৪ বৈশাখ, ১৪৩২ - ১৮ এপ্রিল, ২০২৫ - 18 April, 2025

লালমনিরহাটে অভিযান শেষে ফের চালু অবৈধ ইটভাটা !

3 weeks ago
419


লালমনিরহাট প্রতিনিধি :

কাগজ কলমে অবৈধ ইট ভাটা গুড়িয়ে ধ্বংস করার কথা বলা হলেও বাস্তবের চিত্রটা ভিন্ন। নামমাত্র চালানো প্রসাশনের অভিযান শেষে আবার চালু হয়েছে লালমনিরহাটের ৬ অবৈধ ইটভাটা ।

যৌথবাহিনীর বিশাল টিম নিয়ে গত ১২ মার্চ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলা বিএনপি'র আহবায়ক চন্দ্রপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলমের দলগ্রাম শ্রীখাতা এলাকার এমজেএ-২ ভাটাটি গুড়িয়ে দেয় প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেটরা। সেই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও যৌথবাহিনীর অভিযানিক দলটি নাম মাত্র ধ্বংস ও ভেঙে চলে যায়। পরেই তা সংস্কারে নেমে পড়েন ইট ভাটার শ্রমিকরা। পুনরায় চালু করা হয় অবৈধ এ ইটভাটাটি। শুধু এটিই নয় একই দিনে পাশের বিবিএমসি নামে অপর একটি ইট ভাটায় একই অভিযান চালানো হয়। মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশে জেলায় ৬টি ভাটা ধ্বংস করতে অভিযান চালানো হয়। অভিযান শেষে সবগুলোই পুনরায় চালু হয়েছে। প্রতিটি অভিযানে নাম মাত্র ধ্বংস ও চিমনিটি সামান্য ক্ষতি করে চলে গেলে তা পুনরায় সংস্কারের নেমে যায় শ্রমিকরা।

প্রশাসনের অভিযানে ধ্বংস প্রাপ্তের তালিকায় রয়েছে, কালীগঞ্জের দলগ্রামের এমজেএ-২ ব্রিকস, বিবিএমসি ব্রিকস, হাতীবান্ধার বড়খাতার টিএমএন ব্রিকস, আদিতমারীর পশ্চিম ভেলাবাড়ির সান টু ব্রিকস, পুর্ব দৌলজোরের ওয়ান স্টার ব্রিকস ও সাপ্টিবাড়ির এলএমবি।

জেলা প্রশাসনের তালিকা মতে লালমনিরহাটের ৫টি উপজেলা ও দুইটি পৌরসভায় ইট ভাটা রয়েছে সর্বমোট ৫৫টি। যার মধ্যে ৩২ টির বৈধ কোন কাগজপত্র না থাকায় কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। কালো তালিকায় পড়ে কিছু বন্ধ থাকলেও অধিকাংশই চলছে রীটপিটিশন ও স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে। অবৈধের তালিকার বেশির ভাগের নেই পরিবেশের ছাড়পত্র। কেউ উচ্চ আদালতে দায়ের করা রীটশনে ভর করে চালাচ্ছেন অবৈধ ইট ভাটা। আদিতমারী ও হাতীবান্ধা উপজেলার চিত্র একই। এ দুই উপজেলায় বৈধ ভাটা রয়েছে ৫টি করে আর অবৈধ ভাটার সংখ্যা ৯টি করে। ইট ভাটার সংখ্যা সব থেকে কম পাটগ্রাম উপজেলায়। এখানে ৪টি ভাটার ২টিই অবৈধ। আনুপাতিক হারে অবৈধ ভাটার পরিমান বেশি সদর উপজেলায়। এখানে ৮টি ভাটার মধ্যে বৈধ কাগজপত্র রয়েছে মাত্র দুইটির। বাকী ৬টি অবৈধ। এর মধ্যে দুইটি রীটপিটিশনে চলছে এবং বাকী দুইটি আপাতত বন্ধ। ভাটার সংখ্যা বেশি কালীগঞ্জ উপজেলায়। এখানে ১৫টি ভাটার ৬টিকে কালো তালিকা ভুক্ত করে অবৈধ ঘোষনা করেছে প্রশাসন।

