জাল সিএস কপি ও ভুয়া নথিতে এমপিও আবেদন অগ্রায়ন—গাইবান্ধা জেলা শিক্ষা অফিসারের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ
বায়েজিদ, পলাশবাড়ী (গাইবান্ধা):
গাইবান্ধার সাদুল্লাপুরে ভুয়া নিয়োগ ও জাল-জালিয়াতির নথিপত্র প্রস্তুতের মাধ্যমে কথিত এক সহকারী শিক্ষকের অনলাইনে এমপিওভুক্তির আবেদন অগ্রায়ন করে বিভাগীয় কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানোর গুরুতর অভিযোগ উঠেছে জেলা শিক্ষা অফিসার মো. আতাউর রহমানের বিরুদ্ধে।
ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ থেকে শুরু করে সম্পূর্ণ নিয়োগ প্রক্রিয়া, যাচাই-বাছাই কমিটির কাগজপত্র, তৎকালীন শিক্ষা অফিসারের প্রত্যয়ন এবং সিএস কপি ব্যাকডেটে সৃজন করে ভয়াবহ জালিয়াতির আশ্রয়ে এমপিওভুক্তির আবেদন করা ওই কথিত শিক্ষকের নাম মো. মোজাম্মেল হক। আবেদনে তিনি দাবি করেন, ২০০৪ সালে সাদুল্লাপুর উপজেলার হিংগারপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও বিএম কলেজে তিনি সহকারী শিক্ষক (আইসিটি) হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন।
অভিযোগ রয়েছে, গোপন আঁতাত ও কয়েক লাখ টাকা ঘুষের বিনিময়ে মোজাম্মেল হকের জালিয়াতিপূর্ণ এমপিও আবেদন অগ্রায়ন করেন উপজেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার এবিএম নকিবুল হাসান। পরবর্তীতে আবেদনটি যথাযথ যাচাই ছাড়াই জেলা শিক্ষা অফিসার মো. আতাউর রহমান বিভাগীয় কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠান। গত ১২ ডিসেম্বরের আগেই তড়িঘড়ি করে ফাইল পাঠানো হয় বলে অভিযোগ রয়েছে, যা নিয়ে শিক্ষক সমাজে তীব্র ক্ষোভ ও প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। এ ঘটনায় নকিবুল হাসানের সঙ্গে ঘুষ গ্রহণ ও অর্থ ভাগাভাগিতে জেলা শিক্ষা অফিসারের সম্পৃক্ততা নিয়েও আলোচনা চলছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষক সূত্রে জানা গেছে, ভুয়া নিয়োগ ও জাল নথির মাধ্যমে এমপিওভুক্তির আবেদন অগ্রায়নের জন্য মোজাম্মেল হক নকিবুল হাসানের সঙ্গে কয়েক লাখ টাকার ঘুষ চুক্তি করেন। এর বিনিময়ে আবেদনটি অগ্রায়ন করা হয় এবং পরে গোপন আঁতাতে সেই অর্থ জেলা শিক্ষা অফিসারের সঙ্গে ভাগাভাগি করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে সোমবার দুপুরে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মো. আতাউর রহমান আবেদনটি রংপুর বিভাগীয় কার্যালয়ে পাঠানোর বিষয়টি স্বীকার করেন। তবে আবেদনটি ভুয়া বা জালিয়াতিপূর্ণ কিনা—তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যাচাই করবে বলে তিনি জানান। ভুয়া নিয়োগের দায় সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক ও উপজেলা শিক্ষা অফিসারের বলে মন্তব্য করেন তিনি। ঘুষের অর্থ ভাগাভাগির অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, নকিবুল হাসানের সঙ্গে তার কোনো ব্যক্তিগত সম্পর্ক নেই। তবে নকিবুলের বিরুদ্ধে দাখিল করা লিখিত অভিযোগ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান।
