১৬ কার্তিক, ১৪৩২ - ৩১ অক্টোবর, ২০২৫ - 31 October, 2025

রাজারহাটের তিস্তার ২৫টি চরের মানুষের একমাত্র ভরসা ভার ও নৌকা ॥ দূর্যোগকালীন স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে চরবাসীরা

3 days ago
66


প্রহলাদ মন্ডল সৈকত,রাজারহাট(কুড়িগ্রাম):

“হাগা আর নাপা ট্যাবলেট ছাড়া ঘরত কোন ওষধ নাই। আমাগো গা গরম হলে নাপা আর হাগা হলে হলুদ ট্যাবলেট খাই। চরত কোন ডাক্তার নেই তো হামরাগুলা কোন ডাক্তারের কাছে যামু।” নিজের অজান্তে কথাগুলো বলছিলেন কুড়িগ্রামের রাজারহাটের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তিস্তার নদীর পশ্চিম তীরের চর খিতাবখাঁ গ্রামের ইউসুফ আলী(২৮)। তিনি আরও বলেন-‘চরের পোলাপানের অসুখ হলে ডাক্তার নিয়ে যেতে হয় কাইম(চরের বিপরীত এলাকা) থেকে। গর্ভবর্তী মহিলাদের বাচ্চা প্রসবের জন্য নদী পার হয়ে ধাইয়ানী (ধাত্রী) নিয়ে যেতে হয়। গভীর রাত হলে কেউ যেতেও চায় না। এক প্রকার অনুরোধ করে নিয়ে যেতে হয়। সেই ধাইয়ানীকে ১৫'শ থেকে ২হাজার টাকা দিয়ে খুশি করতে হয়। ধাইয়ানী যেটা পারে না সে মহিলাকে নাওয়ে(নৌকা) করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে সিজার করতে হয়। সময় মতো নাও পাওয়া যায় না।’

বেশ কয়েকদিন সরেজমিনে ঘুরে জানা যায়, রাজারহাটে তিস্তা নদীর চর রয়েছে কমপক্ষে ২৫টি। এগুলো হলো-শাওলার চর, অতিদেবের চর, ঠুঁটাপাইকরের চর,বিদ্যানন্দের চর, গাবুর হেলানের চর, হায়বত খাঁর চর, বিশ-বাইশের চর, আজমখাঁর চর, শিয়াখাওয়ার চর, হরিচরনের চর, গনাইর চর,  চর হংসধর, চর পাড়ামৌলা, চর চতুরা, চর মনস্বর, চর তৈয়বখাঁ, চর খিতাব খাঁ, চর মেদনী, চর গতিয়াসাম, মাঝের চর, চর বগুড়া পাড়া, ঢ়ুষমারার চর, চর নাখেন্দা ও শনশানার চর। এসব চরের মানুষের জিবন যাপনে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকতে হয় সবসময়। 

যার মধ্যে রয়েছে সুপেয় পানির অভাব, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, স্বাস্থ্যসেবার অপর্যাপ্ততা এবং অসচেতনতা। বিশুদ্ধ পানির অভাবের কারণে তারা অনিরাপদ পানি পান করে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। এছাড়া চরাঞ্চলে কোন স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই, চিকিৎসক নেই, যা প্রাথমিক চিকিৎসাকেও কঠিন করে তুলেছে।  চরের মানুষের নদীপথে যাতায়াতের একমাত্র উপায় নৌকা। কিন্তু প্রায়শই নৌকার নিশ্চয়তা থাকে না এবং ভাঙন ও বন্যার কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও কঠিন হয়ে যায়। চরাঞ্চলের অনেক মানুষ, বিশেষ করে নারীরা, শারীরিক পরিচর্যা এবং স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে অসচেতন।

 ঘন ঘন বন্যা, জলাবদ্ধতা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে চরাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাহত হয় এবং স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বাড়ে বলে বেশ কয়েকটি চরে বসবাসরত মহিলা এবং পুরুষ জানান।

 স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে বিদ্যানন্দের চরের শরিফুল ইসলাম(৩৫) বলেন- আমাগো চরে কোন ডাক্তার নাই। শীত আর বর্ষায় গর্ভবর্তী মা আর বুড়া লোকরা অসুস্থ হলে কোন উপায় থাকে না। দিক-বেদিক ছুটতে হয় আমাগোর। সময় মতো ঘাটে নৌকা বাধাও থাকে না যে তাদের দ্রুত হাসপাতালে নিমু।

বুড়িররহাট তিস্তা নদীর ঘাটের ঘাটিয়াল নুর ইসলাম ওরফে বোচা(৫৫) বলেন- আমার নাও (নৌকা) রয়েছে। কিন্তু নৌকা বহনের লোক পাই না। তবে কেউ অসুস্থ হলে যতরাত হোক ছুঁটে যাই। ভয়-ডর করি না।

বুড়িরহাট এলাকার আ: লতিফ মোল্লা(৪৮) বলেন- এ এলাকায় নৌকার জন্য বোচা ছাড়া আর কেউ নাই। বোচাই সব সময় নৌকা নিয়ে লোক পারাপাড় করে। ওর মোবাইল নম্বর সকলের কাছে রয়েছে। ফোন দিলেই যত রাতই হোক ছুঁটে আসে।

