তারা। এসময় কথা হয়, নারী কৃষি শ্রমিক দীপ্তি রানী রায়ের সাথে। কথা বলতেই তিনি তার ভাষায় বললেন, “টমেটো বাড়ীত হামেরা পুরুষ—মহিলা কাম করি সমান, কিন্তু মহিলা বলিয়া হামেরা বেতন পাই আর্ধেক (অর্ধেক)। আর পুরুষগেলা পায় হামার থাকি ডবল”। দীপ্তি রানী জানান, টমেটো ক্ষেতে সারাদিন কাজ করে তাদের দৈনিক দেয়া হয় ২’শ টাকা করে। আর পুরুষদের দেয়া হয় ৪’শ টাকা করে।
টমেটো ক্ষেতে একই সাথে কাজ করা নারী কৃষি শ্রমিক শোভা রানী রায় বলেন, ২৫ বছর থাকি মানুষের জমিত কাম করি আইসেছি। সকসময় (সবসময়) হামাক বেতন দেয় অর্ধেক। ধান গাড়া (রোপন) আর কাটার সময় হামাক দেয় দিনে ৩’শ টাকা, আর পুরুষগেলাক দেয় ৫’শ টাকা দিন করি। হামেরা কি কাম কম করি? পুরুষগেলা বিড়ি খাবা যায়, চা খাবা যায়, কিন্তু হামেরা সকসময় ক্ষেতত কাম করি, তাহো হামার বেতন আর্ধেক। শ্রমিক অধিকারের দিবস মে দিবস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেই শোভা রানী বলেন, ‘হামেরা মুর্খ মানুষ ওইলা দিবস—টিবস সম্পর্কে হামেরা জানিনা—হামেরা খালি জানি, কাজ না করিলে হামার ভাত নাই’।
আরেক নারী কৃষি শ্রমিক রেহেনা খাতুন বলেন, পুরুষের সমান বেতনের কথা বললে মালিক আমাদের বলে—কাজে আসার দরকার নাই। আমরা না আসলে আর কেউ এসে কাজ করে দেয়। কি করবো—পেটের তাগিদে বাধ্য হয়েই এই বেতনে এসে কাজ করতে হয়।
নারী কৃষি শ্রমিকদের অর্ধেক মজুরী কেন?—এমন কথা জিজ্ঞাসা করতেই বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে টমেটো ক্ষেতের মালিক (নাম বলতে অনাগ্রহী) বলেন, পুরুষরা ভারী কাজ পারে—কিন্তু নারীরা পারে না, তাই মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের বেশী মজুরী দেয়া হয়।
শুধু গোপালপুর গ্রাম নয়, দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন এলাকায় খেঁাজ নিয়ে জানাযায়, সবক্ষেত্রে পুরুষ কৃষি শ্রমিকদের তুলনায় নারী কৃষি শ্রমিকদের মজুরী প্রায় অর্ধেক। ধান রোপন, ধানকাটা, ভুট্টা—টমেটোসহ বিভিন্ন ক্ষেতে নিড়ানী, সংগ্রহ ইত্যাদি প্রতিটি কাজেই পুরুষদের তুলনায় নারীদের মজুরী অর্ধেক দেয়া হয়। ধান কাটা মাড়াইয়ের সময় শ্রমিকদের চাহিদা বেশী থাকলেও পুরুষ শ্রমিককের দৈনিক ৫’শ টাকা মজুরী দেয়া হলেও নারী শ্রমিকদের দেয়া হয় আড়াই’শ টাকা থেকে ৩’শ টাকা পর্যন্ত। কৃষি নির্ভর এই জেলায় অন্য কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান না থাকায় বাধ্য হয়ে এই মজুরীতেই জমিতে কাজ করতে হয় নারী কৃষি শ্রমিকদের।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ দিনাজপুর জেলা শাখার সভাপতি ড. মারুফা বেগম বলেন, ‘১৮৮৫ সালে শ্রমিকদের শ্রমঘন্টা ও শ্রম মজুরী নিয়ে যে আন্দোলন হয়েছিলো—তা আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি বিশেষ করে নারী কৃষি শ্রমিকদের ক্ষেত্রে। কৃষি নির্ভর এই দিনাজপুর অঞ্চলে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, পুরুষের তুলনায় নারী শ্রমিকরা শ্রমঘন্টায় অনেক এগিয়ে রয়েছে। কারন মেয়েরা বাজে সময় নস্ট করেনা, অন্য জায়গায় যায়না। কিন্তু অনেক বেশী শ্রমঘন্টা দিয়েও পুরুষদের তুলনায় নারী কৃষি শ্রমিকদের মজুরী কম, বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই অর্ধেক। এটা খুবই দুঃখজনক। নারী—পুরুষ কৃষি শ্রমিকদের সমান শ্রমঘন্টা ও সমান শ্রমমজুরী নিশ্চিতকরনে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহনের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান ড. মারুফা বেগম।
নারী—পুরুষ কৃষি শ্রমিকদের মজুরী বৈষম্যের কথা স্বীকার করে আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর দিনাজপুরের উপ—পরিচালক মোহা ঃ আবুল বাসার জানান, শ্রমিকরা কাজ করে জমির মালিকদের সাথে সমঝোতার ভিত্তিতে। তবে যদি এ বিষয়ে কেউ অভিযোগ করেন, তাহলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।