অনেক কষ্টে গড়া নিজের সুখের ঘরে তার স্থানটিই শূন্য

সিএসএম তপন, নীলফামারীঃ
ঈদুল আযহা কেন্দ্র করে পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন নিয়ে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে নাড়ির টানে বাড়ি ছুটছেন অসংখ্য মানুষ। আবার অনেকে ব্যস্ত রয়েছেন কেনাকাটা আর পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে ঈদ উদযাপনের প্রস্তুতি নিয়ে। বাবা-মা, ভাইবোন, স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করবেন সবাই। কিন্তু অনেকেই আছেন যারা তাদের পরিবারের সদস্যদের ছেড়ে দূরে একা ঈদ করবেন, কেমন কাটবে তাদের ঈদ? বলছিলাম বৃদ্ধাশ্রমে থাকা অসহায় সেই বৃদ্ধ বাবা-মায়েদের কথা। দীর্ঘ দিন ধরে বৃদ্ধাশ্রমে ঈদ পালন করেছেন অসংখ্য সুবিধাবঞ্চিত বাবা-মা। বৃদ্ধাশ্রমে থাকা বৃদ্ধদের সন্তানরা বেশির ভাগই প্রতিষ্ঠিত। এর পরও তাদের ঈদ করতে হয় বৃদ্ধাশ্রমে। আর এই বিশেষ দিনটিতে হতাশা আর শূন্যতা নিয়ে সন্তানের স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান বৃদ্ধাশ্রমে থাকা এসব মানুষ। বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানদের চরম অবহেলা-অবজ্ঞার চিত্র ধরা পড়ে বৃদ্ধাশ্রমে। অসংখ্য সন্তান বৃদ্ধ বাবা-মাকে পরিবারের পরিত্যক্ত বস্তু ভেবে পাঠিয়ে দেন বৃদ্ধাশ্রমে। সমাজের নিম্নবিত্ত পরিবার ছাড়িয়ে উচ্চবিত্ত পরিবারের প্রবীণ মায়েরা রয়েছেন এসব বৃদ্ধাশ্রমে।
প্রায় প্রতিদিনিই বুকের ভেতর পাথর চাপা কষ্ট, হতাশা ও শূন্যতা নিয়ে প্রিয়জনের পথ চেয়ে বসে থাকেন প্রবীণ নিবাসের বৃদ্ধরা। আক্ষেপ করে অনেকেই বলেন, অনেক কষ্টে গড়া নিজের সুখের ঘরে তার স্থানটিই শূন্য। ছেলে মেয়ে থাকা সত্ত্বেও আজ আমরা এই পৃথিবীতে নিঃসঙ্গ জীবনের বাসিন্দা ঈদের এ আনন্দের দিনে বৃদ্ধ বয়সে প্রিয় সন্তানের জন্য মুখ লুকিয়ে নীরবে ফেলছেন চোখের পানি। অতীতে সুখের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে জীবন যাপন করছেন অসহায় মা-বাবা। জীবনের সমস্ত সুখ বিসর্জন দিয়েছেন সন্তানদের জন্য। আজ শেষ বয়সে, সেই সন্তানই নেই পাশে। তারা বৃদ্ধাশ্রমে যত্নে থাকলেও ভালো নেই বাবা-মা। সন্তানের জন্য প্রতি মুহূর্তে হৃদয় কাঁদে তাদের।
নিজেদের জীবনের সব সময়, ধনসম্পদ বিনিয়োগ করেছিলেন সন্তানের জন্য, নিজের জন্য রাখেননি কিছুই, করেছি সন্তানের জন্য অশ্রুসিক্ত নয়নে কথাগুলো বলেছিলেন নীলফামারীর জেলার সৈয়দপুর শহরের নামকরা ডিসেন্ট টেইলার্সের কাটিং মাষ্টার আনোয়ারুল ইসলাম দুলাল বলেন আমার মেয়ে স্পেনে থাকে,ছেলে জাপানে ছিল, গত বছর দেশে ফিরেছে, তারা কেউ খবর রাখেনা,আগের মত চলতে পারি না,তাই নিরুপায় হয়ে বৃদ্ধাশ্রামে আছি।
সন্তানের জন্য জীবনের সর্বচ্ছ বিলিয়ে দিয়েছি। তাদের সুখের জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলে
