কুড়িগ্রামে আয়বৃদ্ধিমূলক কর্মকান্ডে বদলে যাচ্ছে চরবাসীর জীবনমান
আহসান হাবীব নীলু, কুড়িগ্রাম:
১৬টি নদ-নদী বেষ্টিত কুড়িগ্রাম জেলায় রয়েছে প্রায় সাড়ে ৪ শতাধিক চর। এইসব চরে বসবাস করে কৃষি কাজের সাথে যুক্ত অসংখ্য পরিবার। প্রায় প্রতিবছরই বন্যা ও নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়ে এইসব পরিবার, বিনষ্ট হয় চরের ফসল এবং পরিবারগুলো পড়ে যায় চরম সংকটে, হয়ে যায় দিশেহারা।
এহেন পরিস্থিতিতে ৮৪০টি পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে সরকার এবং একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ফ্রেন্ডশিপ, বাংলাদেশ। তারা দুর্যোগকালীন সময়ে ক্ষতিগ্রস্থদের সহায়তার পাশাপাশি পারিবারিকভাবে আয়বৃদ্ধিমূলক কর্মকান্ডে এগিয়ে এসেছে। আর তাদের সহযোগিতায় এসব পরিবার ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। সেই সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে তাদের জীবনমান।
সংস্থাটি এ বছর জেলার চিলমারী, রৌমারী ও সদর উপজেলায় ২৮টি চরের ৮৪০টি দরিদ্র পরিবারকে বিভিন্নভাবে সহায়তা দিয়ে উন্নয়নমুখী হতে সহযোগিতা করছে। প্রশিক্ষণসহ পরিবারগুলোকে শীত ও গ্রীষ্ম মৌসুমে শাকসব্জির বীজ দেওয়া ছাড়াও ভেড়া বিতরন করা হয়েছে। এছাড়াও পাশে দাঁড়ান তারা বিভিন্ন দুর্যোগে। বন্যাকালীন সময়েও যাতে সবজি উৎপাদন অব্যাহত থাকে সেজন্য কমিউনিটি ভিত্তিক সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ করেছে সংস্থাটি। বস্তায় আদা চাষে উৎসাহিত করায় গ্রামের প্রত্যেক বাড়িতে বস্তায় আদা চাষ হচ্ছে। সবজি উৎপাদনে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে ভার্মি কম্পোষ্ট উৎপাদন এবং ব্যবহারে সহায়তা প্রদান করছে। পরিবারগুলোর বন্ধন অটুট রাখার জন্য পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ ও আইনগত বিষয় নিয়ে পরামর্শ ও সহযোগিতা করা হয়।
আজ কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র নদীর অববাহিকায় চর যাত্রাপুর গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, এই গ্রামের বন্যা কবলিত এবং নদীভাঙ্গনের শিকার ৩০টি পরিবার পারিবারিক আয়বৃদ্ধিমুলক কর্মকান্ড ছাড়াও সামাজিক উন্নয়নমুলক কাজে যুক্ত হয়েছেন।
এই গ্রামের বাসিন্দা আকলিমা জানান, ফ্রেন্ডশিপের ট্রানজিশনাল ফান্ড প্রকল্প থেকে আমাকে ৪ হাজার ১০০ টাকা দিয়ে একটি ভেড়া দিয়েছে এবং সেটি থেকে ৪টি বাচ্চা হয়েছে। এখন আমার ৬টি ভেড়া; যার বাজারমূল্য ৪২ হাজার টাকা। একই গ্রামের তাজমা বেগম বলেন, আধুনিক পদ্ধতিতে শাক-সবজি উৎপাদনের প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর আমার বসতবাড়ীতে সবজি উৎপাদন করে এ বছর ২০ হাজার টাকার সবজি বিক্রি করেছি; যা আমার সাংসারিক ব্যয়ভার বহন করে কিছু টাকা সঞ্চয় করতে পারছি। স্বামীর একার আয়ের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে না।
