নতুন কুঁড়িতে রংপুর বিভাগের শিশুশিল্পীদের সাফল্যগাথা…মো. মামুন অর রশিদ
নিজস্ব প্রতিবেদক:
প্রতিভা যখন সঠিক মঞ্চ পায়, তখনই তার দীপ্তি ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। ‘নতুন কুঁড়ি’ ঠিক এমনই এক মঞ্চ, যেখানে ছোট্ট স্বপ্নগুলো বড় হওয়ার সাহস পায়। স্বপ্নকে লালন আর সৃজনশীলতাকে বিকশিত করার অনন্য মঞ্চ ‘নতুন কুঁড়ি’। শিশু-কিশোরদের প্রতিভা অন্বেষণের এই মঞ্চ থেকে উঠে আসা অসংখ্য শিল্পী আজ দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আলো ছড়াচ্ছেন। সদ্য সমাপ্ত নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতায় রংপুর বিভাগের শিশুশিল্পীরা অসাধারণ পরিবেশনা উপহার দিয়েছে। নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতার ৭৩ জন পুরস্কার বিজয়ীর মধ্যে ৯ জন রংপুর বিভাগের। এই বিভাগের চার জন শিশুশিল্পী চারটি ক্যাটাগরিতে প্রথম স্থান অর্জন করেছে।
নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতায় ফাইরুজ বারী মালিহার গল্পবলা দর্শকদের মুগ্ধ করেছে। রংপুর সদরের এই শিশুশিল্পী নতুন কুঁড়ির ‘খ’ শাখায় গল্পবলায় প্রথম স্থান অধিকার করেছে। মালিহা রংপুর পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। মালিহার বাবা মো. ফজলুল বারী কলেজে শিক্ষকতা করেন। মালিহার মা মাহমুদা মার্জিয়া খানম একজন ব্যবসায়ী।
নতুন কুঁড়িতে গল্পবলায় প্রথম হওয়া ফাইরুজ বারী মালিহা বেশ কয়েকবার জাতীয় পর্যায়ে তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছে। সে ২০১৮ সালে জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতায় আবৃত্তিতে তৃতীয় স্থান অর্জন করে। ২০১৯ সালে একই প্রতিযোগিতায় মালিহা অভিনয়ে প্রথম স্থান অধিকার করে। একই বছর বিজয় ফুল তৈরি প্রতিযোগিতায়ও সে সারাদেশে প্রথম স্থান অধিকার করে। পরের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতায় অভিনয়ে প্রথম হয়ে সে সাফল্যের ধারাবাহিকতা ধরে রাখে। ২০২৩ সালে জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহের জাতীয় পর্যায়ে আবৃত্তিতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে সে আবারও তার যোগ্যতার প্রমাণ দেয়। ২০২৪ সালে জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহের জাতীয় পর্যায়ে নির্ধারিত বক্তৃতায় প্রথম স্থান এবং আবৃত্তিতে তৃতীয় স্থান অধিকার করে মালিহা নিজের প্রতিভার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। প্রতিভাবান এই শিশুশিল্পী পড়াশোনার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে জড়িত রাখতে চায়।
নৃত্যের ছন্দে এবারের নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতায় আলো ছড়িয়েছে রংপুর সদরের প্রতিভাবান শিশু মোছা. রওজা করিম রোজা। নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতার ‘খ’ বিভাগে সাধারণ নৃত্যে সে প্রথম স্থান অর্জন করেছে। রওজা করিম রোজা রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। রোজার বাবা মো. রেজাউল করিম পেশায় ব্যবসায়ী। রোজার মা মোছা. জেসমিন আরা বেগম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা।
নতুন কুঁড়িতে সাধারণ নৃত্যে প্রথম হওয়া রওজা করিম রোজা বেশ কয়েকবার জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কৃত হয়েছে। সে ‘জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতা ২০১৯’-এ ‘ভরত নাট্যম’ বিষয়ে প্রথম স্থান অর্জন করে। একই বছর ‘বৈশাখের রং লাগাও প্রাণে শীর্ষক প্রতিযোগিতা ১৪২৬’-এর জাতীয় পর্যায়ে ‘বাংলার বৈশাখ বাংলার নাচ’ ক্যাটাগরিতে রোজা দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। ২০২০ সালে জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতায় লোকনৃত্যে প্রথম ও সৃজনশীল নৃত্যে তৃতীয় হয়ে