অবৈধ ইট ভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় মহামান্য হাইকোর্টে সশরীরে হাজির হতে  হয়েছে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক এইচএম রকিব হায়দারকে। অবশেষে আদালতে হাজির হয়ে বিধিমত দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে জেলার কালো তালিকা ভুক্ত সকল ইট ভাটা ধ্বংস ও গুড়িয়ে দিতে সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের কঠোর নির্দেশনা প্রদান করেন তিনি। যার প্রেক্ষিতে চলতি মাসের ১২ তারিখের মধ্যে সকল নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা অভিযান চালিয়ে তার ছবিসহ প্রতিবেদন জেলা প্রশাসকসহ উচ্চ দপ্তরে প্রেরন করেন। সেই প্রতিবেদন পৌছানোর আগেই পুনরায় চালু হয়েছে ভেঙে দেয়া ৬টি অবৈধ ইট ভাটা।

নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক দলগ্রাম শ্রীখাতা এলাকার বিএনপি নেতা জাহাঙ্গীর আলমের এমজেএ -২ ভাটার একজন কর্মচারী বলেন, আমাদের এখানে একই উঠানে দুইটা ভাটা। একটির চিমনির সামান্য ভেঙেছে ম্যাজিস্ট্রেটের বুলডোজার ও কিছু ইট ভিজিয়ে দিয়েছিল। পরে আমরা চিমনিটি সংস্কার করলেও চালু করা হয়নি। অবৈধ ভাটা আরও ছিল সেগুলোও পুনরায় চালু করেছে।

গত ১২ জানুয়ারি ও ৬ ফেব্রুয়ারি বিএনপি নেতা জাহাঙ্গীর আলমের এমজেএ -২ ভাটাটির কার্যক্রম বন্ধ করতে দুই দফায় চিঠি দেয় উপজেলা প্রশাসন। এরপর ১১ ফেব্রুয়ারি ওই ভাটায় অভিযান চালান পরিবেশ অধিদপ্তর ও দুইজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। বিএনপি নেতা তার লোকজন ও ভাটার ট্রাক দিয়ে অভিযানিক দলকে অবরুদ্ধ করে রেখে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করে। সে ঘটনায় ৫জনের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করে প্রশাসন। এরপর গত ১২ মার্চ অবৈধ ভাটাটি ধ্বংস করে বুলডোজার নিয়ে অভিযান চালানো হয়। সেই ভাটাটিও পুনরায় চালু করা হয়েছে।

অবৈধ ভাটা মালিকারা নিজের স্বার্থে ভাটা টিকিয়ে রাখতে রাজনৈতিক প্রভাবকে ব্যবহার করছেন বলে একটি সুত্র দাবি করেছে। বিগত দিনে আওয়ামীলীগ সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী এমপি ও দলের নেতাকর্মীদের ডোনেশন দিয়ে  নিজেদের আওয়ামীলীগ পরিচয় দিয়ে ভাটা টিকিয়ে রেখেছেন। এসব ভাটা মালিক আওয়ামীলীগের পলানোর পরপরেই তারাও খোলস বদল করে বিএনপি'র নেতা হয়ে গেছে শুধু ভাটা বাঁচানোর জন্য। এরই প্রভাবে ধ্বংস বা উচ্ছেদের নাম মাত্র অভিযান চালায় প্রশাসন। রাজনৈতিক প্রভাবের কারনে সরকার এসব অবৈধ ভাটা উচ্ছেদ করতে ব্যর্থ হচ্ছে বলে দাবি করেন প্রশাসনের কর্মকর্তা কর্মচারীরা।

সদর উপজেলার কুলাঘাট ধাইরখাতা এলাকায় ফিলিং স্টেশনের দেড় থেকে দুইশত গজের মধ্যে নির্মিত হয় এসএস ব্রিকস নামের একটি ভাটা। প্রায়ত ব্যবসায়ী ফজল মিয়ার ছেলে সোহাগ ও সম্প্রাটের নামে রয়েছে এসএস ব্রিকস এবং কর্ণপুরের হাজী ব্রিকস। দুইটি ভাটাই চলছে মহামান্য হাইকোর্টের রীটপিটিশনের অজুহাতে।