চর যাত্রাপুর গ্রামের রাহেনা বলেন, প্রকল্প থেকে কেঁচো সার তৈরীর প্রশিক্ষণ পেয়ে বসতবাড়ীতে কেঁচোসার উৎপাদন করছি এবং প্রতিমাসে ১ হাজার ২ শত টাকার কেঁচো সার বিক্রি করছি। খাদিজা বেগমের সাথে কথা বলে জানা যায়, তিনি ফ্রেন্ডশিপের সহায়তায় ১০০টি বস্তায় আদার চাষ করেছেন এবং প্রতি বস্তায় ১ থেকে দেড় কেজি আধা পাবেন বলে তিনি আশাবাদী। এ গ্রামের আরো অনেকেই বস্তায় আদা চাষ, সবজি ও ভার্মিকম্পোষ্ট উৎপাদন এবং ভেড়া পালন করে পরিবারের আয়বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে।
এই গ্রামের লেবু মিয়া জানান, আমাদেরকে সুশাসন সম্পর্কে প্রশিক্ষন দেওয়া হয়েছে। আমরা পারিবারিক নির্যাতন, বাল্যবিবাহ, তালাকপ্রাপ্ত, বহুবিবাহ, পারিবারিক দ্বন্দ, সংবিধান, সংসদ সম্পর্কে জানতে পেরেছি। এখন কোনো আইনি পরামর্শ প্রযোজন হলে আমরা ফ্রেন্ডশিপের সহায়তা নিই এবং তারা আমাদেরকে বিনামূল্যে আইনি পরামর্শ প্রদান করেন।
একই গ্রামের রবিউল ইসলাম, আম্বিয়া ও সুমি বেগম বলেন, আগে হাট থেকে রাসায়নিক সার কিনে আনতাম, এখন আমরা জৈব সার তৈরি করে ব্যবহার করি, ফেরোমন ফাঁদ দিয়ে পোকা মারছি, সরকারি সুযোগ সুবিধা পেতে বিভিন্ন অফিসে যোগাযোগ করছি।
“ফ্রেন্ডশিপ” এর ট্রান্সজিশনাল ফান্ড (এএসডি) প্রকল্পের রিজিওনাল ম্যানেজার কৃষিবিদ মোঃ আশরাফুল ইসলাম মল্লিক জানান, ফ্রেন্ডশিপ লুক্সেমবার্গ এর সহায়তায় সদস্যদের অর্থনৈতিক উন্ন্য়ন, সুশাসন এবং স্থানীয় অবকাঠামো উন্নয়নে কুড়িগ্রাম সদর, চিলমারী এবং রৌমারী উপজেলার মোট ২৮টি চরে এ বছর ৮৪০ জন সদস্যকে উক্ত প্রকল্প সহায়তা প্রদান করেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, উক্ত প্রকল্পের পাশাপাশি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক উপকারভোগীদের প্রশিক্ষণ প্রদানসহ কারিগরী সহায়তা দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নে সর্বাতœক সহযোগিতা করা হচ্ছে।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ মো. হাবিবুর রহমান জানান, কুড়িগ্রাম সদর, চিলমারী এবং রৌমারী উপজেলায় ফ্রেন্ডশিপের ট্রানজিশনাল ফান্ড প্রকল্পের মাধ্যমে এ বছর ৮৪০টি পরিবারকে ভেড়া প্রদান করেছে এবং প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে; ফলে পরিবারগুলোর ভেড়া পালনের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে অধিক আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। প্রত্যেকটি ভেড়াকে টিকা এবং কৃমিনাশক বিনামূল্যে দেয়া হয়েছে। চর এলাকা ভেড়া পালনের জন্য উপযুক্ত তাই ভেড়া পালনের মাধ্যমে চরাঞ্চলের মানুষ স্বাবলম্বী হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।