সে নিজের বহুমুখী দক্ষতা প্রমাণ করে। ২০২১ সালে একই প্রতিযোগিতায় ‘ভরত নাট্যম’ এবং ‘সৃজনশীল নৃত্য’—দুই ক্ষেত্রেই প্রথম হয়ে সে নিজের অবস্থান আরও সুদৃঢ় করে। ২০২২ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন উপলক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত জাতীয় পর্যায়ে নৃত্য প্রতিযোগিতায় রোজা প্রথম স্থান অধিকার করে। পরের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতার সৃজনশীল নৃত্যে প্রথম হওয়া তার সাফল্যের আরেকটি মাইলফলক। প্রতিভাবান শিশুশিল্পী রোজা বড় হয়ে একজন দক্ষ নৃত্যশিল্পী হতে চায়।
নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতায় লালমনিরহাটের শিশুশিল্পী ঐশর্য জিতা স্পর্শের নৃত্য দর্শকের নজর কেড়েছে। সে এবারে ‘ক’ বিভাগে সাধারণ নৃত্যে প্রথম হয়েছে। ঐশর্য জিতা স্পর্শ লালমনিরহাট ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। তার পিতা প্রানকৃষ্ণ বর্মন সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। স্পর্শের মা দেবযানী রায় মেডিকেল টেকনোলজিস্ট হিসেবে লালমনিরহাট মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে কর্মরত। ঐশর্য জিতা স্পর্শ জাতীয় পর্যায়ে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি পুরস্কার অর্জন করেছে। বাংলাদেশ শিশু একাডেমি আয়োজিত ‘বৈশাখের রং লাগাও প্রাণে শীর্ষক প্রতিযোগিতা ১৪৩১’-এর লোকনৃত্যে সে প্রথম স্থান অর্জন করেছে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত ‘দেশব্যাপী বয়স ও বিষয়ভিত্তিক জাতীয় নৃত্য প্রতিযোগিতা ২০২২’-এর লোকনৃত্যে সে সেরা নৃত্যশিল্পী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। একই প্রতিযোগিতার সৃজনশীল নৃত্যেও সে সেরা নৃত্যশিল্পী নির্বাচিত হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ জিয়া শিশু একাডেমি আয়োজিত ১৩তম জাতীয় শিশুশিল্পী প্রতিযোগিতা ‘শাপলাকুঁড়ি ২০২৫’-এ ‘ক’ বিভাগে ঐশর্য জিতা স্পর্শ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।
এবারের নতুন কুঁড়িতে ‘ক’ বিভাগে উচ্চাঙ্গ নৃত্যে প্রথম হয়েছে রংপুর সদরের মোছা. আদৃতা তাসনিম লাবণ্য। প্রতিভাবান এই শিশুশিল্পী রংপুরের দ্যা মিলেনিয়াম স্টার্স স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। আদৃতা তাসনিম লাবণ্যের বাবা মো. আশরাফুল আলম রিপন ছিলেন একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। লাবণ্যের মা মোছা. সুভিনা ইয়াসমীন রিসাও পেশায় ব্যবসায়ী। শিশুশিল্পী লাবণ্য পড়াশোনার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে চান।
প্রথম স্থান অর্জনকারী এই চার শিশুশিল্পী ছাড়াও রংপুর বিভাগের আরও ৫ জন শিশুশিল্পী বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় হয়েছে। নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতার ‘ক’ বিভাগে হামদ-নাতে দ্বিতীয় হয়েছে ঠাকুরগাঁওয়ের তাসবিহা আয়ান তানহা। ‘খ’ বিভাগে সাধারণ নৃত্যে দ্বিতীয় হয়েছে গাইবান্ধার রাধিকা তাছাল্লুম রিয়ন্তি এবং তৃতীয় হয়েছে ঠাকুরগাঁওয়ের ইউশা শাহিরা আনুভা। হামদ-নাতে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে পঞ্চগড়ের তাসনিম জাহান। অভিনয়ে তৃতীয় হয়েছে রংপুর সদরের মুরাদুস সালিহীন।