লালমনিরহাট জেলা বিএনপি'র সহ সভাপতি  রোকন উদ্দিন বাবুলের মালিকানাধিন আদিতমারী উপজেলার কমলাবাড়ি চন্দপাট গ্রামের বিটি ব্রিকস ভাটায় নেই পরিবেশের ছাড়পত্র। তবুও চলছে বিরামহীন গতিতে। সদর উপজেলার ইট ব্যবসায়ী সিরাজুল  হকের মালিকানাধিন ওয়ান স্টার, টু স্টার ও থ্রি-স্টার নামের তিনটি ইট ভাটা। একটি ভাটারও বৈধ কোন কাগজ পত্র নেই। সাম্প্রতি যার দুই বন্ধ রয়েছে এবং একটি ভেঙে দিলেও পুনরায় চালু করা হয়েছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রহীন মেসার্স বিবিএমসি ব্রিকস ভাটাটি কালীগঞ্জের দলগ্রাম ইউনিয়নের শ্রীখাতায় অবস্থিত। যা গত ১২ মার্চ অভিযান চালিয়ে ভেঙে দিয়েছে প্রশাসন। সেটিও বীরদর্পে চালাচ্ছেন মালিক আতাউর রহমান। যিনি এক সময় নিজেকে সাবেক সমাজকল্যান মন্ত্রীর কাছের মানুষ পরিচয় দিতেন। বর্তমানে বিএনপি'র ত্যাগী কর্মীর পরিচয় দিচ্ছেন। অভিযানের পরদিন থেকে চালু রয়েছে অবৈধ এ ভাটাটি। স্থানীয়রা বলেন, প্রশাসন নাম মাত্র একটু ভেঙেছে আর পানি দিয়েছে। তারা চলে গেলে পরদিনই চালু হয়েছে ভাটাটি।

আদিতমারীর পশ্চিম ভেলাবাড়ির সান ব্রিকস ভাটার পাশের কৃষক রবিউল ইসলাম বলেন, ম্যাজিস্ট্রেট যে বুলডোজার নিয়ে এসেছিল তার চালককে ৩ হাজার টাকা ঘুস দেয়ায় বেশি ভাঙেনি। যা ম্যাজিস্ট্রেট যাবার পরই চালু করেছে। এ ভাটাটি আমার বাড়ির লাগোয়া। শুরু থেকে ভাটাটি বন্ধে বিভিন্ন স্থানে অভিযোগ দিয়েছি। কোন কাজ হয়নি। ভাটার কারনে কোন চাষাবাদও হচ্ছে না। এটি ভেঙে দিতে প্রশাসনের দৃষ্টিকার্ষন করেন তিনি।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, এমজেএ -২, বিবিএমসি ব্রিকস, সান টু, এলএমবি, টিএমএন ব্রিকস, ওয়ান স্টার ব্রিকসের চিমনিতে সামান্য অংশ ভাঙার চিহ্ণ থাকলেও তা সংস্কার করে চালু করা হয়েছে। গত সপ্তাহে অভিযান চালিয়ে ভেঙে দেয়া জেলার অবৈধ ৬ টি ভাটায় এমন চিত্র বিরাজ করছে। যত্রতত্র ইট ভাটার কারনে পরিবেশ যেমন বিনষ্ট হচ্ছে। তেমনি কৃষি জমির উপর চাপ বাড়ছে। প্রতিটি ভাটা সফলি জমির টপ-সয়েল গিলে খাচ্ছে। ফলে কৃষি জমির পরিমান যেমন কমছে, তেমনি জমির ঊর্বররা শক্তি কমে গিয়ে কমে যাচ্ছে ফসল উৎপাদন। পরিবেশ রক্ষায় ও কৃষি উৎপাদন বাড়াতে অবৈধ ইট ভাটা সমুলে ধ্বংস করার জোর দাবি স্থানীয়দের।

কালীগঞ্জের শ্রীখাতার বিবিএমসি ব্রিকসের মালিক আতাউর রহমান বলেন, গত ৬ মার্চ মহামান্য হাটকোর্টে রীট করেছি। রীটের কাগজ দেখালেও ম্যাজিস্ট্রেট তা গ্রহন না করে ভাটার চিমনি ভেঙেছিল। যা সংস্কার করে পুনরায় চালু করেছি। সবাই রীটের কাগজ দিয়ে চালাচ্ছে তাই আমিও চালু করেছি। আমরা তো আপনার (প্রতিবেদকের) কোন ক্ষতি করি নি। তাহলে সংবাদ প্রকাশ করে আমাদের ক্ষতি করবেন কেন? এমন প্রশ্ন করেন তিনি।

লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক এইচএম রকিব হায়দার বলেন, অবৈধ সকল ভাটা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বুলডোজার দিয়ে ধ্বংস করা হয়েছে। এরপরও যদি কেউ চালু করে তার তালিকা বা নাম দিলে আমরা দ্রুত পুনরায় বন্ধ করে দিবো। তবে অবৈধ কোন ভাটা চালু নেই বলেও জোর দাবি করেন তিনি।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

// Set maxWidth