শ্যামপুর চিনিকল চালুর সিদ্ধান্ত
‘আখচাষির স্বপ্নের পুনর্জন্ম’
আঞ্চলিক প্রতিনিধি:
শুরুটা ছিল ১৯৬৬ সাল। অবহেলিত জনপদের মানুষের কাছে স্বপ্নের মতো। প্রান্তিক চাষির সম্ভাবনার অঙ্গীকারে ভরা। উত্তরের জেলা রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের শ্যামপুর গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একটি চিনিকল। যা ছিল এলাকার কৃষি উন্নয়ন এবং অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র। একসময় শ্যামপুর চিনিকলটি ছিল আখচাষি ও শ্রমিকদের স্বপ্নের জায়গায়। যেখানে হাজারো কৃষক তাদের পরিশ্রমের বিনিময়ে নতুন জীবনের স্বাদ পেয়েছিল। কিন্তু সেই চালু মিলটি হঠাৎ করে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে লোকশানের অজুহাতে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে হতাশা আর অন্ধকারের অধ্যায় সৃষ্টি হয় গোটা এলাকাটি। দীর্ঘ ৪ বছর পর সেই হতাশার জট খুলল। বর্তমান অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার আবারও শ্যামপুর চিনিকল চালু করার ঘোষণা দিয়েছে। এতে আনন্দের জোয়ার বইছে গোটা এলাকায়। তবে, এই ঘোষণার পেছনে শুধু উল্লাসই নয়, রয়েছে কিছুটা সংশয় ও উদ্বেগের মিশ্রণও। কারণ সময় মত আখ রোপন ও মিলের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সংস্কার না হলে মিল চালু করার সিদ্ধান্ত ব্যাহত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন প্রান্তিক চাষি ও সংশ্লিষ্টজন।
শ্যামপুর চিনিকলের ইতিহাস যেন এক উত্থান-পতনের কাহিনি। ১৯৬৭-৬৮ অর্থবছরে যখন এটি বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে, তখন চিনি এবং আখের বাণিজ্যে সফলতা ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা এলাকায়। প্রথমদিকে এটি ছিল স্থানীয় কৃষকদের জন্য আশার আলো। যাদের ভাগ্য বদলে যাচ্ছিল। কিন্তু ১৯৮৫ সাল থেকে মিলটি কিছুটা লোকশানের মুখে পড়ে। শেষ পর্যন্ত ২০২০ সালের ডিসেম্বরে লোকশানের অজুহাত দেখিয়ে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের নিদের্শে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি) ৬টি চিনিকল বন্ধের ঘোষণা দেয়। তার মধ্যে ছিল শ্যামপুর চিনিকলও। এর পর থেকে এলাকার কর্মী ও আখচাষিদের মধ্যে চরম হতাশা সৃষ্টি হয়। ওই বছরের ২৩ ডিসেম্বর পুণরায় মিল চালুর দাবিতে কৃষক,শ্রমিক সাধারণ জনতা, কর্মকর্তা-কর্মচারিরা মিলগেট এলাকায় অর্ধদিবস হরতালের ডাক দেয়। এতে পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এক পর্যায়ে তারা আমরণ কর্মসুচি ঘোষণা করে।
অবশেষে চার বছর ধরে বন্ধ থাকার পর, গত ১৭ ডিসেম্বর শ্যামপুর চিনিকল পুনরায় চালু করার প্রজ্ঞাপন জারি হয়। মিলটি চালু হওয়ার ঘোষণার পর এলাকার কৃষক, শ্রমিক এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে। শ্যামপুর চিনিকলের ভেতরের অবস্থা এখন খুবই জরাজীর্ণ। যন্ত্রপাতিতে মরিচা ধরেছে। আখ পরিবহনের ট্রাক্টরগুলোর টায়ার নষ্ট হয়ে গেছে। মিলের ভেতরে দীর্ঘদিন অবহেলায় ঝোপঝাড় ছড়িয়ে পড়েছে। স্থানটিতে যেকোনো মানুষ গেলে মনে হতে পারে, এটি যেন এক ভুতুড়ে জনপদ।
চার বছর পর মিল চালুর ঘোষণা:
গত ১৫ ডিসেম্বর শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আফরোজা বেগম পারুল এর স্বাক্ষরিত জারিকৃত এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন(বিএসএফআইসি) এর অধীন মাড়াই স্থগিতকৃত চিনিকলসমূহে পুনরায় মাড়াই কার্যক্রম চালু করা হবে। যা ২০২০ সালের ১ ডিসেম্বর (৩৬,০০,০০০০,০৬৪.২০.০১১.২০-১১৬ নং স্মারকমূলে) শিল্প মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে শ্যামপুর, সেতাবগঞ্জ, কুষ্টিয়া, পাবনা, পঞ্চগড় ও রংপুর চিনিকলের আখ মাড়াইয়ের কার্যক্রম স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়। এরমধ্যে মাড়াই স্থগিতকৃত চিনিকলসমূহ পুনরায় চালু করার জন্য এবং চিনিকল লাভজনকভাবে চালানোর নিমিত্তে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা প্রণয়নের লক্ষ্যে গঠিত টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। ওই টাস্কফোর্সের সুপারিশ ও মতামতের আলোকে চলতি মাসের ৩ তারিখে পর্যাপ্ত আখ প্রাপ্তি সাপেক্ষে প্রথম পর্যায়ে শ্যামপুর ও সেতাবগঞ্জ চিনিকল, দ্বিতীয় পর্যায়ে পঞ্চগড় ও পাবনা চিনিকল, তৃতীয় পর্যায়ে কুষ্টিয়া ও রংপুর চিনিকলের মাড়াই কার্যক্রম পুণরায় চালু করণের লক্ষ্যে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। এ ঘোষণার পর শ্যামপুর চিনিকলটির আশেপাশের এলাকার আখ চাষি, শ্রমিকসহ সাধারণ মানুষের মাঝে খুশির জোয়ার বইছে। আখ চাষে আগ্রহ বৃদ্ধি ও মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে- এমন আশায় স্বপ্ন দেখছেন ওই এলাকার মানুষজন।
চাষিদের উদ্বেগ:
দীর্ঘকাল ধরে শ্যামপুরের কৃষকরা আখ চাষে মনোযোগী ছিলেন। কিন্তু মিলটি বন্ধ হওয়ার পর, অনেক কৃষকরা আখচাষ থেকে সরে গিয়ে অন্যান্য ফসল চাষে মনোযোগী হয়ে পড়েছেন। আখ চাষের সময়কাল দীর্ঘ। প্রায় ১৭ মাস। যা এক কৃষকের জন্য অর্থনৈতিক দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ। চিনির দাম থাকলেও মিল চালু রাখা নিয়ে আছে নানা অনিশ্চয়তা। এ অবস্থায় অনেকেই এখন অন্য ফসলের দিকে ঝুঁকছেন।
নতুন করে সম্ভাবনা:
শ্যামপুর চিনিকল চালু করার ঘোষণার পর স্থানীয় মানুষের মধ্যে নানা ধরনের আশাবাদ দেখা গেছে। এটি পুনরায় চালু হলে, তারা আশা করছেন কৃষকরা আবারও আখ চাষে ফিরবেন। শ্রমিকরা কাজ ফিরে পাবেন। তবে, পুনরায় চালু হওয়া মিলটি শুধু চালু করলেই হবে না। এর জন্য ব্যাপক সংস্কার এবং সচেতনতার প্রয়োজন। আখচাষিদের পুনরায় উৎসাহিত করতে পারলে সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে গড়ে উঠবে শ্যামপুর।
কর্তৃপক্ষের কাছে চাষির আহ্বান:
চিনিকলটির আধুনিকীকরণ, আখচাষিদের সহায়তা এবং কৃষকদের প্রতি আগ্রহ ফিরিয়ে আনতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ জানান এলাকার চাষিরা। মিলের কার্যক্রম শুধুমাত্র কৃষি সেক্টরে নয়, পুরো অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি, এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সহায়ক হতে পারে বলে স্থানীয় মানুষ আশা প্রকাশ করছেন।
শ্যামপুরের পুনর্জন্ম:
শ্যামপুর চিনিকল পুনরায় চালু হওয়ার ঘোষণা একটি নতুন সম্ভাবনার সূচনা হতে চলেছে। তবে এটি সফল করতে হলে আরও কিছু নির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে। যদি সরকার এবং সংশ্লি¬ষ্ট কর্তৃপক্ষ আখচাষিদের সহায়তা করেন। মিলের সংস্কার এবং শ্রমিকদের পুনঃনিয়োগে সঠিকভাবে কাজ করতে পারে। তাহলে এ অঞ্চলের জন্য এক নতুন দিগন্তের সূচনা হবে। একই সঙ্গে শ্যামপুর চিনিকলের পুনর্জন্ম হবে বলে মনে করছেন এলাকাবাসী।
আখ চাষে নতুন করে সম্ভাবনা ও শঙ্কা:
সরকারের এ ঘোষণা এলাকায় নতুন এক প্রাণের সঞ্চার সৃষ্টি হয়েছে শ্যামপুর ও আশপাশের এলাকায়। কৃষকরা আবারও আখ চাষে উৎসাহী হচ্ছেন। বিশেষ করে, যারা দীর্ঘদিন ধরে অন্য ফসলের চাষে ঝুঁকেছিলেন, তারাও আশা করছেন মিল চালু হলে আখ চাষে আগ্রহ আবার বৃদ্ধি পাবে। তবে এখানেও কিছু শঙ্কা রয়েছে। চার বছর বন্ধ থাকার পর অনেক আখ চাষিরা অন্য ফসলের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। কারণ আখ চাষে দীর্ঘ সময় লাগে। ফলে, আখ চাষে নতুন করে ফিরে আসার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ সৃষ্টি না হলে, মিল চালু হলেও এর পুরোপুরি সুবিধা পেতে বেগ পোহাতে হতে পারে বলে এমন আশঙ্কা করছেন আখ চাষি নেতারা।
