২২ আশ্বিন, ১৪৩২ - ০৭ অক্টোবর, ২০২৫ - 07 October, 2025

পীরগাছায় এক ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মসহ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ

3 hours ago
28


নিজস্ব প্রতিবেদক:

রংপুরের পীরগাছার বড়দরগাহ উচ্চ বিদ্যালয়ে অনুমতি ছাড়া মালামাল বিক্রি, প্রকাশনীর সঙ্গে অবৈধ চুক্তি ও স্কুলের অভ্যন্তরীণ অর্থ আত্মসাতসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সাইফুল ইসলাম আজাদের বিরুদ্ধে।

গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর দায়িত্ব প্রাপ্তির পর থেকে শুরু হওয়া এসব অনিয়মের মাধ্যমে তিনি প্রায় ১৪ লাখ ৮১ হাজার টাকা আত্মসাত করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও স্থানীয়রা।

তারা অভিযোগ করেন, চলতি বছরের শুরুতে স্কুল বন্ধের সুযোগে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সাইফুল ইসলাম আজাদ প্রতিষ্ঠানের পুরনো ছাদের রড, দরজা, সিলিং ফ্যান, কাঠ, খাতা ও বইসহ বিপুল পরিমাণ মালামাল বিক্রি করেন। বিষয়টি জানাজানি হলে ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে 'চুরির নাটক' সাজানো হয়।

শিক্ষক ও অভিভাবকরা জানান, সাইফুল ইসলাম আজাদ লেকচার প্রকাশনীর সঙ্গে একটি গোপন চুক্তি করেন, যাতে তাদের বই বাধ্যতামূলক করা হয়। এর বিনিময়ে অর্থ আদায়ের অভিযোগও উঠেছে। শিক্ষকরা বলছেন, 'বই বাছাইয়ের স্বাধীনতা শিক্ষকদের ছিল না। একটি নির্দিষ্ট প্রকাশনীর বই কিনতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে।'

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রধান শিক্ষক নুরুল ইসলাম খোকন অসুস্থ্য কারণে ছুটিতে থাকায়, চলতি বছরে কয়েক ধাপে ১২–১৫ বছরের জমানো বই, খাতাপত্র, পুরনো ভবনের রড, টিন, কাঠ, বাঁশ বিক্রি, পুকুর লিজ, প্রকাশনীর অবৈধ চুক্তি মূল্যসহ স্কুলের অভ্যন্তরীণ আয়ের লাখ লাখ টাকা নিজের পকেটে নিয়েছেন।

স্কুল সূত্রে আরও জানা যায়, প্রায় ১২–১৫ বছরে জমানো বই ও খাতার পরিমাণ ছিল ৭–৮ টন, যার বাজারমূল্য প্রায় ৩ লাখ টাকা। সিলিং ফ্যান ২৯টি – ৯০ হাজার, পুরনো ছাদের রড ১,১০০ কেজি – ৫৭ হাজার, পুকুর লিজ ৪৩ হাজার, প্রকাশনী চুক্তি ৬৫ হাজার, পুরনো ভবনের টিন প্রায় ৪৪ মন – ৭০ হাজার, পুরনো কাঠ ও বাঁশ ২০ হাজার টাকা। মোট – ৬ লাখ ৪৫ হাজার টাকা।

২০২৪ শিক্ষাবর্ষের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ আয় ছিল ৫ লাখ ৩৬ হাজার টাকা এবং ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে স্কুলের অভ্যন্তরীণ আয় প্রায় ৩ লাখ টাকা। মালামাল বিক্রিসহ স্কুলের অভ্যন্তরীণ আয়ের মোট পরিমাণ দাঁড়ায় ১৪ লাখ ৮১ হাজার টাকা, যা কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে।

