নিজস্ব প্রতিবেদক:

ব্যতিক্রমী এক ঘটনা ঘটলো তিস্তা অববাহিকায়। দুই পারে হাজার হাজার মানুষের হাতে প্রজ্বলিত মশাল। কন্ঠে দৃপ্ত উচ্চারণ, জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই। কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে আয়োজক এবং ভুক্তভোগীদের দাবি, নভেম্বরে শুরু করতে হবে তিস্তা মহা পরিকল্পনার কাজ। প্রয়োজনে তিস্তা  বন্ড চালু করা হলে তাতে অর্থ দিতে চান তারা। 

বৃহস্পতিবার। (১৬ অক্টোবর) ঠিক সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা। তিস্তার পারে  উন্মুক্ত মঞ্চ থেকে মশাল প্রজ্জলনের ঘোষণা দিলেন "তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন" এর প্রধান সমন্বয়কারী আসাদুল হাবিব দুলু। সাথে সাথেই হাজার হাজার মশালে জ্বলে উঠলো আগুনের লেলিহান শিখা। এই মশাল একদিকে যেমন প্রত্যাশার। অন্যদিকে আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ। যুগের পর যুগ ধরে তিস্তায় নিঃস্ব হয়ে ঘরবাড়ি, ভিটে মাটি,জমি জিরেত হারিয়ে অববাহিকার মানুষের ভেতর  ক্ষোভের যে বারুদ জমে উঠেছিল। আগুন হয়ে জ্বলে উঠলো তিস্তা পারে। 

অংশগ্রহণকারী লালমনিরহাট এর খুনিয়া গাছ এলাকার বাসিন্দা সাদিকুল ইসলাম জানালেন, ৩৭ বিঘা জমি ছিল তার। সবই এখন তিস্তার গর্ভে। এখন ঢাকা খেটে জীবন ধারণ করেন তিনি। বলেন ভিটে মাটি জমি তিরে পুকুর সব তিস্তা খেয়ে ফেলেছে আমার। বুকের ভেতর তুষের আগুন। যখন শুনলাম মশাল জ্বালানো হবে। ঢাকা থেকে এসে অংশ নিলাম। বুকের ভেতরের তুষের আগুন মশালের মাধ্যমে জ্বালিয়ে দিলাম। আমার এই প্রতিবাদ রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের জন্য। আমি চাই তিস্তা খনন করা হোক। তা না হলে এই ক্ষোভের আগুন আন্দোলনের দাবানলে রূপ নিবে। 

আন্দোলনকারীদের হাতে মশাল, কন্ঠে স্লোগান, জাগো বাহে তিস্তা বাচাই। তিস্তা পারের কান্না, আর না আর না। নভেম্বরের মধ্যেই শুরু করতে হবে মেগা প্রকল্পের কাজ। এই প্রকল্পটিকে অববাহিকার মানুষ নদী খোড়ন হিসেবে চেনেন। তিস্তা খননেই বাঁচবে তাদের জীবন, জীবিকা। 

মশাল প্রজ্বলন  কর্মসূচিতে অংশ নিতে এসেছিলেন রংপুরের কাউনিয়ার বালাপাড়া এলাকার আফজাল হোসেন। তিনি জানালেন,  বাহে মুই মহাপরিকল্পনা বুজোম না। মুই বোজম তিস্তার খোড়ন। যদি তিস্তা খুড়ি দেওয়া হয় তা হইলে আর হামাক না খায়া থাকা লাগবে না। বউ-ছইল নিয়া আরাম মতো থাইকবার পাম। আবার সুবেদ ব্যবসা-বাণিজ্য কইরবার পাইলে হামরা সরকারোক 

 ট্যাক্স দেমো। তোমরা ডক্টর ইউনুসুক কন। জানুয়ারি মাসের পরে নির্বাচন হইবে। তখন ওমরা কাম কইরবারর পাবার নয়। ওমরা নভেম্বর মাসোতে হামার তিস্তা খোরার কাম শুরু করুক। 

মশাল প্রজনন কর্মসূচিতে অংশ গ্রহণকারীদের দাবি তিস্তা খনন না করায় তাদের জীবন জীবিকা মহাসংকটে পড়েছে। খরায় তাদের জীবন ওষ্ঠাগত। আর বর্ষায় মাসের পর মাস পানির সাথে যুদ্ধ করে থাকতে হয়। আর ভাঙ্গন তাদের জন্য বোনাস। অনেকেই ২০ বারেরও বেশি বাড়ি ভাঙ্গন মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতার কথাও বলেন। 

মশাল প্রজ্জ্বলন কর্মসূচিতে অংশ নিতে বিকেল থেকেই অববাহিকায় জড়ো হয় হাজার হাজার মানুষ। তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের এই কর্মসূচিতে সংহতি জানায় তিস্তা বাঁচাও  নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদসহ নদী আন্দোলনে যুক্তরা। তারা তুলে ধরেন কেন নভেম্বরের মধ্যেই শুরু করতে হবে তিস্তা মহা পরিকল্পনার কাজ। তিস্তা বন্ড তৈরি করারও প্রস্তাব দেন তারা। 

তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি নজরুল ইসলাম হক্কানী বলেন, ডিসেম্বরে তফসিল ঘোষণা করা হলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আর কোন প্রকল্প উদ্বোধনের সুযোগ থাকবেনা। সে কারণে আমরা চাচ্ছি নভেম্বর মাসেই তিস্তা মেগা প্রকল্পের কাজ শুরু করা হোক। সরকার নিজস্ব যে দুই হাজার ৪০০ কোটি টাকা দিতে চেয়েছে। সেটি দিয়েই কাজ শুরু করা হোক। পরে চীনের কাছ থেকে টাকা নেয়া যাবে।

তিনি বলেন, প্রয়োজনে তিস্তা পাড়ের মানুষ তিস্তা ভন্ডে টাকা দিবেন। দাবি মেনে নেয়া না হলে লংমাস টু প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় সহ বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। 

তিস্তা নদীর রক্ষা আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী আসাদুল হাবিব দুলু বলেন, আমরা নজিরবিহিন আন্দোলন করেছি। বিগত ১৬ বছর আন্দোলন হয়েছে। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ তিস্তা অববাহিকার মানুষের সামনে মূলা ঝুলিয়ে প্রতারণা করেছে। আমরা আর প্রতারিত হতে চাই না। আজকে তিস্তার দুই পারে আমরা যে মশাল প্রজনন করলাম। এর মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন  সরকারকে আমরা জানিয়ে দিলাম, আমাদের ভেতরের যে আগুন ছিল সেটি আমরা বাহিরে আনলাম। নভেম্বর মাসের মধ্যেই মেগা প্রকল্পের কাজ শুরু করা না হলে এই আগুনের দাবানল দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে। দুই কোটি মানুষের জীবন জীবিকাকে সংকটে রেখে বৈষম্য বিহীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তফসিল ঘোষণার আগেই নভেম্বরে মহাপরিকল্পনার কাজ শুরু করা না হলে উত্তরবঙ্গ স্তব্ধ সহ ভিন্নভাবে এই বঙ্গ কে অচল করে দেয়া হবে। 

এই মশাল প্রজ্জলন কর্মসূচি নীলফামারী রংপুর লালমনিরহাট কুড়িগ্রাম গাইবান্ধার তিস্তা অববাহিকার বারটি উপজেলার তিস্তা তীরে অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিটি অংশে হাজার হাজার মানুষ মশাল প্রজ্জল করেন।