রিক্সা চালিয়ে ঈদে নতুন জামা কাপড় কিনে দিয়েছি। নিজে না খেয়ে সন্তানকে মানুষ করেছি আজ সেই সন্তান বউ বাচ্চা নিয়ে সুখে শান্তিতে আছে গত ঈদের মত সামনে কুরবানির ঈদের দিনেও আমার খবর নিবে না এমন কথা বলছিলেন ষাটোর্ধ্ব বয়সী আক্কাস আলী।
রবিবার(১ জুন)সকালে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের নিরাপদ বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে কথা হয় এমন একাধিক বৃদ্ধ বাবা মায়ের সাথে।সেখানে বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা সাজেদুর রহমান সাজু নিজের আন্তরিক মমতায় পরম যত্নে আগলে রেখেছেন তাদের।তাদের জীবনের শেষ ঠিকানা এখন এই নিরাপদ বৃদ্ধাশ্রম।
সরেজমিনে আরও দেখা যায়, ঈদ উপলক্ষে সকলের সহায়তায় আর নিজ প্রচেষ্টায় বৃদ্ধ বাবা মায়েদের ভালো খাবার আর ঈদের নতুন জামা কাপড়ের জোগানের চেষ্টা করছেন সাজেদুর রহমান সাজু ।তারা অতীতের স্মৃতিকে ভুলার চেষ্টা করে হাসিমুখেই থাকছেন এখানে ।কিন্তু ক্ষণিকেই সন্তানদের অবহেলা আর অযত্নের কথা মনে হলে নিজের অজান্তেই চোখের পানি চলে আসে।
বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দা খালেদা বেগম( ৫৩) বলেন, এখানে রয়েছেন চার বছর। স্বামী মারা গেছে ১৫ বছর আগে। একটি মাত্র মেয়ে বিয়ে হয়ে গেছে। মেয়ে তার যা সম্পত্তি ছিল লিখে নিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। এরপর ঠাঁই হয় নিরাপদ বৃদ্ধাশ্রমে।
আরেক বাসিন্দা রহিম উদ্দিন বলেন, আমার ছেলে সন্তান সবাই বাইরের দেশে থাকে।আমি বৃদ্ধ হওয়ায় তারা আমাকে তাদের সাথে নিয়ে যায়নি।আমাকে বাড়িতে ফেলে রেখেছে সেখানে দেখার মত কেউ নাই। আমি অসুস্থ মানুষ একা চলাফেরা করতে পারিনা।এখন তারাও আমার খোঁজখবর নেয়না তাই আমি উপায় না পেয়ে এই বৃদ্ধা শ্রমে এসেছি। আজ ছেলে মেয়েদের অনেক টাকা পয়সা তারা আমার খবর নেয় না ।
নিরাপদ বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা সাজেদুর রহমান সাজু বলেন, এখানে থাকা বৃদ্ধদের দেখাশুনা করি আমি একা। তার মধ্যে অনেকেই মানসিক ভারসাম্যহীন। চেষ্টা করি তারা যেন ভালো থাকেন। আমি প্রত্যাশা করি, প্রতিটি ছেলে যেন তাদের মা-বাবাকে নিয়ে যান। প্রতিটা বাবা-মা যেন শেষ বয়সে সন্তানের কাছে নিরাপদ একটা আশ্রয় পান। তাদের ভালো খাবার আর নতুন জামা কাপড় জোগান দিতে পেরেছি সকলের সহায়তায়। তবে আমি আশা করি সন্তানরা নিজের ভূল বুঝতে পেরে তাদের মা বাবাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে ইতিমধ্যে কয়েকজন মা বাবাকে ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছি।যারা রয়েছেন তাদের থাকা-খাওয়া, চিকিৎসাসহ সব ব্যবস্থা এখান থেকেই করা হয়।