সরেজমিনে গেলে বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আব্দুল বাতেন, মো. ইউনুস, নুরে আলম সিদ্দিক, ওমর ফারুক, আবুল কালাম (ছোট কালাম) ও শান্তনা রাণী, রুবি বেগমসহ প্রায় সকল শিক্ষক-কর্মচারীর উপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সাইফুল ইসলাম আজাদ বলেন, 'কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া মালামাল বিক্রি করাটা আমার ভুল হয়েছে। তবে আমি সকল শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে রেজুলেশন করেই মালামাল বিক্রি করেছি।'

রেজুলেশন দেখতে চাইলে তিনি বলেন, রেজুলেশন চন্ডিপুর স্কুলের প্রধান শিক্ষক শামছুল আলমের নিকট আছে, আগামীকাল আসেন। পরের দিন (১৭ সেপ্টেম্বর) স্কুলে গেলে তিনি বলেন, রেজুলেশন দামুর চাকলা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আমীর হামজার নিকট আছে, আগামীকাল দেখাবো। পরের দিন (১৮ সেপ্টেম্বর) স্কুলে গেলে তিনি শিক্ষকদের বেতনের জন্য রেজুলেশন খাতা কম্পিউটার দোকানে দিয়েছেন। এছাড়াও একাধিক ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেন।

এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সহকারী শিক্ষকরা। প্রতিনিধির সামনেই তারা ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককে প্রশ্ন করেন, 'রেজুলেশন দেখালে কি সমস্যা? স্কুলের হিসাব নিয়ে এতো লুকোচুরি কেন?' সহকারী শিক্ষকরা বলেন, 'আমাদের প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ ভারপ্রাপ্ত প্রধানের হাতে নেই।'

সিনিয়র শিক্ষক আনোয়ার হোসেন, আব্দুল বাতেন বলেন, 'মালামাল বিক্রির সিদ্ধান্ত ছিল ভারপ্রাপ্ত প্রধানের। প্রতিষ্ঠান প্রধান কোনো সিদ্ধান্ত দিলে সহকারী শিক্ষকরা সাধারণত প্রধানের বাইরে যাওয়ার সুযোগ পান না।'

উল্লিখিত মালামালের হিসাব নিশ্চিত করে প্রধান শিক্ষক নুরুল ইসলাম খোকন বলেন, 'স্কুলের মালামাল বিক্রির বিষয়ে শুনেছি, তবে কতৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া এসব বিক্রির কোনো সুযোগ নেই।'

সাবেক শিক্ষার্থী ফিরোজ মিয়া বলেন, 'ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সাইফুল ইসলাম আজাদ ছাত্র জনতার আন্দোলনকে বিক্রি করতে ওই চেয়ারে বসেছেন। তার বিচার করতে হবে, অন্যথায় তার অপসারণের দাবিতে আবারও আন্দোলনের ডাক দেওয়া হবে।'

সাবেক শিক্ষার্থী সুরুজ আহমেদ বলেন, 'সাইফুল ইসলাম আজাদ ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নাহলে জানতামই না সে যে মারাত্মক লোভী মানুষ। সুযোগ হাত ছাড়া করেননি, চেয়ার পাওয়া মাত্রই মালামাল বেচে দিয়েছেন। তাকে অপসারণ করা দরকার।'

অভিভাবক রশিদুল ইসলাম বলেন, 'ভারপ্রাপ্ত প্রধান নিজেও এই স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার বাবা এই স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন, কিন্তু তিনি এমন লোভী সেটা জানা ছিল না।'

বিদ্যালয়ের সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার শেখ মো. রাসেল বলেন, 'স্কুলের মালামাল বিক্রির বিষয়ে আমাকে জানানো হয়নি। অনুমতি ছাড়া মালামাল বিক্রির কোনো নিয়ম নেই। শিক্ষকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।'

জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার এনায়েত হোসেন বলেন, 'টেন্ডার ছাড়া স্কুলের মালামাল বিক্রি আইনসিদ্ধ নয়। তদন্ত করে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল বলেন, 'বিষয়টি মাত্র জানলাম। তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।'

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

// Set maxWidth