কৃষিজমির মাটি অবৈধ ইটভাটার পেটে' প্রশাসনের নেই তৎপরতা
বদরগঞ্জ (রংপুর) প্রতিনিধি:
কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি বিক্রির হিড়িক পড়েছে রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলায়। কৃষি জমির মাটি চলে যাচ্ছে উপজেলার সকল ইটভাটায়।এ কারণে নষ্ট হচ্ছে সড়ক।ফসলি জমির মাটি ইটভাটায় বিক্রি হওয়ায় হওয়ার কারণে কমছে উৎপাদন। স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রশাসনের তেমন তৎপরতা না থাকায় কৃষিজমির মাটি কাটার প্রতিযোগিতা চলছে। টাকার লোভে পড়ে মাটি বিক্রি করলেও পরবর্তী ক্ষতির বিষয়টি ভাবছেন না কৃষকেরা।
বালু মহল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইনে ২০১০ বলা হয়েছে, বিক্রির উদ্দেশ্যে বালু বা মাটি উত্তোলনের ফলে কোন নদীর তীর ভাঙ্গনের শিকার হলে সেক্ষেত্রে বালু বা মাটি তোলা যাবে না। অন্যদিকে সেতু কালভার্ট বাঁধ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও স্থাপনা অথবা আবাসিক এলাকা থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যে ভালো উত্তোলন নিষিদ্ধ।
গত এক সপ্তাহে সরেজমিনে উপজেলার বিভিন্ন এলাকার মাঠ ঘুরে দেখেছেন, কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি তিন-চার ফুট গর্ত করে ট্রাক্টরে বিভিন্ন ইটভাটায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইটভাটার মালিকেরা এই মাটি কিনছেন। কৃষকেরা এর ক্ষতিকর দিক বুঝতে পারছেন না।
সরেজমিনে জানা গেছে, উপজেলার রাধানগর ইউনিয়নের মধুপুর ইউনিয়নে ইটভাটা রয়েছে ২৫টি। সেখানে এক্সকাভেটরের (ভেকু) সাহায্যে কৃষিজমির মাটি কেটে ট্রাক্টরে তুলতে দেখা গেছে। সেখানে কথা হয়, ট্রাক্টরশ্রমিক রবিউল মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘জমির মালিক মাটি বিক্রি করেছে ইটভাটার মালিকের কাছে। আমাদেরকে আদেশ করছে আমরা জমি থেকে মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছি। আমাদের কিছু করার নেই।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, বদরগঞ্জ উপজেলায় কৃষিজমিতে নির্মাণ করা হয়েছে ৭১ টি ইটভাটা। একেকটি ইটভাটা নির্মাণ করা হয়েছে ৫ থেকে ১৫ একর পর্যন্ত কৃষিজমির ওপর। কয়েক বছর ধরে এসব ভাটায় ইট পোড়ানো হলেও এবার ইটভাটার শেয়ার অংশীদারত্বের দ্বন্দ্বের কারণে ১০-১২ ইটভাটা বন্ধ রয়েছে। তবে ৬০টির মতো ইটভাটায় কাঁচা ইট পোড়ানো হচ্ছে।এসব কাঁচা ইট তৈরি করতে ব্যবহার করা হচ্ছে কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি। ৬০ ইটভাটার মধ্যে ৫০টিই অবৈধ।
জানতে চাইলে পাশের বিবিসি৩ ইটভাটার ম্যানেজার বলেন, ইট তৈরিতে অনেক মাটি লাগে। যেখান থেকে পাই, মাটি কিনে ইট বানাই।
উপজেলার রামনাথপুর, চম্পাতলী, শেখেরহাট, বকশীগঞ্জ, ঘাটাবিল এবং পাঠানের হাট এলাকা ঘুরে একই চিত্র দেখা গেছে।
বিষ্ণুপুর ইউনিয়নে পাস্তপতি গ্রামের কৃষক সোলেমান মিয়া বলেন, তিন বছর আগে আমার আবাদি জমির দুই পাশের দুই কৃষক জমির মাটি বিক্রি করায় চার পাঁচ ফুট গভীর হয়েছে। এখন আমার উঁচু হয়েছে। জোরে বৃষ্টি হলে জমিটা ভেঙে পড়ছে।
কুতুবপুর ইউনিয়নের কৃষক নির্মল রায় বলেন, গত বছরে আমার জমির পাশে জমিগুলোর মাটি ইটভাটাই বিক্রি করেছে। আমার জমিতে উঁচু হয়ে আছে। তাই এবার বাধ্য হয়ে আবাদি জমির মাটি ইটভাটায় বিক্রি করে দিছি। ইট ভাটার মালিক প্রতি গাড়ি ৩০০ টাকা করে দিচ্ছে।
উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা ফিরোজ আকন্দ বলেন, কৃষকেরা কাঁচা টাকার লোভে পড়ে তিন থেকে চার ফসলি জমির উপরিভাগের মাটি বিক্রি করছেন। ইটভাটার মালিকেরা ২ থেকে ৪ ফুট গভীর পর্যন্ত কৃষিজমির মাটি কিনে ইটভাটায় নিচ্ছেন।এ কারণে কৃষি জমি গুলো অনেকটাই নিচু হয়ে যাচ্ছে। এসব জমিতে বছরে শুধু দুবার ধান ছাড়া আর কোনো সবজি উৎপাদিত হয় না। সেখানে ধানেরও উৎপাদন তেমন হয় না। আমরা জমিতে তিন থেকে চার ফসল উৎপাদনে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছি। কিন্তু ইটভাটাগুলোর কারণে অনেকটাই হোঁচট খাচ্ছি। কৃষকেরা মাটি বিক্রি করে কাঁচা টাকা পাচ্ছেন। কিন্তু জমির কী ক্ষতি হচ্ছে, তাঁরা এ মুহূর্তে বুঝছেন না।
সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার মধুপুর ইউনিয়নের রাজরামপুর মৌজায় কৃষিজমির মাটি কাটার প্রতিযোগিতা চলছে। কেউ কেউ কৃষিজমিতে এক্সকাভেটর মেশিন (ভেকু) লাগিয়েছেন। সেই মেশিনের সাহায্যে মাটি কেটে তুলছেন ট্রাক্টরে।
এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সেলিনা আফরোজা বলেন, কৃষি জমির উপরিভাগের মাটি থাকে ৮ থেকে ১০ ইঞ্চি গভীর পর্যন্ত। এই পর্যন্ত মাটি কেটে নেওয়ার কারণে জমির উর্বরতা শক্তি হারিয়ে যায়। এটি ফিরিয়ে আনতে ২০ থেকে ২৫ বছর সময় লাগে। তবু আগের মতো ফসল উৎপাদন হবে না।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আঞ্জুমান সুলতানা জানান, কৃষিজমির মাটি কাটার অভিযোগ পেলে অভিযান চালাচ্ছি। এছাড়াও নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা অব্যাহত রয়েছে। থানায় নিয়মিত মামলা হচ্ছে। সম্প্রতি ড্রেজার মেশিন অকেজো ও পাইপ ধ্বংস করা হয়েছে। মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে ৪ জনকে জেলেও দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও ইউনিয়ন ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তা কয়েক দফায় ৮ টি মামলা করেছে। তিনি আরো বলেন গত দেড় মাসে ১০ টিরও অধিক মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে। আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।