বোচা মিয়ার মতো হয়তো  ঘড়িয়ালডাঙ্গা থেকে বিদ্যানন্দ এলাকায় সর্বোচ্চ ২/৩জনকে পাওয়া যেতে পারে। তাই তো চরের মানুষ অনেক নৌকার নাইয়ার(মাঝি) কাছে জিম্মি।

চর খিতাব খাঁ গ্রামের জয়নুদ্দী(৬৫), সলিম(৬৫),সোলেমান(৭৫),মোতালেব(৬৫) সহ অনেকে জানান- চরের লোকেরা সব সময় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে। আগে তো চরে কোন এনজিও কিংবা সরকারি লোকজন আসতো না। কিন্তু ইদানিং এই চরে ডিসি স্যার-এসপি সাব, ইউএনও পিআইও, সমাজসেবা সহ প্রাণি ও স্বাস্থ্য বিভাগের লোকজন আসতেছে। এমনকি চরের মহিলাদের নিয়ে অনেক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে। এই তো কয়েকদিন আগে রাজারহাট ইউএনও স্যার চরে এসে মহিলাদের নিয়ে সেলাই মেশিন প্রশিক্ষনের উদ্বোধন করে গেছেন। কিন্তু কেউ অসুস্থ হলে স্বচরাচর নৌকা পাওয়া যায় না। সরকারি ভাবে এম্বুলেন্স নৌকা দিলে আমাদের উপকার হতো। 

রাজারহাট উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আল ইমরান বলেন- চরের মানুষ বিভিন্ন নাগরিক সেবা ও স্বাস্থ্যসেবা হতে কিছুটা বঞ্চিত ও পিছিয়ে আছে।। আমরা উপজেলা ও জেলা প্রশাসন সব ধরনের সহযোগিতা করে যাচ্ছি। এমতাবস্থায় লাইট হাউজ  রিপোর্ট নাউ বিডি নামের যে ওয়েবসাইট হতে যাচ্ছে আমাদের এ কাজকে আরো বেগবান করবে বলে আশা করছি।

লাইট হাউজ’র উপ-পরিচালক মোঃ সাদিক আল হায়াত বলেন-‘বাংলাদেশ একটি দূর্যোগ প্রবণ দেশ। এর থেকেও ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে নদীকূলের চরাঞ্চলের মানুষ। তাই বেসরকারী সংস্থা লাইটহাউজ একটি যুগাস্তকারী পদক্ষেপ গ্রহন করে রিপোর্ট নাউ বিডি নামের একটি ওয়েবসাইট তৈরি করে সারাদেশে সাড়া ফেলেছে। এটির মাধ্যমে স্বেচ্ছাসেবক ও সাংবাদিকরা অতি দ্রুত দূর্যোগের বার্তা পৌচ্ছাতে পারেন। পোর্টাল এইসব তথ্য তাৎক্ষণিক যাচাই করে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্টদের কাছে পৌচ্ছে দিতে পারে। সেই অনুযায়ী দূর্যোগ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় উদ্ধার, ত্রাণ ও স্বাস্থ্য সহায়তার মতো কার্যক্রম দ্রুত শুরু করতে পারে সংশ্লিষ্টরা।’

লাইট হাউজ’র কুড়িগ্রাম প্রকল্প সমন্বয়কারী মোঃ জাহাঙ্গীর আলম বলেন- লাইট হাউজ কুড়িগ্রাম জেলায় ঊসঢ়ড়বিৎরহম ঈড়সসঁহরঃরবং ভড়ৎ ওহপষঁংরাব উরংধংঃবৎ জবংরষরবহপব: অ ঈঝঙ-গবফরধ চধৎঃহবৎংযরঢ় ঃড় চৎড়ঃবপঃ ঝধভবঃু ড়ভ ডড়সবহ ধহফ এরৎষং প্রকল্পের আওতায় কুড়িগ্রাম সদর, রাজারহাট, উলিপুর, চিলমারী, রাজিবপুরের দূর্যোগ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন/ফ্রি প্রেস আনলিমিটেড/ আর্টিকেল’১৯ এর আর্থিক সহায়তায় বাস্তবায়ন করছে। আমরা আগামীতে এ ধরনের প্রজেক্ট পেলে চরাঞ্চলের মানুষদের নিয়ে কাজ করবো।

চরাঞ্চলের মানুষ  ও সচেতন মহলদের দাবী- তিস্তার বিভিন্ন চরে কমিউনিটি ক্লিনিক এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন করা এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত  ওষুধ, মহিলাদের জন্য স্যানিটারী ন্যাপটিন, ডাক্তার, নার্স এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ করতে হবে।

 এছাড়া চরাঞ্চলে জরুরি স্বাস্থ্যসেবার জন্য নৌ অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করা এবং নদীপথের উন্নয়নের ওপর জোর দিতে হবে।

জিও-এনজিওকে স্বাস্থ্যবিধি, পুষ্টি এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য চরের মানুষকে নিয়ে কাজ করতে হবে। তাছাড়া সরকারকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

// Set maxWidth