২৫ আষাঢ়, ১৪৩২ - ০৯ জুলাই, ২০২৫ - 09 July, 2025

বাসু নেই, কিশোরগঞ্জের বাতাসে মিষ্টি সুরেলা কন্ঠও নেই

2 weeks ago
72


সিএসএম তপন নীলফামারীঃ

নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলার সাংবাদিক জগতের পথিকৃৎ  শ্যাম সুন্দর মোহন্ত বাসু। সংক্ষেপে এস,এস,এম, বাসু। ৮০ দশকের দাপুটে একজন সাংবাদিক।

ডান কাঁধে কালো ব্যাগ। বাঁয়ে ম্যানুয়াল কামেরা। সোনালি ফ্রেমে বাঁধা চোখে কালো চশমা। হাঁটতেন ফুটবল খেলোয়াড়ের মত। হাঁটার সময় দু'হাত থাকত ছড়ানো। ডাঁন দিকে হেলে থাকতো দৃঢ় শরীর। চিরায়ত স্বভাব ছিল তাঁর।

ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক 'জাগরণ' পত্রিকায়  হাতে-খড়ি হয় বাসুর। এ অঞ্চলের প্রাচীন  দাপুটে পত্রিকা  দৈনিক দাবানলে পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে লেখনী জগতে দাপুটে লেখা শুরু করেন। তাঁর বহু লেখা দাবানলের পাতায় কালের স্বাক্ষী হয়ে আছে।

তাঁর লিখনির  সূচনায়  ক্ষুরধার  লেখায় প্রতিক্রিয়াশীল মহল বেশ সোচ্চার হয়েছিল। এজন্য মামলা-হামলা মোকাবেলা করতে হয়। এমকি রাতভর শারীরিক নির্যাতনের শিকার  হন তিনি। লেখনী থেকে পিছটান দেননি। ক্রমশ তাঁর নিঃসঙ্গ পদচারণা বিপদসংকুল হয়ে উঠে। যুক্ত হয় তাঁর সতীর্থ  জিকরুল হক। তিনি জলঢাকা সরকারি   ডিগ্রি কলেজর সাবেক প্রিন্সিপাল।  তিনি খন্ডকালীন সাংবাদিকতা শুরু করেন বাসুর সাথে। বেশীদিন টিকেনি তাঁর এই জগৎ। শিক্ষকতায় ফেরেন।

বাসু এই পেশার পাশাপাশি সাহিত্য চর্চা করেছেন। বিভিন্ন জাতীয় দিবসে সাহিত্য সাময়িকী বের করছেন বেশ ক'বার। নতুন প্রজন্মের অনুপ্রেরণার জন্যই  এমন সাহসী উদ্দ্যোগ তাঁর।

একজন ভাষ্যকার হিসাবে চৌকশ ছিলেন বাসু। আশি ও নব্বই এর দশকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের একমাত্র ভরসা ছিল এই বাসু। বিশেষ করে জাতীয় দিবসগুলোতে  বাসুর  সরব উপস্থিতি জানান দিত মাইকে ধ্বনিত হওয়া বিশেষ ঢংয়ে উপস্থাপন। চিবিয়ে চিবিয়ে বলতেন। সুরেলা মিষ্টি কন্ঠ। কিশোরগঞ্জের বাতাসে সুরেলা কন্ঠ ভেসে বেড়াত।

 

বাসু ২০১৩ সালের ১৯ জুন দুপুরে কিশোরগঞ্জ উপজেলা ক্যাম্পাসে টি স্টলের 'বাঁশের আটালে' বসা বন্ধু আলমকে পাওনা টাকার জন্য  স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ডেকে; কোমলভাবে রাগ দেখান অল্প পরিমানের পাওনা টাকার জন্য। যে রাগে উত্তাপ নেই। জোড়করে তাঁর কাছ থেকে চা-পান আদায় করে বলেন, এখনই রংপুর যাব। তাঁর সহচর বাল্যবন্ধু  জাকির হোসেন বাবুল সহ চলে যান গন্তব্যে। মৃত্যুর কয়েক  ঘন্টা আগে  রংপুর থেকে ফেরার পথে বাইকে চলন্ত অবস্থায় কিশোরগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সভাপতি ফজল কাদিরকে  ফোন করে বলেন, রাজিব গ্রামের একটা  অপমৃত্যুর সংবাদ তাঁকে মেইলে দেয়ার জন্য। তারাগঞ্জে কয়েকজন স্থানীয় সাংবাদিকদের সাথে চা চক্র শেষে বিকেলে দীর্ঘদিনের মোটা অংকের পাওনা টাকার জন্য ভাটা মালিককে চাপ দিয়ে সৈয়দপুর চলে যান।

সন্ধায় সেখান থেকে ফেরার পথে খিয়েরজুম্মায় সড়ক দুর্ঘটনাকবলিত হয়ে না ফেরার দেশে চলে যান বাসু। তবে তাঁর মৃত্যুটিকে অনেকে রহস্যজনক মনে করেন। বাসুর মৃত্যু শুধু পরিবারের জন্য দুঃসংবাদ নয়। এটি কিশোরগঞ্জবাসীরআ জন্য দুঃসংবাদ ছিল। কিশোরগঞ্জের জন্য একটি রত্ন বিয়োগ।

 