অন্যদিকে, ঘুষ ও দুর্নীতির অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার এবিএম নকিবুল হাসান বিষয়টি এড়িয়ে যান। একপর্যায়ে তিনি নিজে একসময় সাংবাদিকতা করেছেন দাবি করে প্রতিবেদকের কাছে তার বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ না করার অনুরোধ জানানো ও চায়ের দাওয়াত দেওয়ার অভিযোগ ওঠে।
এর আগেই অনলাইনে মোজাম্মেল হকের জালিয়াতিপূর্ণ এমপিও আবেদনের বিষয়টি ফাঁস হলে স্থানীয় সাংবাদিকরা অনুসন্ধান শুরু করেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২৪ সালের ১১ জানুয়ারি এমপিওভুক্তির আবেদন যাচাইয়ের জন্য গঠিত সাদুল্লাপুর উপজেলা পর্যায়ের কমিটি তার সিএস কপিতে তৎকালীন মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের স্বাক্ষর নেই বলে উল্লেখ করে। পরে শব্দ ও লাইন আড়াল করে জাল সিল-স্বাক্ষর বসিয়ে টেম্পারিং করা সিএস কপি এমপিও আবেদনে সংযুক্ত করা হয়।
আবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ২০০৪ সালে সহকারী শিক্ষক নিয়োগের জন্য ‘দৈনিক আখিরা’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির ভিত্তিতে ২০ অক্টোবর নিয়োগ পরীক্ষা এবং ২৬ অক্টোবর মোজাম্মেল হকের যোগদানের তারিখ দেখানো হয়। পরবর্তীতে ২০২২ সালে প্রতিষ্ঠান মাধ্যমিক পর্যায়ে উন্নীত হলে উপজেলা কমিটির যাচাই-বাছাইয়ে তার এই জালিয়াতি ধরা পড়ে।
এদিকে, এমপিওভুক্তির আবেদনে অনিয়ম ও ঘুষ-বাণিজ্যের অভিযোগের প্রতিকার চেয়ে গত বুধবার (১০ ডিসেম্বর) গাইবান্ধা জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন ভুক্তভোগী শিক্ষক-কর্মচারীরা। অভিযোগে বলা হয়, পলাশবাড়ীর মূল দায়িত্বের পাশাপাশি সাদুল্লাপুর ও সুন্দরগঞ্জ—এই তিনটি উপজেলার দায়িত্ব এককভাবে পালনের সুযোগে নকিবুল হাসান দাপটের সঙ্গে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন।
অভিযোগে আরও বলা হয়, মোজাম্মেল হকের পাশাপাশি মাদারহাট আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সাদেকুল ইসলাম ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী (আয়া) খালেদা খাতুনের এমপিওভুক্তির আবেদনও দাখিল করা হয়, যদিও তাদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, রেজুলেশন, নিয়োগ পরীক্ষা ও সংশ্লিষ্ট সব কাগজপত্র শতভাগ ভুয়া ও সৃজনকৃত। মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে এসব আবেদন অগ্রায়ন করা হলেও বিষয়টি জানার পর জেলা শিক্ষা অফিসার ওই দুই আবেদন বাতিল করেন।
অপরদিকে, লিখিত অভিযোগের পর নিজের ঘুষ-বাণিজ্যের বিষয় আড়াল করতে নকিবুল হাসান তদবির ও দৌড়ঝাঁপে মরিয়া হয়ে ওঠেন বলে অভিযোগ রয়েছে। একই সঙ্গে অভিযোগকারীদের ওপর ক্ষিপ্ত আচরণ ও হুমকির ঘটনাও সামনে আসে। এরই ধারাবাহিকতায় সোমবার দুপুরে রওশন আলম নামে এক সহকারী শিক্ষককে দিয়ে মোবাইলে ফোন করে অভিযোগকারীদের একজন, সহকারী প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর কবিরকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে।
এ অবস্থায় ভুক্তভোগীরা পলাশবাড়ী, সাদুল্লাপুর ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলা থেকে নকিবুল হাসানের দায়িত্ব অবিলম্বে প্রত্যাহার, সংশ্লিষ্ট দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং দাখিল করা অভিযোগ দ্রুত তদন্তের জোর দাবি জানিয়েছেন।