নতুন কুঁড়ির মঞ্চ শিশুদের শৈল্পিক বিকাশের পাশাপাশি তাদের দায়িত্ববোধ, শৃঙ্খলা ও আত্মবিশ্বাসও বাড়িয়ে তোলে। এই প্রতিযোগিতা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে একটি বিশেষ সংযোজন। বর্তমান অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস এবং তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মোঃ মাহফুজ আলমের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দীর্ঘ ২০ বছর পর নতুন উদ্যমে শুরু হয় নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতা। এ বছর নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতায় প্রায় ৩৯ হাজার প্রতিযোগী অংশ নেয়। ৬৪ জেলাকে ১৯টি অঞ্চলে ভাগ করে ২৪ থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আঞ্চলিক বাছাই পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। আঞ্চলিক পর্ব থেকে ‘ক’ ও ‘খ’—উভয় শাখার সকল ক্যাটাগরিতে প্রায় ১৪ হাজার প্রতিযোগী বিভাগীয় পর্যায়ে উন্নীত হয়। দেশের আট বিভাগে একযোগে এই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিযোগিতায় মোট বিষয় ছিল ১২টি। এগুলো হলো : অভিনয়, আধুনিক গান, আবৃত্তি, উচ্চাঙ্গ নৃত্য, কৌতুক, গল্পবলা, দেশাত্মবোধক গান, নজরুলসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত, লোকসংগীত, সাধারণ নৃত্য ও হামদ-নাত। বিভাগীয় পর্যায় শেষে শুরু হয় চূড়ান্ত পর্ব। আট বিভাগ থেকে ১ হাজার ৪০ জন প্রতিযোগী চূড়ান্ত পর্বে অংশ নেয়। চূড়ান্ত পর্বে উত্তীর্ণ ২৭৯ জন প্রতিযোগী সেরা ১০ পর্বে অংশগ্রহণ করে। এই পর্ব থেকে সেরা ৫ জন বাছাই করা হয়। এরপর ফাইনালে ‘ক’ বিভাগ থেকে ৩৬ জন এবং ‘খ’ বিভাগ থেকে ৩৭ জন প্রতিযোগীকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়।
এবারের নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীদের প্রতিভা যাচাইয়ের দায়িত্বে ছিলেন ২৯৩ জন বিজ্ঞ বিচারক। প্রতিযোগিতাটিকে অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে এবার ব্যাপক প্রচার কার্যক্রম চালানো হয়েছে। এর ফলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশু-কিশোররাও এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। ধর্ম, বর্ণ-নির্বিশেষে সকল শ্রেণির শিশু-কিশোর এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। বিটিভিতে প্রচারিত নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতার প্রতিটি পর্ব বিটিভির ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেলেও প্রচার করা হয়েছে। অনেকেই পরিচিত শিশু-কিশোরদের পরিবেশনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করেছেন। এর ফলে নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতাটি নেটিজেনদের কাছে অনলাইন বিনোদন হিসেবেও বিবেচিত হয়েছে।
প্রতিটি শিশু কোনো না কোনো প্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। শিশুদের বিশেষ প্রতিভা খুঁজে বের করাই নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতার মূল উদ্দেশ্য। নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতা রোজা, স্পর্শ কিংবা মালিহার মতো অসংখ্য প্রতিভা আবিষ্কার করেছে, যা দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে সমৃদ্ধ করেছে। নতুন কুঁড়ি শিশু-কিশোরদের কাছে শুধু একটি প্রতিযোগিতা নয়, বরং শিল্পজীবনের প্রথম পাঠশালা। অল্প বয়সে প্রতিযোগিতার মঞ্চে দাঁড়িয়ে অভিনয় করা, গানের সুর তোলা, আবৃত্তি কিংবা গল্পবলা শিশু-কিশোরদের সারাজীবনের আত্মবিশ্বাস গড়ে দেয় এবং তাদের ভবিষ্যতের পথকে আলোকিত করে।
রংপুর বিভাগের শিশুশিল্পীদের জাতীয় মঞ্চে উঠে আসার এই পথ মোটেই মসৃণ ছিল না। শিশুশিল্পীদের দৃঢ় মনোযোগ, নিয়মিত অনুশীলন এবং অদম্য অধ্যবসায় তাদের জাতীয় পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। রংপুর বিভাগের ৯ জন শিশুশিল্পীর সাফল্য প্রমাণ করে—পরিশ্রম ও অধ্যবসায় থাকলে বাংলাদেশের যে-কোনো প্রান্ত থেকেই সাফল্য অর্জন করা সম্ভব। তাদের এই অর্জন শুধু ব্যক্তিগত গৌরব নয়, বরং দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের জন্যও এক বড় প্রাপ্তি। নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতায় শিশুশিল্পীদের এই সাফল্য দেশের অসংখ্য শিশুকে স্বপ্ন দেখাতে অনুপ্রাণিত করবে—এমনটাই প্রত্যাশা।