শিল্পের ইতিহাস এবং অর্থনৈতিক প্রভাব:
শ্যামপুর চিনিকলটির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯৬৬ সালে। প্রথম বছরেই এটি চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এই মিলটি এলাকার অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি হয়ে উঠে। তবে একসময় এই চিনিকলটির বিরুদ্ধে আখ চাষিদের অসন্তোষ এবং দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। যার ফলে প্রশাসনের সঙ্গে কৃষক নেতাদের স¤পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে। এর পরেও, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প হিসেবে মিলটি একসময় কার্যক্রম পরিচালনা অব্যাহত রাখলেও ১৯৮৪-৮৫ সাল থেকে লোকশান শুরু হয়। তা ক্রমেই বাড়তে থাকে। শেষ পর্যন্ত ২০২০ সালের ১ ডিসেম্বরে বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত শ্যামপুর সুগারমিলে লোকশানের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ২২৬ কোটি টাকা।
কারখানার বর্তমান অবস্থা:
চার বছর ধরে বন্ধ থাকা শ্যামপুর চিনিকলটির ভেতর আজও ঝোপঝাড় ও পতিত অবস্থায় পড়ে আছে আখ পরিবহনের ট্রাক্টরগুলো। যন্ত্রপাতিতে মরিচা ধরেছে। কারখানার টিন উড়ে গেছে। মিলটির অভ্যন্তরীণ পরিবেশ একেবারে অবহেলিত। তবে শ্রমিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারিরা আশা করছেন, মিল চালু হলে সব অসংগতি দূর হবে। তাদের কর্মসংস্থান হবে। পুরো এলাকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটবে।
আখ চাষি মিল কর্মচারী ও শ্রমিক নেতাদের প্রতিক্রিয়া:
এদিকে, শ্যামপুর সুগারমিল এমপ¬য়িজ ইউনিয়নের সাধারণ স¤পাদক আবু সুফিয়ান বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকায় মিলের অনেক যন্ত্রপাতি ঠিকঠাক নেই। যথা সময়ে সঠিক পরিমাণে আখ চাষ করা না হলে, চিনিকলটি লাভের মুখ দেখা থেকে বঞ্চিত হবে। এ জন্য মিলের পুরো সংস্কার কাজ দ্রুত শেষ করা প্রয়োজন। বিশেষ করে কৃষকদের প্রয়োজনীয় সহায়তা যেমন সার-বীজ, কীটনাশক ইত্যাদি সরবরাহ করতে হবে। এছাড়া, শ্যামপুর সুগারমিলের অবকাঠামোগত সংস্কারের কাজ শীঘ্রই শুরু করতে হবে। কারণ দীর্ঘদিনের অযত্নে অনেক যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে গেছে। মিলের কর্মচারীদেরও দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের দায়িত্বে ফিরে আনতে হবে। বিষেশ করে শ্যামপুর থেকে বদলী করা কর্মচারিদের নিজ এলাকায় এনে চাষিদের উৎসাহিত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারলে ভালো হবে।
আখচাষি কল্যাণ সমিতির সভাপতি এমদাদুল হক বলেন, ‘আগে যেখানে আখ চাষির সংখ্যা ছিল অনেক। এখন সেটা কমতে শুরু করেছে। অনেকেই নতুন ফসল চাষে আগ্রহী হয়েছেন। এখন তাদের আখ চাষের দিকে ফেরানো দরকার। কারণ চাষিরা যদি আবারও আখ চাষে ফিরে না আসেন, তাহলে চিনিকলটি চালু করলেও আখের সংকট সৃষ্টি হতে পারে।’
শ্যামপুর চিনিকল আখচাষি কল্যাণ কমিটির সাবেক সাধারণ স¤পাদক আলতাফ হোসেন বলেন, মিল চালুর এই সিদ্ধান্তে এলাকার মানুষজন অত্যন্ত খুশি। ১২০দিন মিল চালানোর জন্য আখের মজুত থাকা দরকার হয়। সে হিসেবে অন্তত ৬ থেকে ৭ হাজার একর জমিতে আখ চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। মিল চালুর ঘোষণায় এলাকার মানুষজন আনন্দিত ও উজ্জীবিত। এ জন্য বর্তমান অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই।’
শ্যামপুর সুগারমিলস লিমিটেডের ইনচার্জ মাসুদ সাদিক (০১৭৬১১৪২৫৭৩) জানান, ‘দ্রুত সময়ের মধ্যে আখ রোপণ ও মিল সংস্কারসহ সকল অবকাঠামো উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন করা হবে।