১২ বৈশাখ, ১৪৩২ - ২৫ এপ্রিল, ২০২৫ - 25 April, 2025

বিএনপিরকর্মী  নিহতের ঘটনায় উত্তাল বদরগঞ্জ এখনও মামলা হয়নি, প্রকাশ্যে হত্যাকারীরা

2 weeks ago
82


নিজস্ব প্রতিবেদক:

রংপুরের বদরগঞ্জে দোকানঘর ভাড়া নিয়ে পুরনো এক ব্যবসায়িক বিরোধকে কেন্দ্র করে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নিয়েছে। এতে নিহত হন উপজেলা বিএনপির একজন নিবেদিত কর্মী লাভলু মিয়া সরকার। গতকাল রবিবার তার মরদেহ নিয়ে বদরগঞ্জ পৌরশহরে বিক্ষোভ হয়েছে। অ্যাম্বুলেন্সে সংরক্ষিত মরদেহ নিয়ে পৌরশহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয়। এতে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের বহু নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে গত শনিবার দুপুর থেকে রবিবার পর্যন্ত সেনা বাহিনী ও পুলিশকে টহল দিতে দেখা যায়। তবে প্রকাশ্যে হতাকারীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে অথচ পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করছে না বলে বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়।

রবিবার বাদ আসর উপজেলার মধুপুর ইউনিয়নের রাজারামপুর কালজানি গ্রামে লাভলু মিয়ার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিতহয়। এসময় বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের শতশত নেতাকর্মী ও প্রতিবেশিরা উপস্থিত ছিলেন। শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

এর আগে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পথসভায় বক্তব্য রাখেন জেলা ও উপজেলা বিএনপির অন্যতম সদস্য সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলী সরকার, উপজেলা বিএনপির যুগ্ন আহ্বায়ক হুমায়ুন কবির মানিক, সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান সাইদুল ইসলাম, বিএনপি নেতা এনামুল হক, সুমন সর্দার, মিজানুর রহমান, মহিলা দলের সদস্য সাহেদা হাসান ও আবুজার গাফ্ফারী মন্টু প্রমুখ। এর আগে রবিবার সকালে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে লাভলুর ময়না তদন্ত সম্পন্ন হয়। পরে দুপুরে তার মরদেহ আনা হয় বদরগঞ্জে। সেখানে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে মরদেহ রেখে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ করেন। ঘটনার মুল হোতা শহিদুল হক মানিক তার ছেলে তানভির আহম্দে তমালকে ঘটনার জন্য দায়ি করে সকল সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করে শাস্তি দাবি করা হয়। বিএনপি কর্মী লাভলুর মৃত্যুর ঘটনায় বদরগঞ্জের রাজনীতিতে এখন সৃষ্টি করেছে উত্তাল পরিস্থিতি। যার নেপথ্যে দায়ি করা হচ্ছে ইউপি চেয়ারম্যান শহিদুল হক মানিক ও তার সন্ত্রাসী বাহিনীকে। ঘটনার পর বদরগঞ্জ শহরে এক প্রকার আতঙ্ক ও শোকের ছায়া নেমে এসেছে। সাধারণ মানুষ বলছেন, রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের বলি হলেন নিরীহ লাভলু সরকার।  দোকানঘরের মতো একটি ছোট্র বিষয় থেকে এমন মৃত্যু মেনে নেওয়া কঠিন বলে সাধারণ মানুষ মনে করছে।

 ঘটনার সূত্রপাত শহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার সংলগ্ন একটি দোকানঘর ঘিরে। দীর্ঘদিন ধরে দোকান মালিক ইশতিয়াক বাবু এবং ভাড়াটিয়া ঢেউটিন ব্যবসায়ী জাহিদুল হক জোয়ারদারের মধ্যে ভাড়ার মেয়াদ নিয়ে বিরোধ চলছিল। ২০২৮ সাল পর্যন্ত চুক্তি থাকলেও ইশতিয়াক দোকান ছাড়ার জন্য নোটিশ দিলে জাহিদুল তা মানতে অস্বীকৃতি জানান। একপর্যায়ে ইশতিয়াক আশ্রয় নেন বিএনপির সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলী সরকারের কাছে।  আর জাহিদুল হক শেলটার নেন ইউপি চেয়ারম্যান শহিদুল হক মানিকের কাছে। এই দ্বন্দ্ব শুধু ব্যক্তি বা ব্যবসায়িক পর্যায়ে থাকেনি। তা দ্রুত রূপ নেয় রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের লড়াইয়ে। দুই পক্ষের সমর্থকেরা ক্রমেই সংঘাতমুখী হয়ে ওঠেন। ঘটনার ঠিক আগের দিন, শহিদুল হক মানিকের ছেলে তানভির আহমেদ তমাল তার ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডি থেকে সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলী সরকারকে নিয়ে আপত্তিকর, কুরুচিপূর্ণ স্ট্যাটাস দেন। এতে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে পুরো বদরগঞ্জে।

শনিবার সকালে শহীদুল হক মানিকপন্থীরা দোকানঘর খুলে দেওয়ার দাবিতে শহীদ মিনারে মানববন্ধনের আয়োজন করে। এর বিরুদ্ধে পাল্টা অবস্থান নেয় মোহাম্মদ আলী সরকারপন্থীরা। সকাল সাড়ে ১১টার দিকে মোহাম্মদ আলী সরকারের অনুসারীরা লাঠিসোটা, দেশীয় অস্ত্র নিয়ে শহরে মিছিল করে। তারা মানববন্ধনের ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে এবং শহীদ মিনারে স্থাপন করা সামিয়ানা নামিয়ে দেয়। 