এসএসএম বাসু ছিল ব্যক্তিগত জীবনে নির্ভিক, পরোপকারী, অমায়িক, সদালাপী,খোশমেজাজি ও বন্ধুবৎসল । সহসা কারো সাথে দুর্ব্যবহার করার নজির নেই। হাসি মুখেই কথা বলত সকলের সাথে। কাছের লোকদের একটা বিশেষণ দিয়ে সন্মোধন করত। যেমন তাঁর বন্ধু  প্রয়াত সাংবাদিক আলমকে দীর্ঘস্বরে ডাকতেন আ--লে---ম বলে। আর আলমও ডাকতেন বে---সু বলে।  এছাড়াও জেলা- উপজেলার সাংবাদিকদের সাথে যোগাযোগ রাখতেন।  এমনি খোশমেজাজী স্বভাবে পারস্পারিক সম্পর্ক বজায় রাখত।

ক্রীড়াঙ্গনে তাঁর সরব পদচারণা ছিল। প্রতিটি খেলায় সমান পারদর্শী ছিলেন। উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ফুটবলে খেলতেন ফরওয়ার্ডে। ছান্দনিক ক্রীড়া নৈপুণ্য ছিল তাঁর। গোল দিতে  ছিলেন পটু। তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার অনুমোদিত গোল্ডেন ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৭৮ সালে। সে সময় বয়স্কদের জন্য নৈশকালীন স্কুল পরিচালনা করেন। বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য টিউবওয়েল পাড়ায় পাড়ায় স্থাপন, স্যানেটরি ল্যাট্রিন ব্যবহার ও কল্যাণকর কাজে ব্যস্ত থাকতেন। ১৯৮৪ সালে সোনালী ব্যাংকে ফিল্ড কর্মী হিসেবে  চাকুরী শুরু করেন। ১৯৮৬ সালে সারা দেশে কয়েক হাজার  কর্মী ছাটাই হয়। চাকুরী চলে গেলে কিশোরীগঞ্জ  হাইস্কুলে  অফিস সহকারী হিসেবে যোগদান করেন।বাসু দৈনিক খবর,  দৈনিক জনতা, আজকের কাগজ ও সর্বশেষ দৈনিক সংবাদ ও রংপুর বিভাগীয় শহর থেকে প্রকাশিত  দৈনিক যুগের আলো পত্রিকায় জেলা প্রতিনিধি হিসেবে  কাজ করেন।  নিজের সাজানো সংসার সামলানোর পাশাপাশি বাকী ৫ ভাই'র সংসার নিয়ে ভাবনার অন্ত ছিল না। সমানে খরচ চালাতেন। কারণ ভাইরা অনেকে বেকার। আমাদের সমাজে এমন ঘটনা বিরল। স্ত্রী অনিতা রাণীও সহমত পোষণ করতেন তাঁর মহতি কাজকে। বাসু কিশোরগঞ্জ উপজেলার স্যাটেলাইট সেবা দেওয়ার জন্য ক্যাবল অপারেটর ব্যবসা শুরু করেন। বর্তমান ওই কেবল ব্যবসায় ভাইরা অনেকেই জীবিকা নির্ভর করছেন। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের উপজেলার  প্রতিষ্ঠিতা  ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। কিশোরীগঞ্জ  বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় হতে ১৯৭৭ সালে বাসু এসএসসি পাশ করেন। রংপুর পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট আই পাস করার ঢাকা জগ্ননাথ কলেজ বি কম অধ্যায়নরত অবস্থায় জাসদের রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পরেন। শহীদ জিয়ার শাহাদৎবরণ, হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের জোড়করে ক্ষমতাগ্রহণের ক্রান্তিকালে জীবন বাঁচাতে নিজ এলাকায় চলে আসেন। সেই আমলে  বাবার নামকরা ব্যবসার দেখাশুনা শুরু করেন। দারোয়ানি মেলায় খন্ডকালিন মিষ্টির দোকান দেখভাল করতেন। মেলায় অনেক বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে থাকা বাবা অক্ষয় কুমার রায় মোহন্তের ( আকালু মোহন্ত) নাম স্মরণীয় রাখতে ওই ব্যবসার হাল ধরে থাকেন। পরে দারোয়ানি টেক্সটাইল মিল লে-অপ ঘোষণার পরে বাবার নামকরা ব্যবসা বন্ধ করেন বাসু। বাসু দুই সন্তানের জনক। মৃত্যুর ১ মাস আগে একমাত্র  মেয়ে বিপাশাকে বিয়ে দেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের  অধ্যাপক ড. মনি কৃষ্ণ মোহন্তের সাথে। মেয়ে ঢাকা অর্থনীতি কলেজ হতে এম এ শেষ করেন। ছেলে  জয় ঢাকার একটি বেসরকারি কলেজ থেকে কম্পিউটার ইন ডিপ্লোমা কৃতিত্বের সাথে শেষ করেন।

মৃত্যুর আগে বাসু ঠিকাদারি পেশায় ঝুঁকেন বেশি । কাজের প্রাপ্তিতা বাড়ে। ব্যস্ততাও বাড়ে। স্বপ্ন তাড়িত করে সংসার গোছানোর। ফরওয়ার্ড খেলোয়ার বাসু হয়তো সংকল্প ছিল সব গুছিয়ে শেষ গোলটা দেয়ার। কিন্তুু একটি দুর্ঘটনা সব স্বপ্ন এলোমেলো করে দেয়।  প্রিয় মানুষ বাসু নেই,  তাঁর মিষ্টি সুরেলা কন্ঠ যেন আর ভেসে বেড়ায় না কিশোরগঞ্জের বাতাসে।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

// Set maxWidth