এই উত্তেজনার ২০ মিনিটের মধ্যে পাল্টা হামলা চালায় শহিদুল হক মানিকপন্থী সশস্ত্র দল। শনিবার সাড়ে ১২টার দিকে পৌরশহরের আলম মার্কেটের সামনে ঘটে ভয়াবহ সংঘর্ষ। এসময় মোহাম্মদ আলী সরকারের ওৎপেতে থাকা নেতাকর্মীদের ওপর দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলে পড়ে। তাদের আঘাতে গুরুতর আহত হন ৭ জন। যাদের মধ্যে লাভলু মিয়া সরকার ছিলেন সবচেয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থায়। তাকে তাৎক্ষণিকভাবে রংপুরে নেওয়া হয়। ওইদিন বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

রোববার সকালে ময়নাতদন্ত শেষে লাভলুর মরদেহ শহীদ মিনারে এনে শ্রদ্ধা জানানো হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের শতশত নেতাকর্মী। প্রতিবাদ সভায় দাবি ওঠে  নিবেদিত কর্মী লাভলু হত্যার বিচার চাই। মানিক ও তার ছেলের গ্রেপ্তার চাই। বক্তাদের সবাই, শহিদুল হক মানিককে ‘বহিরাগত সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়ে বলেন, তিনি বিএনপির কোনো সাংগঠনিক কাঠামোতে নেই। অতীতে তিনি জামায়াত-শিবিরে সক্রিয় ছিলেন। তার সঙ্গে বিএনপির কোন সম্পর্ক নেই। বক্তারা স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে অনুরোধ করে বলেন, মানিককে বিএনপির সদস্য বানাবেন না। সে বহিরাগত সন্ত্রাসী। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে মানিক তখন তার হয়ে কাজ করে।

এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বদরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির অভ্যন্তরে এখন শুরু হয়েছে নানামুখি প্রশ্ন।  জেলা বিএনপি থেকে তিন নেতাকে কারণ দর্শানোর নোটিশও করা হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছেন, সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলী সরকার, যুগ্ম আহ্বায়ক হুমায়ুন কবির মানিক এবং ইউপি চেয়ারম্যান শহিদুল হক মানিক।  তবে এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেন উপজেলার নেতারা।

 উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক হুমায়ুন কবির মানিক, আবুজার গাফ্ফারী মন্টু ও এনামুল হক অভিযোগ করে বলেন, সন্ত্রাসী শহিদুল হক মানিক বিএনপির কেউ নন। তার বিরুদ্ধে নোটিশ দেওয়া ঠিক হয়নি।  বরং তাকেই বিচারের মুখোমুখি করার জন্য পুলিশ প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়ার প্রয়োজন ছিল।  সে জামায়াত-শিবিরের সক্রীয় কর্মী ছিলেন। ২৪এর ৫ আগস্টের পর রাতারাতি বিএনপি সদস্য হিসেবে নিজেকে দাবি করে তান্ডব শুরু করেছে মানিক।

এদিকে সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলী সরকার বলেন, ‘লাভলু শুধু দলের কর্মী নয়। আমার সন্তানের মতো ছিল। ছোটবেলা থেকে ওকে দেখাশোনা করেছি। এই হত্যাকাণ্ড আমাকে ব্যক্তিগতভাবে ভেঙে দিয়েছে। শহিদুল হক মানিকের ছেলে তমাল ফেসবুকে আমার বিরুদ্ধে আপত্তিকর লেখা লিখেছে। আমি নাকি চোর-ডাকাত। দখলবাজ। অথচ এই তমাল ৫ আগস্টের পর বদরগঞ্জে বহু সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটিয়েছে। বিভিন্ন জনের বাড়ি, কমিউনিট সেন্টার দখল করেছে। তার কারণে তাকে গ্রেপ্তারও করা হয়। অথচ আমার নামে অশালীন কথা ফেসবুকে তুলে ধরেছে। এ জন্য আমি দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ওসি সাহেবকে অনুরোধ করেছি।’

রবিবার এ রির্পোট লেখা সময় শহিদুল হক মানিকের মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে তিনি ঘটনারদিন শনিবার বিভিন্ন গণমাধ্যমে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, তার সঙ্গে হতাকাণ্ডের ঘটনার সম্পর্ক নেই। তিনি নিজেকে বিএনপির সদস্য হিসেবে দাবি করেন।

বদরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক অধ্যাপক পরিতোষ চক্রবর্তী বলেন, ‘শহিদুল হক মানিক দলের কোন পদে নেই। উপজেলা কমিটির বা অঙ্গ সংগঠনের কোন সদস্য নন তিনি। কিন্তু তার পরেও জেলা বিএনপি থেকে তাকে কেন কারণ দর্শানো নোটিশ দিল তা আমার জানার মধ্যে নেই।

বদরগঞ্জ থানার ওসি এ কে এম আতিকুর রহমান বলেন, ‘পরিস্থিতি বর্তমানে শান্ত রয়েছে। এখনও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কোন মামলা হয়নি। মামলা হলে তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

// Set maxWidth